৯৮তম অধ্যায়
নারদমাতলির পাতালভ্রমণ
“নারদ কহিলেন, “এই নাগলোকের মধ্যস্থলে যে দেবদানবসেবিত পুর দেখিতেছি, ইহার নাম পাতাল। যেসকল জঙ্গম [গতিশীল প্রাণী] জলবেগপ্রভাবে ইহার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়, তাহারা সেই সময় ভয়াপীড়িত হইয়া ঘোরতর নিনাদ করিতে থাকে। এই স্থানে সলিলভোজী হুতাশন [জলমাত্রপায়ী বাড়বানল] অতিযত্নে আত্মসংবরণ [ধৈর্য্যধারণ করিয়া-মৰ্যাদা অতিক্রম না করিয়া] পূর্ব্বক দেদীপ্যমান রহিয়াছেন। দেবগণ শত্রুবিনাশানন্তর অমৃত পান করিয়া এই স্থানে উহাকে রাখিয়াছেন; আর এই স্থান হইতে চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধি দৃষ্ট হইয়া থাকে। পাত শব্দে পতন ও অলং শব্দে অত্যন্ত, এই স্থানে হয়গ্ৰীবরূপী [অশ্বের গ্ৰীবাযুক্ত] বিষ্ণু প্রতিপর্ব্বে [অষ্টমী, চতুর্দশী, অমাবষ্যা, পূর্ণিমা, সংক্রান্তি] বাক্যদ্বারা বেদাধ্যায়ীদিগের বেদধ্বনি পরিবর্দ্ধিত করিবার নিমিত্ত আবির্ভূত হইলে চন্দ্রপ্রভৃতি জলমূর্ত্তিসকল চন্দ্ৰকান্তমণির [চন্দ্ৰকান্তমণি হইতে জল (অমৃত) ক্ষরিত হয়] ন্যায় দ্রবীভূত হইয়া অলং অর্থাৎ পৰ্য্যাপ্তরূপে নিপতিত হয়; এই নিমিত্ত এই স্থানের নাম পাতাল হইয়াছে।
“ ‘জগতের হিতকারী ঐরাবত গজ এই স্থান হইতে জলগ্ৰহণ করিয়া মেঘে প্ৰদান করে। ইন্দ্ৰ সেই জল সর্ব্বত্র বর্ষণ করেন। এই স্থানে নানাবিধ তিমিনিকর [বৃহৎ তিমিমৎস্যসমূহ] চন্দ্ৰকিরণ পান করিয়া জলমধ্যে বাস করে। এই স্থানে প্রাণীগণ প্রত্যহ দিবাভাগে দিনকারকিরণে দগ্ধ হইয়া মৃত হয়, পরে রজনীযোগে চন্দ্ৰমা সমুদিত হইয়া রশ্মিরূপ বাহুদ্বারা অমৃত গ্রহণপূর্ব্বক তাহাদিগের উপর নিক্ষেপ করিয়া তাহাদিগকে পুনরায় জীবিত করেন। কালনিপীড়িত বাসব [ইন্দ্র] নিজিত অসুরগণ এই স্থানে বদ্ধ ও ধর্ম্মানুষ্ঠানে নিরত হইয়া বাস করিতেছে। এই স্থানে সর্ব্বভূতেশ্বর মহাদেব সর্ব্বলোকের শ্ৰেয়ঃসাধনের নিমিত্ত তপস্যা করিয়াছিলেন। এই স্থানে বেদধ্যয়ন নিপুণ গোব্রতপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বৰ্গজয় করিয়া বাস করিতেছেন। যাহারা যথাতথা শয়ন, অন্যপ্রদত্ত অন্নভোজন ও অন্যপ্রদত্ত বসন পরিধান করেন, তাঁহারাই গোব্ৰতাবলম্বী।
“ ‘হে মাতলে! এই স্থানে সুপ্রতীক[দিগ্গজ]বংশসম্ভূত ঐরাক পুণ্ডরীক, বামন, কুমুদ ও অঞ্জন—এইসমুদয় বারণপ্রধান আছেন [শ্রেষ্ঠ গজ]; এ স্থলে যদি কেহ তোমার মনোনীত পাত্র থাকে, বল, আমি তাঁহাকে অতিযত্নে তোমার কন্যার নিমিত্ত বরণ করিব। এই যে জলমধ্যে অণ্ডটি দেদীপ্যমান রহিয়াছে, এই প্রথমজাত জীবগণের জন্মাবধি এই স্থানে সমভাবেই আছে; অদ্যাপি স্ফুটিত [*ফোটে না বা চলিয়া অন্যত্র যায় না] বা চলিত [*] হইল না। আমি কাহারও মুখে এরূপ জন্ম বা স্বভাবের বিষয় শ্রবণ করি নাই; কেহই ইহার জনকজননীর বিষয় অবগত নহেন। প্ৰলয়কালে ইহা হইতে অতি বিপুল হুতাশন সমুত্থিত হইয়া সচরাচর ত্ৰৈলোক্য দগ্ধ করিবে।”
“মাতলি নারদের বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, “মহার্ষে। এখানে কেহই আমার মনোনীত হইলেন না, চলুন, অন্য কোন স্থানে গমন করি।’ ”