৯৯তম অধ্যায়
অগস্ত্যকর্ত্তৃক বাতাপি সংহার
লোমশ কহিলেন, ‘দানবরাজ ইল্বল মহর্ষি-সমবেত নৃপতিগণকে স্বরাজ্যে সমাগত সন্দর্শন করিয়া পরমসমাদরে পূজা করিলেন। তৎপরে তিনি অতিথিগণের ভোজনার্থ ছাগরূপধারী স্বীয় ভ্ৰাতা বাতাপিকে উত্তমরূপে পাক করিলেন। তখন রাজর্ষিগণ ছাগরূপী মহাসুর বাতাপিকে পাক করা হইয়াছে দেখিয়া সাতিশয় বিষগ্ন হইলেন। মহর্ষি অগস্ত্য তাঁহাদিগকে তদবস্থ দেখিয়া কহিলেন, “হে রাজর্ষিগণ! তোমরা খেদ করিও না, আমিই মহাসুর বাতাপিকে ভক্ষণ করিব।” এই বলিয়া মহার্ঘ আসনে উপবিষ্ট হইলে দানবেন্দ্ৰ ইল্বল সহাস্যবদনে তাঁহাকে পরিবেশন করিতে লাগিলেন, মহর্ষি অগস্ত্য ক্ৰমে ক্ৰমে বাতাপির সমুদয় মাংসই ভোজন করিলেন। অনন্তর অসুররাজ ইল্বল বাতাপিকে আহ্বান করিলে মহাত্মা অগস্ত্যের অধোদেশ হইতে ঘনঘটার ঘোরতর গর্জ্জনের ন্যায় গভীর-শব্দে সমীরণ নিৰ্গত হইল। তখন অসুরবর ইল্বল, “হে বাতাপে! তুমি নিষ্ক্রান্ত হও” বলিয়া বারংবার আহ্বান করিলে, মুনিসত্তম অগস্ত্য হাসিতে হাসিতে তাহাকে কহিলেন, “মহাসুর বাতাপি আর কিরূপে বহির্গত হইবে? আমি তাহাকে জীৰ্ণ করিয়াছি।”
“দানবেন্দ্ৰ ইল্বল স্বীয় ভ্ৰাতা বাতাপি জীৰ্ণ হইয়াছে জানিয়া, যৎপরোনাস্তি বিষণ্ন হইল এবং অমাত্যগণ-সমভিব্যাহারে কৃতাঞ্জলিপুটে মহর্ষি-সমবেত মহীপালদিগকে কহিল, “হে মহাশয়গণ! আপনারা কি নিমিত্ত এখানে আসিয়াছেন? আজ্ঞা করুন, কি করিতে হইবে?”
“তখন মহাতপাঃ অগস্ত্য সহাস্যবদনে কহিলেন, “হে অসুর! আমরা তোমাকে প্রভূত বিভবশালী জ্ঞান করি, এই ভূপালগণ তাদৃশ ধনী নহেন এবং আমারও নিতান্ত অর্থপ্রয়োজন হইয়াছে, – অতএব তুমি অন্যের হিংসা না করিয়া আমাদিগকে যথাশক্তি অর্থ প্ৰদান কর।”
“তখন দানবরাজ ইল্বল মহর্ষি অগস্ত্যকে অভিবাদনপূর্ব্বক কহিল, “হে মহাশয়! আমি আপনাদিগকে যাহা প্ৰদান করিতে অভিলাষ করিয়াছি, আপনি যদি তাহা বলিতে সমর্থ হয়েন, তাহা হইলে অবশ্যই ধন প্ৰদান করিব।”
“অগস্ত্য কহিলেন, “হে অসুররাজ! তুমি এই ভূপতিদিগের প্রত্যককে দশসহস্ৰ গো ও তৎসংখ্যক সুবর্ণ এবং আমাকে বিংশতি-সহস্ৰ গো, তৎসংখ্যক সুবৰ্ণ, হিরন্ময় রথ ও মনোমারুতগামী অশ্বদ্বয় প্রদান করিতে বাসনা করিয়াছ। তুমি বিলক্ষণ অনুসন্ধান করিয়া দেখ, এই সম্মুখস্থিত রথই সুবৰ্ণময়।’ অনন্তর দানবরাজ ইল্বল অগস্ত্যের বচনানুসারে অনুসন্ধান করিয়া দেখিলেন যে, যথার্থই ঐ রথ হিরন্ময়। তখন দানবরাজ সাতিশয় কাতর হইয়া তাহাদিগকে প্রভূত ধন প্রদান করিলেন এবং বিরাব ও সুরাব-নামক অশ্বদ্বয় সেই রথে যোজিত হইয়া সমুদয় ধন, মহর্ষি অগস্ত্য ও তৎসমবেত নৃপগণকে বহন করিয়া মুহূর্ত্তমধ্যে অগস্ত্যর অনুমতিক্রমে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলে, ভগবান অগস্ত্যও স্বীয় সহধর্ম্মিণী লোপামুদ্রার অভিলষিত দ্রব্য-সমুদয় প্ৰস্তুত করিলেন।
