১০০তম অধ্যায়
কৃষ্ণের অশ্বপরিচর্য্যা – জয়দ্রথাভিমুখে রথচালনা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এই রূপে মহাত্মা অর্জ্জুনের প্রভাবে সমরস্থলে সলিল সমুৎপন্ন, শরগৃহ নিৰ্ম্মিত ও শত্রু সৈন্যগণ নিরাকৃত হইলে মহাদ্যুতি বাসুদেব রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া কঙ্কপত্রযুক্ত বাণে নির্ভিন্ন তুরঙ্গমগণকে মুক্ত করিলেন। যাবতীয় সিদ্ধ ও চারণগণ এবং সমুদায় সৈনিক পুরুষ মহাবীর অর্জ্জুনের সেই অদৃষ্টপূর্ব্ব কাৰ্য্য সন্দর্শন করিয়া তাঁহাকে বারংবার সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। মহারথগণ কোন ক্রমেই অর্জ্জুনকে নিবারণ করিতে পারিলেন না দেখিয়া সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় প্রভূত গজ বাজি ও অসংখ্য রথের আক্রমণেও অশঙ্কিত হইয়া সমুদায় পুরুষকে অতিক্রম পূর্ব্বক আশ্চর্য্য যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহীপালগণ অর্জ্জুনের উপর অসংখ্য শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন । কিন্তু মহাত্মা বাসব-নন্দন তাহাতে কিছু মাত্র ব্যথিত হইলেন না। সাগর যেমন নদীগণকে অনায়াসে ধারণ করে, সেইরূপ বীৰ্য্যবান পার্থ বীরগণ নির্ম্মুক্ত শত শত শর, গদা ও প্রাস সমুদায় অব্যগ্রচিত্তে ধারণ করিতে লাগিলেন। তাঁহার অস্ত্রবেগ ও নিজ বাহুবলে নরেন্দ্রগণের উত্তম উত্তম বাণ সকল বিফল হইয়া গেল। এক লোভ যেমন সমুদায় সদগুণ নিবারণ করে, সেইরূপ অর্জ্জুন একাকী ভূমিস্থ হইয়াও রথারূঢ় অসংখ্য ভূপতিগণকে নিবারণ করিলেন। তখন কৌরবেরাও পার্থ ও বাসুদেবের অদ্ভুত পরাক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া কহিতে লাগিলেন যে, মহাপ্রভাব অর্জ্জুন ও বাসুদেব রণক্ষেত্রে অশ্বগণকে রথ হইতে মুক্ত করিয়াছেন, ইহা অপেক্ষা আর কি আশ্চর্য্য ব্যাপার আছে। ঐ সমরস্থলে অসাধারণ তেজ প্রকাশ পূর্ব্বক আমাদিগকে ভয় বিহ্বল করিয়াছেন।
হে মহারাজ! ঐ সময় অশ্ববিদ্যা-সুনিপুণ মহাত্মা মধুসূদন সৈন্যগণসমক্ষে সেই অর্জ্জুন-নির্মিত শরগৃহে অশ্বগণকে সমানীত করিয়া তাহাদের শ্রম, গ্লানি ও বেপথু নিবারণ করিলেন এবং স্বহস্তে তাহাদের শল্যোদ্ধার ও গাত্র পরিমার্জ্জনপূর্ব্বক তাহাদিগকে জল পান করাইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে অশ্বগণের উদক পান, স্নান, ভক্ষণ ও ক্লমবিনোদন সমাধান হইলে মহাত্মা কৃষ্ণ হৃষ্টচিত্তে তাহাদিগকে পুনরায় উত্তম রথে সংযোজন করিলেন এবং অর্জ্জুন সমভিব্যাহারে তাহাতে আরোহণ করিয়া দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিলেন। কৌরবেরা মহাবীর অর্জ্জুনের রথে বিগততৃষ্ণ অশ্বগণ সংযোজিত হইয়াছে দেখিয়া পুনৰ্বার বিমনায়মান হইলেন। তাহারা ভগ্ন দশন সর্পের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হায়! কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন