জন্মেজয় বলে, মুনি কহ অতঃপর।
কোন কর্ম্ম করিলেন পঞ্চ সহোদর।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
আশ্রমেতে বাসিলেন ভাই পঞ্চজন।।
সমাপ্ত করিয়া কর্ম্ম নিত্য নিয়মিত।
ভোজনান্তে বসিলেন সকলে দুঃখিত।।
হেনকালে দেখ তথা দৈবের ঘটন।
মার্কণ্ডেয় মুনি করিলেন আগমন।।
মহাতেজোবন্ত যেন দীপ্ত হুতাশন।
দেখিয়া সম্ভ্রমে উঠিলেন পঞ্চ জন।।
আগুসারি কত দূরে গিয়া পঞ্চ জনে।
প্রাণিপাত করিলেন মুনির চরণে।।
আশীর্ব্বাদ করিলেন মার্কণ্ডেয় মুনি।
আর সবে প্রণমিল লোটায়ে ধরণী।।
সেইমত সম্ভাষেন ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী।
বসাইয়া মুনিরাজে মহা কুতূহলী।।
আনিয়া সুগন্ধি জল ধর্ম্মের নন্দন।
আপনি করেন ধৌত মুনির চরণ।।
পাদ্য অর্ঘ্য আদি দিয়া পূজে বিধিমতে।
সান্ত্বাইয়া তাঁরে লাগিলৈন জিজ্ঞাসিতে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, করি নিবেদন।
কহ শুনি, এখানে কি হেতু আগমন।।
মুনি বলে, ইচ্ছা হৈল তোমা দরশনে।
এই হেতু মম আগমন কাম্যবনে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, ভাগ্য ছিল যে আমার।
সেই হেতু নিজে প্রভু কৈলে আগুসার।।
এইরূপে নানাবিধ কথোপকথনে।
বসিলেন মহানন্দে সবে যোগ্য স্থানে।।
মহা অভিমানে ক্ষুব্ধ রাজা যুধিষ্ঠির।
বিরস বদনে বসিলেন নম্রশির।।
দেখিয়া মুনির মনে জন্মিল বিস্ময়।
সম্ভ্রমে জিজ্ঞাসে, কহ ধর্ম্মের তনয়।।
অভিপ্রায়ে বুঝি তব চিত্ত উচাটন।
মলিন বদন দেখি নিরানন্দ মন।।
বহু দুঃখ পাইয়াছ, অল্প আছে শেষ।
অতঃপর অবিলম্বে পাবে রাজ্য দেশ।।
কত শত কষ্ট সহিয়াছ নিজ অঙ্গে।
তথাপি থাকিতে নিত্য কথার প্রসঙ্গে।।
পাপরূপ চিন্তা হয়, বহু দোষ ধরে।
সুবুদ্ধি পণ্ডিত জানে মতি লোপ করে।।
বহু দুঃখে চিন্তা নাহি কর সে কারণে।
তাহা বুঝাইব কত তোমা হেন জনে।।
বহুদিন অন্তে আসি তব দরশনে।
তোমায় দুঃখিত হেরি দুঃখ পাই মনে।।
রাজা বলে, কিবা কহ মোরে মুনিবর।
আসাম সম দুঃখী নাহি ত্রৈলোক্য ভিতর।।
না হইল, না হইবে, আমার সমান।
উত্তম মধ্যমাধ্যমে দেখহ প্রমাণ।।
বড় বংশে জন্মিলাম পূর্ব্বভাগ্য ফলে।
পিতৃহীনে বিধি দুঃখ দিল অল্পকালে।।
পরান্নে বঞ্চিনু কাল পরের আলয়।
না জানিনু সুখ দুঃখ অজ্ঞান সময়।।
ছল করি যেই কর্ম্ম কৈল দুষ্টগণে।
পাইনু যতেক দুঃখ, জানহ আপনে।।
সে দুঃখ ভুঞ্জিয়া যেই তুলিলাম মাথা।
এমন সংযোগ আনি করিল বিধাতা।।
ছলেতে লইল দুষ্ট রাজ্য অধিকার।
ভ্রাতৃ পত্নীসহ হৈল বৃক্ষতলা সার।।
রাজপুত্র হতভাগ্য মোরা পঞ্চ জনে।
চিরকাল দুঃখে দুঃখে বঞ্চিনু কাননে।।
আমা সবাকার দুঃখ নাহি করি মনে।
ভুঞ্জিব কর্ম্মের ফল বিধির ঘটনে।।
