৯৭তম অধ্যায়
দ্রোণসহ যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্নের পরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! এই রূপে সেই লোমহর্ষণ তুমুল সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে পাণ্ডবেরা সেই ত্রিধাভূত কৌরব সৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ভীমসেন মহাবাহু জলসন্ধকে ও অসংখ্য সৈন্য সমবেত রাজা যুধিষ্ঠির কৃতবর্ম্মাকে এবং সূৰ্য্যসদৃশ প্রতাপশালী মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন শরনিকর বর্ষণ করিয়া দ্ৰোণকে আক্রমণ করিলেন। তখন যুদ্ধ তৎপর ধনুর্ধারী ক্রোধপরায়ণ কৌরব ও পাণ্ডবদিগের পরস্পর ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। হে মহারাজ! এইরূপে সেই অসংখ্য জনসংক্ষয় সময়ে সেনাগণ নির্ভীকচিত্তে যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে বলবীৰ্য্য সম্পন্ন দ্রোণাচার্য্য পরাক্রান্ত পাঞ্চাল পুত্রের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া অসংখ্য শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। মহাবীর দ্রোণ ও মহাবল পরাক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন উভয়পক্ষীয় অসংখ্য সৈন্যগণের মস্তক ছেদন পূর্ব্বক ইতস্তত নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলে বোধ হইতে লাগিল যে, সমরাঙ্গনের চতুর্দ্দিকে পুণ্ডরীক বন সমুৎপন্ন হইয়াছে। ঐ সময় সংগ্রাম স্থলে চতুর্দ্দিকে বীরগণের বস্ত্র, আভরণ, শস্ত্র, ধ্বজ, বৰ্ম্ম ও আয়ুধ সকল বিকীর্ণ হইল। শূরগণের শোণিতাক্ত সুবর্ণ নির্মিত তনুত্রাণ সকল সৌদামিনী সম্বলিত জলপটলের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল। তখন অন্যান্য মহারথগণ তাল প্রমাণ শরাসন আকর্ষণ করিয়া শর দ্বারা হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণকে নিপাতিত করিতে আরম্ভ করিলেন। অসংখ্য বীরগণের মস্তক অসি, চৰ্ম্ম, চাপ ও কবচসকল ইতস্তত বিকীর্ণ হইতে লাগিল।
হে মহারাজ! ঐ সময় সমরক্ষেত্রে বহুসংখ্য কবন্ধ সমুত্থিত হইল। মাংস লোলুপ গৃধ্র, কঙ্ক, বল, শ্যেন, বায়স ও শৃগাল সমুদায় হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণের মাংস ভোজন, শোণিত পান, কেশচ্ছেদন, মজ্জা ভক্ষণ এবং শরীর ও মস্তক সমুদায় আকর্ষণ করিতে লাগিল। তখন সংগ্রাম নিপুণ, কৃতাস্ত্র, রণদীক্ষিত যোধগণ বিজয়াকাঙ্ক্ষী হইয়া তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। সৈনিক পুরুষেরা নির্ভয়ে অসিমার্গে বিচরণ এবং ক্রোধভরে ঋষ্টি, শক্তি, প্রাস, শূল, তোমর, প্রাস, শূল গদা ও পরিঘ প্রভৃতি আয়ুধ এবং ভুজ দ্বারা পরস্পরকে সংহার করিতে লাগিল। রথিগণ রথিদিগের সহিত, অশ্বারোহিগণ অশ্বারোহীদিগের সহিত, মাতঙ্গগণ মাতঙ্গদিগের সহিত ও পদাতিগণ পদাতিদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইল। অসংখ্য মত্তমাতঙ্গ উম্মত্তের ন্যায় চীৎকার করিয়া পরস্পরের প্রতি আঘাত ও পরস্পরকে সংহার করিতে আরম্ভ করিল।
হে মহারাজ! সেই ঘোরতর সংগ্রাম সময়ে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্য্যের অশ্বগণের সহিত আপনার অশ্ব সমুদায় মিলিত করিলেন। বায়ুবেগশালী পারাবতসবর্ণ ও রক্তবর্ণ অশ্বগণ একত্র মিলিত হইয়া বিদ্যুৎ সম্বলিত মেঘের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তখন অরাতি নিপাতন মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, দ্রোণাচাৰ্য্যকে সমীপস্থ দেখিয়া দুষ্কর কর্ম্ম নিৰ্বাহ করিবার মানসে কার্ম্মুক পরিত্যাগ পূর্ব্বক অসি চৰ্ম্ম গ্রহণ করিলেন এবং রথ দণ্ড অবলম্বন পূর্ব্বক দ্রোণের রথে গমন করিয়া কখন অশ্বগণের উপরে, কখন অশ্বগণের পশ্চাদ্ভাগে ও কখন যুগমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন খড়্গহস্তে দ্রোণের রক্তবর্ণ অশ্বগণের উপর বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলে আচার্য্য তাঁহার কিছুমাত্র রন্ধ অবলোকনে সমর্থ হইলেন না। শ্যেনপক্ষী আমিষ গ্ৰহণার্থ অরণ্যে যেরূপ ভ্রমণ করে, মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণকে বিনষ্ট করিবার নিমিত্ত রণক্ষেত্রে সেইরূপ বিচরণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বীরাগ্রগণ্য দ্রোণাচাৰ্য্য শত বাণে ধৃষ্টদ্যুম্নের চর্ম্ম, দশ শরে অসি, চতুঃষষ্টি শরে অশ্ব সমুদায় এবং দুই ভল্লে তাঁহার ধ্বজ, ছত্র, পৃষ্ঠরক্ষক ও সারথিকে ছেদন পূর্ব্বক শরাসন আকর্ণ আকর্ষণ করিয়া তাঁহার উপর অশনি সদৃশ জীবিতান্তক বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবল সাত্যকি তদ্দর্শনে অবিলম্বে চতুর্দ্দশ তীক্ষ্ণ বাণ নিক্ষেপ পূর্ব্বক সেই দ্রোণ বিমুক্ত শরছেদন করিয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে সিংহ মুখে নিপতিত মৃগের ন্যায় দ্রোণ হইতে রক্ষা করিলেন। মহাবীর দ্রোণাচার্য্য সেই মহারণে সাত্যকিকে ধৃষ্টদ্যুম্নের রক্ষক অবলোকন করিয়া সত্বরে তাঁহার উপর ষড়্বিংশতি শর পরিত্যাগ পূর্ব্বক সৃঞ্জয়গণকে সংহার করিতে লাগিলেন। মহাবীর সাত্যকি তদ্দর্শনে ক্রোধান্বিত হইয়া দ্রোণের বক্ষস্থলে ষড়্বিংশতি শর নিক্ষেপ করিলেন। তখন বিজয়াভিলাষী পাঞ্চাল দেশীয় রথিগণ সাত্যকিকে দ্রোণাচার্য্যের অভিমুখীন দেখিয়া সত্বরে ধৃষ্টদ্যুম্নকে সমর হইতে অপসারিত করিলেন।