৯৯তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনবাক্যে দুঃখিত ভীষ্মের ক্ৰোধ
সঞ্জয় কহিলেন, “এইরূপে মহাত্মা ভীষ্ম মন্ত্রশিলাকাবিদ্ধ [সর্পবিষস্তম্ভনকারী মন্ত্ররূপ শলাকায় বিদ্ধ] নিশ্বসন্ত অজগরের ন্যায় রাজা দুর্যোধনকর্ত্তৃক বাক্যশলাকাদ্বারা সাতিশয় বিদ্ধ ও দুঃখে নিতান্ত কাতর হইয়া দুৰ্য্যোধনকে কিছুমাত্র প্রিয়কথা কহিলেন না; কিন্তু রোষাবেশ প্রভাবে নিমীলিতনেত্ৰে বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া সুরাসুরগন্ধর্ব্বসহকৃত [সুর-অসুর-গন্ধর্ব্ব লোকসহ] দেবলোককে কোপানলে দগ্ধ করিয়াই যেন লোচনদ্বয় উন্মীলনপূর্ব্বক শান্তভাবে কহিতে লাগিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! আমি যথাশক্তি যত্নবান ও প্রাণরক্ষায় নিরপেক্ষ হইয়া তোমারই প্রিয়কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতেছি, তথাচ তুমি আমার প্রতি কি নিমিত্ত কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিতেছ? পাণ্ডবগণ খাণ্ডবদাহে শত্রুদিগকে পরাজয় করিয়া অগ্নির তৃপ্তিসাধন করিয়াছেন, তখন তাহাই তাঁহাদিগের বিক্রমের পর্য্যাপ্ত নিদর্শন। গন্ধর্ব্বেরা বলপূর্ব্বক তোমাকে হরণ এবং সূতপুত্র কর্ণও তোমার সহোদরগণ পলায়ন করিলে যখন কেবল ভীমসেন তোমাকে মোচন করিয়াছেন, তখন তাহাই তাঁহাদিগের বিক্রমের পর্য্যাপ্ত নিদর্শন। যখন বিরাটনগরে মহাবীর অর্জ্জুন একাকী আমাদের সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন, তখন তাহাই তাঁহাদিগের বিক্রমের পর্য্যাপ্ত নিদর্শন। যখন তিনি ক্রোধাবিষ্ট দ্রোণ ও আমাকে পরাজয় করিয়া বস্ত্ৰ[উত্তরপ্রার্থিত বসন]গ্ৰহণ করিয়াছেন, তখন তাহাই তাঁহাদিগের বিক্রমের পর্য্যাপ্ত নিদর্শন। যখন তিনি গোধন-অপহরণসময়ে অশ্বথামা ও কৃপাচাৰ্য্যকে পরাজয় করিয়াছেন এবং পুরুষাভিমানী কর্ণকে জয় করিয়া উত্তরাকে বস্ত্ৰ প্ৰদান করিয়াছেন, তখন তাহাই তাঁহাদিগের বিক্রমের পর্য্যাপ্ত নিদর্শন। তিনি যখন দেবরাজ ইন্দ্রেরও নিতান্ত দুৰ্জয় নিবাতকবচগণকে পরাজয় করিয়াছেন, তখন তাহাই তাঁহাদিগের বিক্রমের পর্য্যাপ্ত নিদর্শন। শঙ্খচক্ৰগদাধারী বিশ্বগোপ্তা [বিশ্বপালক] বাসুদেব যাহার রক্ষক, কে সেই অর্জ্জুনকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়? নারদ প্রভৃতি দেবর্ষিগণ বারংবার কহিয়াছেন, বাসুদেব অনন্তশক্তি, সৃষ্টিসংহারকারী, সৰ্বেশ্বর, দেবদেব, পরমাত্মা ও সনাতন।
ভীষ্মের নিঃশেষে শত্রুসৈন্যবধে সঙ্কল্প
