এত শুনি কহেন ধর্ম্ম, চাহিয়া মুনি।
কিরূপে কোথায় জন্মে দোঁহে কহ শুনি।।
মার্কণ্ডেয় কন রাজা শুন জন্মকথা।
একদিন দিতিদেবী কশ্যপ বনিতা।।
পুত্রকাম্য করি গেল স্বামীর গোচর।
সায়ংসন্ধ্যা করিবারে যায় মুনিবর।।
দিতি বলে, পশ্চাৎ করিবে সন্ধ্যা তুমি।
আজ্ঞা কর, পুত্রকামা আইলাম আমি।।
মুনি বলে হৈল এই রাক্ষসী সময়।
ইথে পুত্র জন্ম হৈলে, কভু ভাল নয়।।
দিতি বলে, মুনিরাজ নহিলে না হয়।
মানস করহ পূর্ণ, জন্মাহ তনয়।।
হেনমতে এই কথা কহে যদি দিতি।
পুত্রবর দিয়া মুনি কহে দুঃখমতি।।
মুনি বলে, না শুনিলে আমার বচন।
হইবে অবশ্য তব যুগল নন্দন।।
মহাবল পরাক্রম আমার ঔরসে।
কিন্তু তারা দুষ্ট হবে সময়ের দোষে।।
ধর্ম্মপথ বিরোধি, জিনিবে ত্রিভুবন।
দেখিয়া দেবের দুঃখ প্রভু নারায়ণ।।
অবতরি নিজ হস্তে বধিবে দোঁহাকে।
তুমিহ পরম দুঃখ পাবে পুত্রশোকে।।
এতেক বিলল মুনি ভবিষ্য উত্তর।
নিজালয়ে গেল দিতি দুঃখিত অন্তর।।
মুনির ঔরসে আর দিতির গর্ভেতে।
জয়-বিজয়ের জন্ম হৈল হেনমতে।।
যথাকালে প্রসবিল দেবী দাক্ষায়ণী।
প্রত্যক্ষ হইল যত মুনির কাহিনী।।
জন্মকালে হৈল তবে বিবিধ উৎপাত।
ধরণী কাঁপিল শব্দে সঘনে নির্ঘাত।।
প্রাতঃকাল হৈতে যেন বাড়ে দিনকর।
জন্মমাত্র হৈল দোঁহে মহাবলধর।।
হিরণ্যাক্ষ হিরণ্যকশিপু দুই জন।
ধর্ম্মপথ বিরোধিতে করিলেক মন।।
যজ্ঞ নষ্ট করিয়া হিংসিল দেবগণে।
ইন্দ্রপদ লইয়া বসিল সিংহাসনে।।
একত্র হইয়া তবে যত দেবগণে।
নিজ দুঃখ জানাইল বিধাতার স্থানে।।
অতি দুঃখ পান ব্রহ্মা দেব-দুঃখ শুনি।
আশ্বাসিয়া কহিলেন তবে পদ্মযোনি।।
ভয় না করিয়া সবে যাহ যথাস্থানে।
পূর্ব্বেতে বিচার আমি করিয়াছি মনে।।
অখিল জীবের গতি দেব নারায়ণ।
তাঁহা বিনা নিস্তারিতে নাহি কোন জন।।
আমার বচনে ঘরে যাহ সর্ব্ব জন।
শুনিয়া আনন্দে সবে করিল গমন।।
অপূর্ব্ব শুনহ তবে রাজা যুধিষ্ঠির।
যুদ্ধ হেতু দৈত্যপতি হইল অস্থির।।
সুরাসুর সবে জিনে যত ত্রিভুবনে।
হেন জন নাহি, যুদ্ধ কর তার সনে।।
যুদ্ধ বিনা থাকিতে না পারে দৈত্যপতি।
মল্লযুদ্ধ করে হীনবলের সংহতি।।
হিরণ্যকশিপু ভায়ে রাখি সিংহাসনে।
আপনি চলিল দৈত্য যুদ্ধ অন্বেষণে।।
মহাপরাক্রমে ধায় গদা লয়ে হাতে।
দৈবযোগে নারদ সহিত দেখা পথে।।
মুনি দেখি জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।
কার সনে যুদ্ধ করি কহ মহাশয়।।
নারদ বলেন, তব সম যোদ্ধা হরি।
দৈত্য বলে, তারে বল কোথা চেষ্টা করি।।
কহ মুনি, কোথা তার পাব দরশন।
তোমার প্রসাদে তবে সুখে করি রণ।।
নারদ বলেন, তুমি বিক্রমে বিশাল।
সেই ভয়ে লুকাইয়া আছেন পাতাল।।
ধরিয়া বরাহমূর্ত্তি আছে দুঃখমনে।
শীঘ্র গিয়া তথা, যুদ্ধ কর তাঁর সনে।।
শুনিয়া দৈত্যের পতি, বিক্রমে বিশাল।
মুনিরাজে প্রণমিয়া প্রবেশে পাতাল।।
তথায় দেখিল পরিপূর্ণ সব জল।
না পায় হরির দেখা চিন্তে মহাবল।।
জলেতে গদার বাড়ি মহাক্রোধে মারে।
কহ হরি কোথা গেলে, ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।।
হেনকালে কৃপাসিন্ধু প্রভু নারায়ণ।
ভক্তের উদ্ধার হেতু দেন দরশন।।
কতদূরে গর্জ্জি দেব করে মহাশব্দ।
শুনিয়া দৈত্যের পতি হৈল মহাস্তব্ধ।।
মহাক্রোধে ধায় বীর গদা লয়ে হাতে।
দৈবাৎ বরাহ সহ দেখা হৈল পথে।।
হিরণ্যাক্ষ বলে, দেখ তোমার গর্জ্জন।
শুনিয়া কম্পিত তিন ভুবনের জন।।
নহে বা এমন দর্প হেথা কেবা করে।
নিশ্চয় মরিবে আজি আমার প্রহারে।।
বাক্যযুদ্ধ হৈল আগে, পরে গালাগালি।
পশ্চাতে করিল যুদ্ধ দুই মহাবলী।।
বিশেষ প্রকারে যুদ্ধ হৈল বহুতর।
বিস্তারিয়া সেই কথা কহিতে বিস্তর।।
তবে হরি বধিলেন দৈত্যেরে পরাণে।
কামরূপী বরাহ রহেন সেই স্থানে।।
হেথায় বিলম্ব হেরি যত পুরজন।
চিন্তিত হইল সবে, না বুঝে কারণ।।
কনিষ্ঠ আছিল তার অমরের রিপু।
সিংহাসনে মহারাজ হিরণ্যকশিপু।।
ভ্রাতার বিলম্ব দেখি চিন্তাকুল মন।
হেনকালে উপনীত ব্রহ্মার নন্দন।।
নারদে দেখিয়া দৈত্য আনন্দিত মনে।
হাতে ধরি বসাইল রত্ন-সিংহাসনে।।
মুনিরাজে জিজ্ঞাসিল ভ্রাতার বারতা।
নারদ কহিল, রাজা শুন তার কথা।।
যুদ্ধ হেতু তব ভ্রাতা ভ্রমি বহুকাল।
যোগ্য না দেখিয়া পাছে প্রবেশে পাতাল।।
পূর্ব্বে ক্ষিতি উদ্ধরিতে দেবদেব হরি।
দেবকার্য্য সাধিতে বরাহরূপ ধরি।।
দৈবযোগে তাঁর সহ দেখা রসাতলে।
দারুণ হইল যুদ্ধ দুই মহাবলে।।
তাঁর ঠাঁই হিরণ্যাক্ষ হইল নিধন।
এতদিন না জান এ সব বিবরণ।।
শুনিয়া দৈত্যের পতি পায় বড় শোক।
এদিকে নারদ চলিলেন ব্রহ্মলোক।।
দৈত্যপতি বলে, মোর খণ্ডিল বিস্ময়।
বিষ্ণু সে আমার শত্রু জানিনু নিশ্চয়।।
তাহা বিনা না হিংসিব কভু অন্য জনে।
পাইব তাহার দেখা ধর্ম্মের হিংসনে।।
এতেক বিচারি দৈত্য করি বড় ক্রোধ।
যথা ধর্ম্ম, যথা যজ্ঞ, করয়ে বিরোধ।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে সবে পায় ভয়।
নিস্তেজ হইল সবে গণিয়া প্রলয়।।
কত দিনান্তরে রাজা শুন বিবরণ।
প্রহ্লাদ নামেতে তার জন্মিল নন্দন।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।