৯ম অধ্যায়
পরিচারিকাবেশে দ্রৌপদীর প্রবেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর অসিতালোচনা দ্রৌপদী নীল সূক্ষ্ম, সুকোমল ও সুদীর্ঘ কেশপাশ বেণীরূপে বন্ধন এবং অতিমাত্ৰ মলিন একমাত্ৰ বসন পরিধান করিয়া সৈরিন্ধ্রীবেশে দীনভাবে গমন করিতে লাগিলেন। নাগরিক পুরুষ ও স্ত্রী লোকেরা দ্রুতপদে তাঁহার নিকট আগমন করিয়া ‘তুমি কে? তোমার অভিলাষ কি?’ বারংবার এইরূপ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। তখন দ্রৌপদী তাহাদিগকে কহিলেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী, যদি কেহ আমাকে কোন কাৰ্য্যে নিযুক্ত করেন, আমি তাহা সুচারুরূপে সম্পাদন করিব, এই নিমিত্ত এ স্থানে আগমন করিয়াছি।” কিন্তু তাহারা অসামান্য রূপলাবণ্য, বেশবিন্যাস ও মধুর বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে অন্নার্থিনী দাসী বলিয়া বিশ্বাস করিতে পারিল না।
বিরাটমহিষী সুদেষ্ণা প্রাসাদে আরোহণ করিয়া ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন, ইত্যবসরে পাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদী তাঁহার নেত্রপথে নিপতিত হইলেন। রাজমহিষী তাহাকে তাদৃশ রূপবতী, অনাথা ও একবসনা দেখিয়া নিকটে আহ্বানপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভদ্রে! তুমি কে ও তোমার অভিলাষই বা কি?” দ্রৌপদী কহিলেন, “আমি সৈরিন্ধ্রী; যিনি আমাকে নিযুক্ত করিবেন, আমি সচারুরূপে তাঁহার কর্ম্মসম্পাদন করিব, এই কারণেই এ স্থানে আগমন করিয়াছি।”
সুদেষ্ণা কহিলেন, “হে ভাবিনি! তুমি যে প্রকার কহিতেছ, তোমার ন্যায় কামিনীগণের পক্ষে তাহা কখনই সম্ভব হয় না। ফলতঃ তুমিই নানাবিধ দাসদাসীগণের নিযোগ্যা। তোমার গুল্ফভাগ অনুচ্চ, উরুদ্বয় সংহত, নাভিপ্রদেশ অতি গভীর, নাসিক উন্নত, অপাঙ্গ, কর, চরণ, জিহ্বা ও অধর লোহিতবর্ণ বাক্য হংসের ন্যায় গদগদ, কেশীকলাপ অতি মনোহর, অঙ্গ শ্যামলবৰ্ণ, নিতম্ব ও পয়োধর নিবিড়তম, পক্ষ্ম[চক্ষুর পাতার লোম]রাজি কুটিল, মধ্যভাগ ক্ষীণ, গ্ৰীবা কম্বুর ন্যায়, শিরা-সকল অদৃশ্য এবং মুখমণ্ডল পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় রমণীয়। তুমি কাশ্মীর-তুরঙ্গীর ন্যায় এবং পদ্মাপলাশলোচনা কমলার ন্যায় সৌন্দৰ্য্য ধারণ করিয়াছ। হে ভদ্ৰে! তোমাকে পরিচারিণী বলিয়া কোন প্রকারেই বোধ হইতেছে না। তুমি যক্ষরমণী কি দেবকামিনী? গন্ধর্বী কি অন্সরা? ভুজঙ্গবনিতা কি এই নগরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা? বিদ্যাধরী বা কিন্নরী অথবা স্বয়ং রোহিণীঃ অলম্বুষা কি মিশ্রকেশী? পুণ্ডরীকা কি মালিনী? অথবা তুমি ইন্দ্ৰাণী, বারুণী, বিশ্বকর্ম্মর পত্নী, ব্ৰাহ্মাণী কি অন্যান্য দেবকন্যাগণের অন্যতমা হইবে? যাহা হউক, তুমি কে, বল।”