“ ‘হে রাজন! মোহপ্রভাবে তুমি বাচ্যাবাচ্যজ্ঞানরহিত [‘কি বলা উচিত’ ‘কি বলা অনুচিত’ তাদৃশ জ্ঞানশূন্য] হইয়া গিয়াছ। যেমন মুমূর্ষ ব্যক্তিসকল বৃক্ষকে সুবৰ্ণময় নিরীক্ষণ করে, তদ্রূপ তুমিও সমস্ত বিপরীত দেখিতেছ। তুমি স্বয়ংই পূর্ব্বে পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণের সহিত মহাশক্রতা সমূৎপাদন করিয়াছ, এক্ষণে তুমি তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া পৌরুষ প্রকাশ কর, আমরা অবলোকন করি। আমি শিখণ্ডীকে পরিত্যাগ করিয়া সমাগত সমস্ত পাঞ্চাল ও সোমাকদিগকে বিনাশ করিব। হয় আমি তাহাদিগের শরনিকরে নিহত হইয়া শমনসদনে গমন করিব, না হয় তাহাদিগকে বিনাশ করিয়া তোমার প্রতিবৰ্দ্ধন করিব। শিখণ্ডী প্রথমে রাজগৃহে স্ত্রীরূপে উৎপন্ন হইয়াছিল; পরে বরপ্রভাবে পুরুষত্বলাভ করিয়াছে। বিধাতা যখন তাহাকে সর্ব্বপ্রথমে স্ত্রীরূপে সৃষ্টি করিয়াছেন, তখন তাহাকে স্ত্রী বলিয়াই অঙ্গীকার করিতে হইবে; অতএব আমি প্ৰাণান্তেও তাহাকে বধ করিব না। এক্ষণে তুমি সুখে নিদ্রা যাও ; আমি কল্য মহাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব। হে মহারাজ! যতদিন এই পৃথিবী থাকিবে, ততদিন লোকে আমার এই মহাযুদ্ধ কীর্ত্তন করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
“অনন্তর মহারাজ দুৰ্য্যোধন ভীষ্মকে অভিবাদন ও বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক স্বশিবিরে প্রবেশ করিয়া রজনী অতিবাহিত করিলেন। প্রভাত হইবামাত্ৰ শয্যা হইতে গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক ভূপালগণকে সেনা সুসজ্জিত করিতে আদেশ করিয়া কহিলেন, ‘ভুপালগণ! আজি মহাবীর ভীষ্ম ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সমুদয় সোমদিগকে বিনষ্ট করিবেন।’
ভীষ্মপৃষ্ঠরক্ষায় কৌরবমন্ত্রণা
“ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনের নিশাকালীন বহুবিধ বিলাপবাক্য শ্রবণ করিয়া উহা আপনার ভৎসনাস্বরূপ বিবেচনা করিয়া সাতিশয় দুঃখিত হইলেন এবং পরাধীনতার বিবিধ নিন্দা করিয়া অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিবার অভিলাষে বহুক্ষণ চিন্তা করিতে লাগিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন, ভীষ্ম যাহা চিন্তা করিতেছেন, তাহা ইঙ্গিতে হৃদয়ঙ্গম করিয়া দুঃশাসনকে কহিলেন, “হে দুঃশাসন! তুমি ভীষ্মরক্ষক রথসকল অবিলম্বে সুসজ্জিত এবং দ্বাবিংশতি অনীক [প্রধান সৈনিক] প্রেরণ কর। আমরা যে সসৈন্য পাণ্ডবগণের বধ ও রাজ্যপ্রাপ্তি এই দুইটি বিষয় বহু বৎসরাবধি চিন্তা করিতেছি, তাহাই উপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে মহাবীর ভীষ্মকে রক্ষা করাই আমাদের প্রধান কাৰ্য্য, ইনি সুরক্ষিত হইয়া আমাদিগের সাহায্য ও পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিবেন। ইনি কহিয়াছেন, আমি শিখণ্ডীকে কদাচ বধ করিব না। সে