অগস্ত্যতনয় দৃঢ়স্যুর জন্মবৃত্তান্ত
“বরবর্ণিনী লোপামুদ্রা সমুদয় প্রস্তুত হইয়াছে দেখিয়া মহৰ্ষিকে কহিলেন, “হে ভগবন! আপনি আমার অভিলষিত দ্রব্য-সমুদয় আহরণ করিয়াছেন; এক্ষণে আমার গর্ভে প্রভূতবীৰ্য্যসম্পন্ন অপত্য উৎপাদন করুন।”
“অগস্ত্য কহিলেন, “হে কল্যাণি! আমি তোমার সদ্ব্যবহারে পরম পরিতুষ্ট হইয়াছি; এক্ষণে পুত্ৰ-বিষয়ক উপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। বিচার করিয়া তুমি সহস্ৰ পুত্র অভিলাষ কর অথবা সহস্রতুল্য ক্ষমতাশালী শত পুত্র, সহস্ৰ ব্যক্তিতুল্য পরাক্রমশালী দশ পুত্র বা সহস্রতেজঃ এক পুত্র তোমার অভিলষণীয়?”
“লোপামুদ্রা কহিলেন, “হে তপোধন! এক বিদ্বান সাধুপুত্র। বহুসংখ্যক অসাধুপুত্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অতএব সহস্ৰ জনের ন্যায় প্রভাবসম্পন্ন এক পুত্ৰই আমার অভিলষণীয়।”
“মহর্ষি অগস্ত্য স্বীয় সহধর্ম্মিণীর বাক্য স্বীকার করিয়া পরম শ্রদ্ধাসহকারে যথাসময়ে তাঁহার গর্ভাধান করিয়া বনে প্রস্থান করিলেন। অনন্তর ক্রমে সপ্ত সংবৎসর গর্ভের উপচয় হইতে লাগিল। পরে সপ্তম বৎসর অতীত হইলে মহাকবি দৃঢ়স্যু ভূমিষ্ঠ হইলেন। ঐ সদ্যোজাত কুমারকে অবলোকন করিলে বোধ হয় যেন শরীর প্রভাবে প্রজ্বলিত হইতেছেন ও সাঙ্গোপনিষদ বেদ জপ করিতেছেন। তেজস্বী অগস্ত্যনন্দন বাল্যকালেই পিতার আলয়ে ইধ্ন অর্থাৎ অগ্নিসন্দীপনকাষ্ঠের ভার বহন করিতেন। বলিয়া তাঁহার নাম ইধ্নবাহ হইয়াছিল। পুত্রকে তদ্রূপ দেখিয়া মহর্ষি অগস্ত্যের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না।
“তপোধনাগ্রগণ্য অগস্ত্য এইরূপে অত্যুত্তম অপত্য উৎপাদন করিলে তদীয় পিতৃলোক যথাভিলাষ পরমগতিলাভ করিলেন। সেই অবধি ঐ অগস্ত্যাশ্রম ভূমণ্ডলে সাতিশয় বিখ্যাত হইয়াছে। হে রাজন! মহর্ষি অগস্ত্য এইরূপে প্ৰহ্লাদবংশজ বাতাপিকে বিনাশ করিয়াছিলেন; এই সেই অগস্ত্য মহর্ষির পরামরমণীয় আশ্রম। ঐ পরম-পবিত্র দেবগন্ধৰ্ব্বসেবিত মন্দাকিনী বাতেরিত [বায়ুভরে আন্দোলিত] পতাকার ন্যায় নভোমণ্ডলে বিরাজিত হইতেছেন। ভাগীরথী যথানিম্নক্রমে শৃঙ্গ হইতে শৃঙ্গান্তরে নিত্য নিপতিত হইয়া পরিশেষে পন্নগবধূর [সর্পী—স্ত্রীসৰ্পসদৃশ বক্ৰগতি] ন্যায় শিলাতলে প্রবিষ্ট হইতেছেন। ইনি জননীর ন্যায় সমস্ত দক্ষিণদিক প্লাবিত করিতেছেন। এই সমুদ্রমহিষী পূর্ব্বে মহাদেবের জটা হইতে বহির্গত হইয়াছেন। হে রাজন! আপনি এই পুণ্যসলিলা স্রোতস্বতীতে স্বচ্ছন্দে অবগাহন করুন।
পরশুরাম তীর্থবৃত্তান্ত