দ্ৰৌপদী কহিলেন, “আমি দেবী, গন্ধর্বী, অসুরী বা রাক্ষসী নাহি। সত্য কহিতেছি, আমি সৈরিন্ধ্রী। আমি কেশসংস্কার বিলেপন, পেষণ এবং মল্লিকা, উৎপল, কমল ও চম্পক প্রভৃতি কুসুমকলাপের বিচিত্র মাল্য গ্রন্থন করিয়া থাকি। প্রথমে কৃষ্ণপ্ৰিয়তমা সত্যভামা, তৎপরে কুরুকুলের একমাত্র সুন্দরী দ্রুপদকুমারীর সেবা করিয়াছিলাম। সেই সেই স্থানে সমুচিত অশন-বসন সহকারে পরমসুখে কালযাপন করিতাম। স্বয়ং দেবী আমাকে মালিনী বলিয়া আহ্বান করিতেন। আজি আপনার আলয়ে আগমন করিয়াছি।”
সুদেষ্ণা কহিলেন, “হে কল্যাণি! আমি তোমাকে মস্তকে স্থান দান করিতে পারি; কিন্তু ভয় হয়, পাছে রাজা সর্ব্বান্তঃকরণে
তোমার নিমিত্ত চঞ্চল হয়েন। পুরুষের কথা দূরে থাকুক, এই রাজকুল ও আমার গৃহবাসিনী রমণীগণ মোহিত হইয়া অনন্যমনে তোমাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। দেখ আমার আলয়জাত তরুজাত তোমাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত অবনত হইতেছে। হে নিবিড়নিতস্বিনি! বিরাটরাজ তোমার অলৌকিক অঙ্গসৌষ্ঠব নিরীক্ষণ করিলে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া সর্ব্বাতন্তঃকরণে তোমাতেই অনুরক্ত হইবেন। হে তরলায়তলোচনে! তুমি যে পুরুষের প্রতি সানুরাগ দৃষ্টিপাত করিবে অথবা তুমি সতত যাহার নেত্রপথে নিপতিত হইবে, সে অবশ্যই অনঙ্গশরের বশবর্তী হইবে। মনুষ্য যেমন আত্মহত্যার নিমিত্ত বৃক্ষে আরোহণ করে, তোমাকে রাজগৃহে স্থানদান করা আমার পক্ষে সেইরূপ। ফলতঃ তোমাকে স্থানদান করা কর্কটীর গর্ভধারণের ন্যায় আমার মৃত্যুস্বরূপ [কাঁকড়া—গর্ভধারণ করিলেই কাঁকড়ার মৃত্যু হয়—প্রসবের দ্বার না থাকায় প্রসবকালে পেট ফাটিয়া যায়।] হইবে।”
দ্রৌপদী কহিলেন, “হে ভাবিনি! বিরাট বা অন্য কোন পুরুষ আমাকে লাভ করিতে সমর্থনহেন। পাঁচ জন যুবা গন্ধর্ব্ব আমার স্বামী। তাঁহারা কোন মহাসত্ত্ব গন্ধর্ব্বরাজের তনয়। ঐ পাঁচ জন সতত আমাকে রক্ষা করিয়া থাকেন। যিনি আমাকে উচ্ছিষ্ট দান না করেন এবং পাদপ্রক্ষালন না করান, আমার পতি গন্ধর্ব্বগণ তাঁহাদিগের প্রতি প্ৰসন্ন হয়েন। যে পুরুষ ইতরকামিনীর ন্যায় আমার প্রতি লোভপরবশ হয়, তাহাকে সেই রাত্রেই শমনসদনে গমন করিতে হয়। কোন পুরুষ আমাকে স্বধর্ম্ম হইতে পরিচালিত করিতে সমর্থনহে। আমার প্রিয়তম গন্ধর্ব্বগণ এক্ষণে দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইয়াও প্রচ্ছন্নভাবে আমাকে রক্ষা করিয়া থাকেন।”
সুদেষ্ণা কহিলেন, “হে আনন্দবর্দ্ধিনি! তোমার অভিলাষানুরূপ বাস প্ৰদান করিব। তোমাকে কদাচ কাহারও চর্বিত বা উচ্ছিষ্ট স্পর্শ করিতে হইবে না।”
হে জনমেজয়! পতিপরায়ণা দ্রুপদনন্দিনী এইরূপে বিরাটভাৰ্য্যা কর্ত্তৃক পরিসান্ত্বিত হইয়া বিরাটনগরে বাস করিতে লাগিলেন। কেহই তাহাকে চিনিতে পারিলেন না।