বৈশম্পাবন কহিলেন, ইক্ষ্বাকুবংশজাত রাজা মহাভিষ সত্যবাদী ও সত্যপরাক্রম ছিলেন। তিনি সহস্র অশ্বমেধ ও শত-সংখ্যক রাজসুয়যজ্ঞ সম্পাদনপূর্ব্বক দেবরাজকে প্রসন্ন করিয়া চরমে পরমফল স্বর্গফললাভ করিয়াছিলেন। অনন্তর একদিবস দেবগণ কমলযোনির আরাধনা করিতেছেন, বহুসংখ্যক রাজর্ষি ও মহারাজ মহাভিষ তথায় উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে সরিদ্বরা গঙ্গা ব্রহ্মার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত তথায় উপস্থিত হইলেন। বায়ুবেগে সহসা তাঁহার অঙ্গবস্ত্র উড্ডীন হইল, তদ্দর্শনে দেবতারা লজ্জায় অধোমুখ হইয়া রহিলেন; কিন্তু রাজা মহাভিষ অসঙ্কুচিত চিত্তে তাঁহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে ব্রহ্মা সন্দিহান হইয়া কিয়ৎক্ষণ তাঁহার বিষয় চিন্তা করিয়া কহিলেন, তুমি দেবলোকের উপযুক্ত পাত্র নহ; অতএব মর্ত্ত্যলোকে গিয়া জন্মগ্রহণ কর; কিন্তু পুনর্ব্বার তোমার স্বর্গ লাভ হইবে।” রাজা এই প্রকার দণ্ডিত হইয়া, কাহার ঔরসে জন্মগ্রহণ করিবেন, তদ্বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিনি অনেক রাজর্ষি এবং মহর্ষিকে চিন্তা করিয়া রাজা প্রতীপের পুৎত্র হইতে মানস করিলেন। সরিদ্বরা মহাভিষকে অত্যন্ত অধৈর্য্য দেখিয়া তাঁহাকে মনে মনে চিন্তা করিতে করিতে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। পথিমধ্যে দেখিলেন, বসু-নামক দেবগণ মূর্চ্ছিত ও বিকলেন্দ্রিয় হইয়া পতিত রহিয়াছেন।
অনন্তর তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমরা কি নিমিত্ত এরূপ দুরবস্থাগ্রস্থ হইয়াছ? তোমাদিগের কি কোন অনিষ্ট-ঘটনা হই্য়াছে? “তাঁহারা কহিলেন,”সরিদ্বরে! অতি সামান্য অপরাধে মহর্ষি বশিষ্ঠ ক্রুদ্ধ হইয়া আমাদিগকে অভিসম্পাত করিয়াছেন, তন্নিমিত্ত আমরা এইরূপ হইয়াছি। একদিবস সায়ংকালে ভগবান্ বশিষ্ঠ প্রচ্ছন্নবেশে উপবিষ্ট ছিলেন, আমরা অজ্ঞানতাপ্রযুক্ত মহর্ষির যথাবিধি সম্মান না করিয়া প্রস্থান করিয়াছিলাম, এই অপরাধে তিনি ক্রোধান্বিত হইয়া আমাদিগকে মনুষ্যযনি প্রাপ্ত হও’ বলিয়া অভিসম্পাত করিয়াছেন। তিনি সামান্য ব্যক্তি নহেন; সেই ব্রহ্মবাদীর বাক্য কদাপি অন্যথা হইবার নহে; অতএব আপনি নবকলেবর ধারণপূবর্ব্বক ভুমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়া আমাদিগের সৃষ্টি-বিধান করুন, নতুবা সামান্য মানুষীর গর্ভে আমরা জন্মগ্রহণ করিতে পারিব না।” গঙ্গা বসুগণের প্রার্থনায় সম্মতা হইয়া তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসিলেন,”মর্ত্ত্যলোকে কোন্ মহাপুরুষ তোমাদিগের জনক হইতে পারেন? ”তাঁহারা কহিলেন, ”প্রতীপ রাজার ঔরসে শান্তনু নামে এক সুবিখ্যাত ভূপাল ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিবেন, তিনিই আমাদিগের জনক হইবেন। ”গঙ্গা কহিলেন,”তোমরা যাহা বলিলে, উহা আমারও অভিমত বটে; অতএব তোমাদিগের অভিলষিত এবং সেই রাজার প্রিয়কার্য্য আমি অবশ্যই সম্পাদন করিব।” বসুগণ বলিলেন, ”হে ত্রিপথগে ! আপনার পুত্র জন্মিবামাত্র সলিলে নিক্ষেপ করিবেন, অধিককাল যেন আমাদিগকে ভূলোক-যন্ত্রণা সহ্য করিতে না হয়। গঙ্গা কহিলেন “তোমরা যাহা বলিলে আমি তাহাই করিব; কিন্তু যাহাতে রাজার একটি পুৎত্র জীবিত থাকে, তাহার কোন উপায় স্থির কর। কারণ, সেই পুত্রার্থী ভূপতির মৎসহবাস নিতান্ত নিষ্ফল হওয়া কোনক্রমেই বিধেয় নহে।” তখন বসুগণ কহিলেন,”আমরা স্ব স্ব বীর্যের চতুর্থ ভাগের অর্দ্ধাংশ প্রদান করিব, তাহাতেই তাঁহার পুত্রলাভ হইবে; কিন্তু সেই পুত্রের মর্ত্ত্যলোকে সন্তান সন্ততি হইবে না; অতএব হে ত্রিপথগামিনি! আপনার সেই মহাবলপরাক্রান্ত পুৎত্র অপুৎত্র হইবেন।” বাসুদেবতারা সরিদ্বরা গঙ্গার নিকট এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজ নিজ অভীষ্ট প্রদেশে গমন করিলেন।