“হে যুধিষ্ঠির! ঐ মহর্ষিগণসেবিত ভৃগুতীর্থ শোভা পাইতেছে, অবলোকন করুন। পূর্ব্বে পরশুরাম ঐ তীর্থে স্নান করিয়া কৃতবৈর দাশরথি রামকর্ত্তৃক হৃত স্বীয় তেজ পুনঃপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন, অতএব হে পাণ্ডুনন্দন! আপনি স্বীয় ভ্রাতৃগণ ও কৃষ্ণার সহিত এই তীর্থে স্নান করিয়া দুৰ্যোধনহৃত স্বীয় তেজ পুনরায় লাভ করুন।”
মহারাজ যুধিষ্ঠির স্বীয় অনুজগণ ও কৃষ্ণ-সমভিব্যাহারে ঐ তীর্থে স্নান করিয়া দেবগণ ও পিতৃগণের তর্পণ করিলেন। ঐ তীর্থে স্নান করিবামাত্র যুধিষ্ঠিরের শরীরকান্তি অধিকতর প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল এবং তিনি এককালে অরাতিকুলের অনভিবভনীয় হইয়া উঠিলেন। তখন সেই ধর্ম্মাত্মা পাণ্ডুনন্দন লোমশ মুনিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে ভগবান! কি নিমিত্ত পরশুরামের তেজ হৃত হইয়াছিল এবং কি প্রকারেই বা উহা প্ৰত্যাহৃত হইল, সবিশেষ বর্ণন করুন।”
লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! আমি মহাত্মা দাশরথি রাম ও ধীমান পরশুরামের বৃত্তান্ত কহিতেছি, শ্রবণ করুন। দেবগণাগ্রগণ্য ভগবান বিষ্ণু রাবণবধের নিমিত্ত ধরাতলে দশরথের ঔরসে জন্মপরিগ্রহ করিয়া রামনামে বিখ্যাত হইলে ভৃগুকুল-সমুৎপন্ন ঋচীকানন্দন পরশুরাম রামচন্দ্রের জীবনবৃত্তান্ত শ্রবণানন্তর তদীয় বলবিক্রম জানিবার নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া ক্ষত্ৰিয়াকুলান্তক সেই মহাদ্ধনু গ্রহণপূর্ব্বক অযোধ্যানগরে আগমন করিলেন।
“মহারাজ দশরথ পরশুরাম আপনার রাজ্যে আসিয়াছেন শুনিয়া স্বীয় পুত্র রামকে তাঁহার নিকট প্রেরণ করিলেন। পরশুরাম সমুদ্যতাস্ত্ৰ দশরথতনয় রামকে সম্মুখীন নিরীক্ষণ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে কহিলেন, “হে রাজেন্দ্র! আমি এই শরাসনদ্বারা ক্ষত্রিয়কুল উন্মূলিত করিয়াছি, যদি তোমার ক্ষমতা থাকে, তবে যত্নসহকারে ইহাতে জ্যারোপণ কর।’ দাশরথি তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে ভগবন! আপনি আমাকে অধিক্ষেপ [অবজ্ঞা—হীনবোধ] করিবেন না। আমি ক্ষত্ৰিয়াধম নহি, বিশেষতঃ ইক্ষাকুবংশীয়দিগের বাহুবীৰ্য্যই শ্লাঘার বিষয়।” পরশুরাম রামচন্দ্রের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে রাঘব! আর বৃথা বাক্যব্যয়ের আবশ্যকতা নাই, এক্ষণে ধনুগ্রহণ কর।”
“তখন দশরথসূত রামচন্দ্র রোষভরে পরশুরামের হস্ত হইতে সেই ক্ষত্রিয়কুলক্ষয়কারী দিব্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক অবলীলাক্রমে তাহাতে জ্যারোপণ করিয়া সগর্ব্বে টঙ্কারধ্বনি করিতে লাগিলেন। অশনিনির্ঘোষের ন্যায় সেই টঙ্কারধ্বনি-শ্রবণে প্রাণীগণ ত্ৰস্ত ও শশব্যস্ত হইয়া উঠিল। তখন রাম পরশুরামকে কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! জ্যারোপণ করা হইয়াছে, এক্ষণে আর কি করিতে হইবে, আদেশ করুন।” অনন্তর পরশুরাম রামকে এক শর প্রদান করিয়া কহিলেন, “এই বাণ কর্ণদেশ পৰ্য্যন্ত আকর্ষণ কর।”