গমন করিয়াছে; আমাদিগকে ধিক্!” ঐ সময় এক রথারূঢ়, বৰ্ম্মাচ্ছাদিত দেহ, অরাতিঘাতন কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন ক্রীড়া করিয়াই যেন কৌরব সৈন্যগণকে সংহার পূর্ব্বক যত্নবান ক্ষত্রিয়গণের সমক্ষে স্বীয় বীর্য্য প্রকাশ করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। তখন অন্যান্য সেনাগণ তাঁহাদিগকে দ্রুতবেগে গমন করিতে দেখিয়া উচ্চস্বরে কহিল, “হে কৌরবগণ! ঐ দেখ কেশব ধনুর্ধারিগণের সমক্ষে রথযোজন করিয়া আমাদিগকে ছিন্ন ভিন্ন করিয়া জয়দ্রথের অভিমুখে অশ্ব চালন করিতেছেন। অতএব তোমরা অবিলম্বে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে সংহার করিতে যত্নবান হও।”
হে মহারাজ! সেই সময় কোন কোন ভূপতি সমরক্ষেত্রে সেই অদ্ভুত ব্যাপার অবলোকন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হায়! দুরাত্মা দুর্য্যোধনের অপরাধেই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, সমস্ত সৈন্য, ক্ষত্রিয়গণ ও সমুদায় পৃথিবী এককালে উংসন্ন হইল। উপায়ানভিজ্ঞ দুৰ্য্যোধন ইহা বুঝিতে পারিতেছেন না।” কেহ কেহ কহিলেন, “সিন্ধুরাজের আর নিস্তার নাই; তিনি অবশ্যই শমন সদনে গমন করিবেন; এক্ষণে তাঁহার নিমিত্ত যাহা কৰ্তব্য থাকে, কুরুরাজ তাঁহার অনুষ্ঠান করুন। হে রাজন্!” হে রাজন! “ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন অক্লান্ত তুরঙ্গম যুক্ত রথে আরোহণ পূর্ব্বক সিন্ধুরাজের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। কৌরব পক্ষীয় যোধগণ সেই শস্ত্রধরাগ্রগণ্য কালান্তক যমোপম মহাবাহু অর্জ্জুনকে কোন ক্রমে নিবারণ করিতে পারিলেন না। শত্রুতাপন পাণ্ডব জয়দ্রথের অভিমুখে গমনার্থে মৃগকুলনিহন্তা মৃগরাজের ন্যায় কৌরব সৈন্যগণকে বিদ্রাবণ ও বিলোড়ন করিতে লাগিলেন। মহাত্মা মধুসূদন সৈন্য সাগর মধ্যে অবগাহন পূর্ব্বক সত্বরে অশ্বচালন ও পাঞ্চজন্য নিনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। অর্জ্জুনের শ্বগণ এরূপ প্রবলবেগে গমন করিল যে, তদ্বিসৃষ্ট শরনিকর তাঁহার পশ্চাৎ ভাগে নিপতিত হইতে লাগিল। অনন্তর সমুদায় নরপতি ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ জয়দ্রথ বধাভিলাষী ধনঞ্জয়কে পুনরায় চতুর্দ্দিক হইতে আক্ৰমণ করিলেন। এইরূপে সৈন্য সকল অর্জ্জুনাভিমুখে গমন করিলে মহারাজ দুৰ্য্যোধন সত্বরে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। অনেক সৈন্য মহাবীর ধনঞ্জয়ের পবনোদ্ধুত ও পতাকান্ত, জলদ গম্ভীর নিস্বন, কপিধ্বজ রথ দর্শন করিয়া বিষণ্ন হইতে লাগিল। ঐ সময় পার্থিব রজোরাশি সমুচ্ছিত হইয়া দিনকরকে সমাচ্ছন্ন করিলে বাণাৰ্দিত বীরগণ কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে অবলোকন করিতে অসমর্থ হইলেন।”