প্রথমে স্ত্রীরূপে উৎপন্ন হইয়াছিল; এই নিমিত্ত আমি সমরক্ষেত্রে উহাকে পরিত্যাগ করিব। ইহা প্ৰসিদ্ধিই আছে যে, আমি পূর্ব্বে পিতার প্রিয়কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিবার বাসনায় প্রবৃদ্ধ [অতি বিস্তৃত] রাজ্য ও মহিলাসকল [বিবাহাৰ্থ প্রস্তাবিত কন্যা] পরিত্যাগ করিয়াছিলাম। সত্যই কহিতেছি, আমি স্ত্রী বা স্ত্রীপূর্ব্ব পুরুষকে কদাচ বিনাশ করিব না। আমি তোমাকে উদযোগসময়ে [যুদ্ধ আয়োজনের আরম্ভে] কহিয়াছি, শিখণ্ডী স্ত্রীপূর্ব্ব পুরুষ; সে অগ্ৰে কন্যারূপে উৎপন্ন হইয়া পশ্চাৎ পুরুষতা লাভ করিয়াছে। এক্ষণে সে আমার সহিত যুদ্ধ করিলে আমি তাহার সম্মুখে কখনই শরনিক্ষেপ করিব না; কিন্তু পাণ্ডবপক্ষীয় অন্যান্য জয়াভিলাষী ক্ষত্ৰিয়দিগকে বিনাশ করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। হে দুঃশাসন! মহাবীর ভীষ্ম আমাকে এইরূপ কহিয়াছেন; অতএব সর্ব্বপ্রকারে ইহাকে রক্ষা করাই আমাদের প্রধান কার্য। বৃকও অরণ্যানীমধ্যে অরক্ষিত সিংহকে বিনাশ করিতে সমর্থ হয়; অতএব এক্ষণে বৃকস্বরূপ শিখণ্ডী যেন পিতামহকে সংহার করিতে না পারে। মাতুল শকুনি, শল্য, কৃপ, দ্রোণ ও বিবিংশতি, ইহারা সাবধানে ভীষ্মকে রক্ষা করুন; ইনি সুরক্ষিত হইলে আমাদের জয়লাভ হইবে, তাহাতে কিছুমাত্ৰ সন্দেহ নাই।”
“অন্তর সকলে রন্থসমূহে ভীষ্মের চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টিত করিলেন। আপনার আত্মজগণ ভূলোক ও দু’লোক বিকম্পিত এবং পাণ্ডবগণকে ক্ষোভিত করিয়া ভীষ্মকে বেষ্টনপূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। রথিসকল সুনিয়মে পরিচালিত করিসৈন্যের সহিত ভীষ্মকে পরিবৃত্ত করিয়া অবস্থান করিলেন। যেমন সুরাসুর সংগ্রামকালে দেবগণ ইন্দ্রকে রক্ষা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তাঁহারা সকলে ভীষ্মকে রক্ষা করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন রাজা দুৰ্য্যোধন পুনরায় দুঃশাসনকে কহিলেন, “হে দুঃশাসন! যুধামন্যু অর্জ্জুনের বামচক্র ও উত্তমৌজা দক্ষিণচক্র রক্ষা করিতেছেন, ইহারা অর্জ্জুনের রক্ষক; অর্জ্জুন শিখণ্ডীর রক্ষক। এক্ষণে শিখণ্ডী অর্জ্জুনকর্ত্তৃক সুরক্ষিত হইয়া আমাদের অবস্থানকালে ভীষ্মকে যাহাতে বিনাশ করিতে না পারে, তাহার উপায় বিধান কর।” তখন দুঃশাসন ভীষ্মকে অগ্ৰে লইয়া সেনাগণসমভিব্যাহারে যাত্ৰা করিলেন।
পাণ্ডবকর্ত্তৃক ভীষ্মসম্মুখে শিখণ্ডিস্থাপন
“অনন্তর অর্জ্জুন ভীষ্মকে রথিগণে পরিবেষ্টিত নিরীক্ষণ করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিলেন, “হে পাঞ্চলতনয়! তুমি আজি শিখণ্ডীকে ভীষ্মের সম্মুখে স্থাপন কর; আমি স্বয়ং তাঁহাকে রক্ষা করিব।’ ”