“রঘুবংশাবতংস রাম পরশুরামের বাক্য-শ্রবণে কোপপ্রজ্বলিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ভার্গব! তুমি সাতিশয় দর্পপূর্ণ; কিন্তু অসমকক্ষবোধে তোমার সগর্ব্ব বাক্য শ্রবণ করিয়াও ক্ষমা করিতেছি; বিশেষতঃ তুমি পিতামহ-প্ৰসাদে ক্ষত্ৰিয়গণকে পরাজয় করিয়া সমধিক তেজস্বী হইয়াছ, এই নিমিত্তই তুমি আমাকে তিরস্কার করিতেছ। এক্ষণে আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করিতেছি, তুমি আমার শরীর নিরীক্ষণ কর।” তখন পরশুরাম দিব্যচক্ষু-প্রাপ্ত হইয়া রামের শরীরে নিরীক্ষণ করিবামাত্র দেখিলেন যে, তদীয় শরীরে সমুদয় আদিত্য, বসু, রুদ্র, সাধ্য, মরুৎ, পিতৃলোক, হুতাশন, নক্ষত্র, গ্রহ, গন্ধর্ব্ব, রাক্ষস, যক্ষ, নদী, তীর্থ, ব্ৰহ্মভূত সনাতন বালখিল্য ঋষিগণ, দেবর্ষি, সমুদ্র, পর্ব্বত, উপনিষৎ, বেদ, বিষ্টকার, অধ্বর, সচেতন, সামবেদ, ধনুর্ব্বেদ, জলদাবলি, বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ এই সকল বর্ত্তমান রহিয়াছে।
“অনন্তর ভগবান রামরূপী বিষ্ণু সেই ভার্গবদত্ত বাণ পরিত্যাগ করিবামাত্র ভূমণ্ডল ঘোরতর অশনিনিৰ্ঘোষ, টঙ্কাপাত, পাংশুবর্ণ ভূমিকম্প ও নির্ঘাতশব্দে সমাকীর্ণ হইল। তখন সেই রামপরিত্যক্ত বাণ পরশুরামকে বিহ্বল করিয়া তাহাঁর তেজ হরণ করিয়া জ্বলিতে জ্বলিতে পুনরায় রামসমীপে সমাগত হইল। পরশুরাম ক্ষণকাল পরে চেতনাপ্রাপ্ত হইয়া পুনর্জীবিতের ন্যায় গাত্ৰোত্থানাপূর্ব্বক বিষ্ণুতেজঃস্বরূপ রামের চরণে প্ৰণিপাত করিলেন এবং তাঁহার আদেশানুসারে মহেন্দ্ৰ-পর্ব্বতে গমনপূর্ব্বক ভয় ও লজ্জায় একান্ত অভিভূত হইয়া তথায় বাস করিতে লাগিলেন।
“সংবৎসর অতীত হইলে পর পিতৃগণ পরশুরামকে হৃততেজাঃ মদশূন্য ও নিতান্ত দুঃখিত দেখিয়া কহিলেন, “হে বৎস! রামচন্দ্ৰ স্বয়ং বিষ্ণু; তিনি ত্ৰিভুবনের পূজ্য ও মান্য; তাঁহার সমীপে প্ৰগলভ্যতা প্রকাশ করা তোমার নিতান্ত অনুচিত হইয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি পরমপবিত্ৰ বধূসর নামক নদীতে গমন কর; তথায় স্নান করিলে পুনরায় স্বকীয় তেজ-প্ৰাপ্ত হইবে। ঐ স্থানেই দীপ্তোদনামে তীর্থ আছে। তোমার প্রপিতামহ ভৃগু সত্যযুগে তথায় অত্যুৎকৃষ্ট তপস্যা করিয়াছিলেন।”
“হে মহারাজ! পরশুরাম পিতৃলোকের বচনানুসারে সেই তীর্থে গমনপূর্ব্বক স্নান করিয়া পুনরায় স্বীয় তেজ-প্ৰাপ্ত হইলেন। এইরূপে অক্লিষ্টকর্ম্মা পরশুরাম পূর্ব্বে ভগবান বিষ্ণুস্বরূপ রামের নিকট প্ৰগলভ্যতা প্রকাশ করিয়া আপনার তেজোরাশি বিলুপ্ত করিয়াছিলেন।”