রাজত্নী হয়ে কৃষ্ণা সমান দুঃখিতা।
মহারণ্যে ভ্রমে যেন সামান্য বনিতা।।
নানা সুখে বঞ্চে পূর্ব্বে পিতার আগারে।
এবে দুঃখ ভোগ করে আসি মম ঘরে।।
নারী মধ্যে হেন আর নাহি সুশিক্ষিতা।
দান ধর্ম্ম শিল্পকর্ম করণে দীক্ষিতা।।
যেন রূপ তেন গুণ একই সমান।
কতবার মহাকষ্টে কৈল পরিত্রাণ।।
নিজ দুঃখ হেরি সকাতন মন।।
বিশেষ শুনহ মুনি আজিকার কথা।
শূন্যালয় দেখিয়া আইল জয়দ্রথা।।
রন্ধনে আছিল কৃষ্ণা দেখি শূন্যঘরে।
হরিয়া লইতেছিল হস্তিনা-নগরে।।
পথে হেরি বাহুড়িল পঞ্চ সহোদর।
চক্ষুর নিমিষে তবে ধরে বৃকোদর।।
ধরিয়া তাহার চুলে করিল লাঞ্ছনা।
পরাণ রাখিল মাত্র শুনি মম মানা।।
কেবল তোমার মুনি চরণ-প্রসাদে।
নিমিষেতে পরিত্রাণ হৈনু অপ্রমাদে।।
এইমাত্র আশ্রমেতে আসি পঞ্চ জনে।
সে কারণে বসে আছি নিরানন্দ মনে।।
সহনে না যায় মুনি রমণী-লাঞ্ছনা।
ইহা হেতু মৃত্যু শ্রেয়ঃ বিবেচনা।।
আজন্ম পাইনু দুঃখ, নাহি পরিমাণ।
না হয়, না হবে দুঃখী আমার সমান।।
যুধিষ্ঠির নৃপতির হেন বাক্য শুনি।
ঈষৎ হাসিয়া তবে কহে মহামুনি।।
কহিলে যতেক কথা ধর্ম্মের নন্দন।
দুঃখ হেন বলি, নাহি লয় মম মন।।
কি দুঃখ তোমার রাজা অরণ্য ভিতর।
ইন্দ্র চন্দ্র তুল্য সঙ্গে চারি সহোদর।।
বিশেষ সংহতি যার যাজ্ঞসেনী নারী।
মহিমা বর্ণিতে যার আমি নাহি পারি।।
এতেক ব্রাহ্মণ নিত্য করাও ভোজন।
যদি তুমি বনবাসী, গৃহী কোন জন।।
দয়া সত্য ক্ষমা শান্তি নিত্য দান ধর্ম্ম।
পৃথিবী ভরিয়া রাজা তোমার সুকর্ম্ম।।
নিশ্চয় কহিনু এই লয় মম মন।
বসুমতীপতি যোগ্য তুমি সে রাজন।।
অল্পদিনে দেখ রাজা কৌরবের অন্ত।
কহিনু তোমারে রাজা ভবিষ্য বৃত্তান্ত।।
আর যে কহিলে তুমি দুষ্ট জয়দ্রথে।
দ্রৌপদী লইতেছিল হস্তিনার পথে।।
নারীতে এতেক কষ্ট, কেহ নাহি পায়।
কিছু দুঃখ নাহি মনে আমার তাহায়।।
দ্রৌপদী হইতে শত গুণেতে দুঃখিতা।
লক্ষ্মীরূপা জনকনন্দিনী নাম সীতা।।
অনাদি পুরুষ যাঁর পতি নারায়ণ।
হরিয়া লইল তাঁরে লঙ্কার রাবণ।।
দশ মাস ছিল বন্দী অশোক কাননে।
অবিরত প্রহার করিত চেড়ীগণে।।
তবে রাম মারি সব রক্ষ দুরাচার।
মহাক্লেশে করিলেন সীতার উদ্ধার।।
যতেক দুঃখের কথা বর্ণনে না যায়।
চতুর্দ্দশ বর্ষ ভ্রমি বনে মহাক্লেশে।
জটা বল্ক পরিধান তপস্বীর বেশে।।
দশ মাস মহাকষ্ট রামের বিচ্ছেদ।
কি দুঃখে কৃষ্ণার রাজা, কেন কর খেদ।।
মার্কণ্ডেয়-মুখে এত শুনিয়া বচন।
জিজ্ঞাসা করেন তবে ধর্ম্মের নন্দন।।
নিবেদন করি মুনি, কর অবধান।
শুনিবারে ইচ্ছা বড় ইহার বিধান।।
কেন জন্ম নিল লক্ষ্মী দেব নারায়ণ।
কি মতে তাঁহার সীতা হরিল রাবণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।