৯৬তম অধ্যায়
বিজিত রাজার প্রতি বিজেতা নৃপতির ব্যবহার
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ।! অধর্ম্মানুসারে বিজয়বাসনা করা নরপতির কদাপি কৰ্তব্য নহে। ভূপতি অধর্ম্মদ্বারা জয়লাভ করিয়া কখনই সম্মান লাভ করিতে সমর্থ হয়েন না। অধৰ্ম্মানুসারে জয়লাভ নিতান্ত নিন্দনীয় ও অকিঞ্চিৎকর। উহা রাজ্যের সহিত নরপতিকে অবসন্ন করিয়া ফেলে। বর্ম্মহীন, কৃতাঞ্জলি, অত্যাগী ও শরণাগত ব্যক্তিকে বিনাশ করা ভূপতির কর্ত্তব্য নহে। যে ব্যক্তি সৈন্যকর্ত্তৃক পরাজিত হয়, রাজা স্বয়ং তাহার সহিত যুদ্ধ করিবেন না। তিনি তাহাকে গ্রহণপূর্ব্বক আপনার আবাসে আনয়ন করিয়া এক বৎসর দাসত্ব স্বীকার করিতে উপদেশ দিবেন। যদি এক বৎসরের মধ্যে দাসত্ব স্বীকার না করে, তাহা হইলে তাহাকে মুক্ত করিয়া দেওয়াই রাজার কর্ত্তব্য। ভূপতি যদি বিক্রমপ্ৰকাশপুৰ্ব্বক শত্রুর কন্যাকে আপনার ভবনে আনয়ন করিতে পারেন, তাহা হইলে তাহাকে আপনার পত্নী করিবার নিমিত্ত এক বৎসর উপদেশ প্রদান করিবেন। যদি সে এক বৎসরের মধ্যে তাঁহার পত্নী হইতে স্বীকার না করে ও অন্যকে বরণ করিতে অভিলাষ করে, তাহা হইলে ভূপতি আর তাহাকে আপনার আলয়ে স্থানদান করিবেন না। এইরূপে রাজা দাসদাসী প্রভৃতি যা কিছু বলপূৰ্ব্বক আহরণ করিবেন, তৎসমুদয় এক বৎসরমধ্যে আপনার আয়ত্ত না হইলে পরিত্যাগ করাই কৰ্ত্তব্য। ভূপতি চৌরাদির ধন গ্রহণপূৰ্ব্বক সঞ্চিত করিবেন। জয়লব্ধ গাভীর দুগ্ধ স্বয়ং ব্যবহার না করিয়া ব্রাহ্মণগণকে পান করিতে দিবেন এবং বৃষভসমুদয়কে ভূমিকৰ্ষণে নিয়োগ অথবা জিত ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করিবেন। ক্ষত্রিয় ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তিরাই রাজার অভিমুখে অস্ত্রনিক্ষেপ করা কর্ত্তব্য নহে। উভয় পক্ষ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে যদি কোন ব্রাহ্মণ তাঁহাদের শান্তিস্থাপন অভিলাষে মধ্যস্থলে আসিয়া উপস্থিত হয়েন, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ উভয়পক্ষ নিবৃত্ত হইবেন, কদাচ যুদ্ধ করিবেন না যে এই শাশ্বত নিয়ম লঙ্ঘনপূৰ্ব্বক ব্রাহ্মণকে অতিক্রম করে, সে ক্ষত্রিয়কুলের কলঙ্ক, তাহাকে ক্ষত্রিয়মধ্যে গণনা করা কর্ত্তব্য নহে, সমাজ হইতে বহিষ্কৃত করাই বিধেয়। যে রাজা জয়লাভের বাসনা করেন, ধৰ্ম্ম উল্লঙঘন করা তাঁহার নিতান্ত অনুচিত। ধৰ্ম্মতঃ জয়লাভ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট লাভ আর কি আছে? যাহারা সহসা বিরক্ত হইয়া উঠে, তাহাদিগকে সান্ত্বনাসহকারে ভোগ প্রদান করিয়া অচিরাৎ প্রসন্ন করাই ভূপালগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। উহাদিগকে সান্ত্বনা না করিয়া ভোগপ্রদান করিলেই উহারা বিরক্ত হইয়া রাজ্য হইতে বহির্গমনপূর্ব্বক রন্ধ্রান্বেষী অমিত্রের আশ্রয়গ্রহণ করে এবং রাজার বিপদ উপস্থিত হইলে শত্রুগণের সাহায্য করিয়া যারপরনাই আহ্লাদিত হয়। কূটযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া অমিত্রকে বঞ্চনা বা দৃঢ়তর প্রহার করা ধর্ম্মাত্মা নরপতির কর্ত্তব্য নহে। দৃঢ়তর প্রহারনিবন্ধন লোকে প্রায়ই প্রাণত্যাগ করিয়া থাকে।
“যে নরপতি অতিঅল্পে সন্তুষ্ট হয়েন, তিনি বিশুদ্ধ জীবনেরই প্রশংসা করিয়া থাকেন। যাঁহার রাজ্য সুবিস্তীর্ণ, প্রজাগণ অনুরক্ত ও ধনাঢ্য এবং মন্ত্রী ও ভৃত্য প্রভৃতি সকলেই সন্তুষ্টচিত্ত, সেই রাজার দৃঢ়মূল বলিয়া পরিগণিত হয়েন। যিনি ঋত্বিক, পুরোহিত, আচাৰ্য্য ও অন্যান্য সম্পন্ন পূজার্হ ব্যক্তিদিগকে পূজা করেন, তিনি যথার্থ লোকব্যবহারজ্ঞ; দেবরাজ ঐরূপ ব্যবহারদ্বারাই ইত্বলাভ করিয়াছিলেন। ভূপালগণ ঐ বৃত্তি অবলম্বন করিয়াই ইন্দ্ৰত্বলাভ করিতে বাসনা করেন। রাজা প্রতর্দ্দন যুদ্ধবিজয়ী হইয়া শত্রুর ভূমি ভিন্ন অন্যান্য ধনসম্পত্তি এবং অন্ন ও ওষধি পর্য্যন্ত আনয়ন করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার কিছুমাত্র হানি হয় নাই। দিবোদাস শত্রুকে পরাজয় করিয়া তাহার যজ্ঞ, অগ্নি, হবিঃ ও সিদ্ধান্ন আহরণপুৰ্ব্বক পুনরায় শত্ৰুকর্ত্তৃক বঞ্চিত হইয়াছিলেন। মহাত্মা নাভাগ যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া শ্রোত্রিয় ও তাপসদিগের ধন ভিন্ন রাজ্যস্থ সমুদয় সম্পত্তি ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণা প্রদান করিয়াছিলেন। পূৰ্ব্বতন নরপতি ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিয়া বিবিধ ঐশ্বর্য্যের অধীশ্বর হইয়াছিলেন। হে মহারাজ! ভূপালগণের বিজয়-বাসনা করা কর্ত্তব্য বটে, কিন্তু যিনি আপনার মঙ্গল কামনা করিবেন, তিনি মায়া বা দর্পসহকারে জয়লাভের চেষ্টা করিবেন না।”