অষ্টনবতিতম অধ্যায়
শান্তনুকে গঙ্গার পতিত্বে বরণ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, সেই হৃদয়ানন্দদায়িনী প্রমদা রাজার সস্মিত [মনোজ্ঞ] মৃদুমধুর বাক্য শ্রবণ করিয়া এবং বসুগণের নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়ছিলেন,তাহা স্মরণ করিয়া কহিলেন, ”মহারাজ! আমি আপনার মহিষী হইয়া চিত্তানুবর্ত্তন করিব, কিন্তু যে সমস্ত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিব, তাহা ভালই হউক বা মন্দই হউক, তদ্বিষয়ে আমাকে বারণ করিতে পারিবেন না এবং তন্নিমিত্ত আমার প্রতি কোন অপ্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিতে পারিবেন না। যদি এইরূপ ব্যবহারে কালযাপন করিতে সম্মত হয়েন, তবে আপনার সহবাস করিব; মৎকৃত কার্য্যের ব্যাঘাত জন্মাইলে অথবা আপনি তন্নিমিত্ত বিরক্ত হইয়া অপ্রিয় কথা বলিলে তৎক্ষণাৎ আপনাকে পরিত্যাগ করিব সন্দেহ নাই।” রাজা এই নিয়মে সম্মত ও অঙ্গীকৃত হইলেন। গঙ্গা শান্তনুকে এইরূপে বচনবদ্ধ করিয়া পরম পরিতুষ্টা হইলেন, মহিপতীও সেই আলোকসামান্য-সৌন্দর্য্যসম্পন্ন স্ত্রীরত্নলাভে যৎপরোনাস্তি প্রীত হইয়া পূর্ব্বকৃত নিয়মানুসারে কালযাপন করিতে লাগিলেন এবং নানাবিধ উপচার দ্বারা নিরন্তর তাঁহার সন্তোষ উপাদানে যত্নবান হইলেন। ত্রিপথগামিনী গঙ্গা রমনীয় কলেরব-ধারণপূর্ব্বক পরম ভাগ্যবান্ শান্তনু রাজার মহিষী হইয়া মনোহর হাব-ভাব-বিলাস ও সম্ভোগাদি দ্বারা নরেন্দ্রের মন মোহিত করিলেন। ফলতঃ রাজা রাজমহিষীর সদ্গুণে এমন আকৃষ্ট হইয়ছিলেন যে, ক্ষণকালও তাঁহার অদর্শন-ক্লেশ সহ্য করিতে পারিতেন না। রাজ্ঞীর সম্ভোগসুখে কত কত সংবৎসর,ঋতু ও মাসাদি মুহুর্ত্তবৎ অতীত হইত, তিনি কিছুমাত্র জানিতে পারিতেন না।
এইরূপে কিয়ৎকাল অতীত হইলে রাজমহিষী ক্রমে ক্রমে অমর-সদৃশ আটটি পুৎত্র প্রসব করিয়ছিলেন। পুৎত্র ভূমিষ্ট হইবামাত্র তিনি তৎক্ষণাৎ তাহদিগকে স্রোতে নিক্ষিপ্ত করিতেন; তৎকালে রাজাকে এই বলিয়া আশ্বাস প্রদান করিতেন যে, ”আমি আপনাকে প্রসন্ন করিব।” রাজা তদ্দর্শনে সাতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু কি জানি, পাছে গঙ্গা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া যান, এই ভয়ে ভীত হইয়া বাঙ্নিষ্পত্তি করিতে পারিতেন না।
অনন্তর পুৎত্র ভূমিষ্ট হইলে মহিষী হাসিতে লাগিলেন। রাজা পুৎত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়াছিলেন, অতএব এবার পুৎত্রটি জীবিত থাকে, এই আশয়ে পত্নীকে কহিলেন, ”পুৎত্র বিনষ্ট করিও না; তুমি কে? কি নিমিত্ত আত্মজদিগের প্রাণবধ করিতেছ। হে পুৎত্রঘাতিনি ! পুৎত্রহিংসা অপেক্ষা আর গুরুতর পাপ আর কিছুই নাই; শস্ত্রে কথিত আছে, উহা মহাপাতক, অতএব এই গর্হিত নিষ্ঠুরাচরণে ক্ষান্ত হও।”
তখন সেই স্ত্রী কহিলেন, ”হে পুৎত্রকাম! আমি তোমার পুৎত্র বিনষ্ট করিব না; এক্ষণে পূর্ব্বকৃত নিয়ম স্মরণ কর, আমি অদ্যাবধি তোমার সহবাস পরিত্যাগ করিলাম। আমি মহর্ষি জহ্নুর কন্যা, আমার নাম গঙ্গা। ঋষিগণ সর্ব্বদাই আমার সেবা করিয়া থাকেন। কেবল দেবকার্য্য-সাধনার্থ তোমার ভার্য্যা হইয়াছিলাম। আর এই সমস্ত সন্তানগুলিকে সামান্য মনুয্য জ্ঞান করিও না; ইহারা মহাতেজাঃ বসুগণ, মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তোমা ভিন্ন পৃথিবীতে আর কোন পুরুষ ইহাদিগের পিতা হইবার যোগ্য হইতে পারে না এবং আমা ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীও ইহাদিগের জননী হইবার যোগ্য নহে; এই নিমিত্ত আমি মানুষী হইয়া ইহাদিগকে গর্ভে ধারণ করিয়াছিলাম; আর তুমিও ইঁহাদিগের জনক হইয়া অক্ষয় লোকসকল জয় করিয়াছ । আমি ই্হাদের নিকট অঙ্গীকার করিয়াছিলাম যে, আমার গর্ভে পুৎত্র জন্মিবামাত্র আমি সেই পুৎত্রকে মনুষ্যলোক হইতে মুক্ত করিব। ইঁহারা মহাত্মা বশিষ্ঠের অভিসম্পাত হইতে মুক্ত হইলেন এবং আমিও প্রতিজ্ঞাসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইলাম; অতএব এক্ষণে স্বস্থানে প্রস্থান করি, আপনার মঙ্গল হউক। মদ্গর্ভজাত এই পুৎত্রতিকে গঙ্গাদত্ত বলিয়া গ্রহণ ও পালন করুন। আমি এইরূপে বসুগণের শাপমুক্তির জন্য তোমার সন্নিধানে বাস করিয়াছিলাম।”