৯৬তম অধ্যায়
বীরগণের পরস্পর যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এই সময় কৌরব ও পাণ্ডবগণের যে আশ্চৰ্য্য যুদ্ধ হইয়াছিল তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। মহা বাহু পাণ্ডবগণ ব্যূহমুখে দ্রোণাচাৰ্য্যকে আক্রমণ করিয়া তাঁহার সৈন্যগণকে ভেদ করিবার মানসে ঘোরতর সংগ্রাম করিতে আরম্ভ করিলেন। দ্রোণাচার্য্যও যশোলাভের আশরে আপনার ব্যূহ রক্ষা করিয়া স্বীয় সৈন্য সমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের সহিত তুমুল যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন আপনার পুত্রগণের হিতৈষী অবন্তি দেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ ক্রোধান্বিতচিত্তে দশ বাণে বিরাটরাজকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর বিরাটরাজও সেই অনুচর বেষ্টিত মহাবল পরাক্রান্ত বীরদ্বয়ের বাণে আহত হইয়া তাঁহাদের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। অরণ্য মধ্যে মদস্রাবী মত্তমাতঙ্গদ্বয়ের সহিত কেশরীর যেরূপ যুদ্ধ হয়, উক্ত বীরদ্বয়ের সহিত বিরাট রাজের সেইরূপ অতি ভীষণ সংগ্রাম আরম্ভ হইল। মহাবল পরাক্রান্ত শিখণ্ডী, মর্ম্মাস্থিভেদ্য তীক্ষ্ন বাণ পরিত্যাগ করিয়া বাহ্লীক ভূপতিকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। বাহ্লীকও ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহার উপর হেমপুঙ্খ শিলানিশিত নতপৰ্ব্ব নয় বাণ নিক্ষেপ করিলেন। তাঁহাদের সংগ্রাম ভীরুগণের ত্ৰাসজনক ও শূরগণের হর্ষবর্দ্ধন হইল। তাঁহাদিগের শরজালে এককালে সমুদায় দিক্ ও আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হওয়াতে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। যেমন মাতঙ্গ প্রতিদ্বন্দ্বী মাতঙ্গের সহিত যুদ্ধ করে, সেইরূপ শিবিরাজ গোবাসন মহারথ কাশিরাজের পুত্রের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। যেমন জীবের মন পঞ্চেন্দ্রিয়কে পরাজয় করিতে যত্নবান্ হয়, সেইরূপ বাহ্লীকরাজ কোপান্বিত হইয়া মহারথ দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রকে পরাজয় করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহারাও যেমন ইন্দ্রিয়ার্থ সকল শরীরের সহিত সৰ্ব্বদা যুদ্ধ করে, তদ্রূপ শরবর্ষণ পূর্ব্বক বাহ্লীক রাজের সহিত তুমুল সংগ্রাম করিতে আরম্ভ করিলেন।
হে মহারাজ! আপনার পুত্র দুঃশাসন নতপর্ব্ব নয় তীক্ষ্ণ বাণে বৃষ্ণিবংশাবতংস সত্যবিক্রম সাত্যকিকে বিদ্ধ করিলে তিনি ঈষৎ মূর্চ্ছিত হইলেন এবং অবিলম্বে সংজ্ঞা লাভ করিয়া কঙ্কপত্র যুক্ত দশ বাণে দুঃশাসনকে বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে ঐ বীরদ্বয় পরস্পর পরস্পরের বাণে বিদ্ধ হইয়া পুষ্পিত কিংশুক বৃক্ষদ্বয়ের ন্যায় সংগ্রাম স্থলে শোভা পাইতে লাগিলেন। ক্রোধপূর্ণ মহাবীর অলম্বুষ মহাবল পরাক্রান্ত কুন্তিভোজের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইলে তাঁহাকে বিবিধ বাণে বিদ্ধ করিয়া কৌরব বাহিনী মুখে ভীষণ নিনাদ করিতে আরম্ভ করিল। সৈন্যগণ পূর্ব্বকালীন জম্ভাসুর ও ইন্দ্রের সমরের ন্যায় মহাবীর কুন্তিভোজ ও অলম্বুষের সংগ্রাম অবলোকন করিতে লাগিল। মাদ্ৰীপুত্র নকুল ও সহদেব কোপান্বিত হইয়া কৃতবৈর বলবান শকুনির উপর শর বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
হে মহীপাল! এইরূপে সমর ক্ষেত্রে তুমুল জনসংক্ষয় সমুপস্থিত হইল। পাণ্ডবগণের ক্রোধাগ্নি আপনার দুর্নীতিপ্রভাবে সমুৎপন্ন, কর্ণ কর্ত্তৃক বর্দ্ধিত ও আপনার পুত্রগণ কর্ত্তৃক সংরক্ষিত হইয়া এক্ষণে এই সসাগরা ধরিত্রীকে দগ্ধ করিতে উদ্যত হইয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে সমর বৃত্তান্ত শ্রবণ করুন। মহাবীর শকুনি পাণ্ডুপুত্র নকুল ও সহদেবের শর প্রহারে রণবিমুখ হইয়া পরাক্রম প্রকাশে অসমর্থ ও ইতি কৰ্ত্তব্য বিমূঢ় হইলেন। মহারথ মাদ্ৰীতনয়দ্বয় শকুনিকে সমর বিমুখ দেখিয়া পুনরায় তাঁহার উপর বারিধারার ন্যায় অসংখ্য বাণ-বর্ষণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সুবলনন্দন সেই মহাবীরদ্বয়ের সাতপর্ব্ব বিবিধ শরে বিদ্ধ হইয়া মহা বেগে অশ্ব সঞ্চালন পূর্ব্বক দ্রোণ সৈন্য মধ্যে প্রস্থান করিলেন।
মহাবীর ঘটোৎকচ মহাবেগে অলায়ুধ রাক্ষসের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। পূর্ব্বকালে রাম ও রাবণের যেরূপ বিষম সংগ্রাম হইয়াছিল, ঐ মহাবল পরাক্রান্ত রাক্ষসদ্বয়ের সেই রূপ যুদ্ধ হইতে লাগিল। রাজা যুধিষ্ঠির মদ্ররাজ শল্যকে প্রথমত পঞ্চশত বাণে বিদ্ধ করিয়া পুনরায় সাত বাণে বিদ্ধ করিলেন। পূর্ব্বে শম্বরের সহিত অমররাজ ইন্দ্রের যে রূপ যুদ্ধ হইয়াছিল, মদ্ররাজের সহিত রাজা যুধিষ্ঠিরের সেই রূপ অদ্ভুত সংগ্রাম উপস্থিত হইল। হে মহারাজ! আপনার পুত্র বিবিংশতি, চিত্রসেন ও বিকর্ণ ইহারা অসংখ্য সৈন্য পরিবৃত হইয়া ভীমসেনের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিল।