৯৪তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের প্রতি ঋষিগণের আশীৰ্বাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে দেবর্ষিসত্তম! আমি আপনাকে নির্গুণ বিবেচনা করি না, তথাচ অন্য মহীপাল অপেক্ষা দুঃখে নিতান্ত সন্তপ্ত হইতেছি, আর অধর্ম্মপরায়ণ শত্ৰুগণকে নির্গুণ দেখিতেছি, তথাপি তাহারা এই পৃথিবীমণ্ডলে অভ্যুদয়-লাভ করিতেছে; ইহার কারণ কি?” লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! অধার্ম্মিক লোক ধর্ম্মবিরুদ্ধ কর্ম্মদ্বারা যে অভ্যুদয় লাভ করে, তদ্বিষয়ে আপনি কদাচ খেদ প্রকাশ করিবেন না। মনুষ্য অধর্ম্মাচরণদ্বারা প্রথমতঃ অভ্যুদয় লাভ করিয়া সুখসম্ভোগ করে, পরে আপনাকে প্ৰভু বোধ করিয়া শক্রসংহারে প্রবৃত্ত হইয়া পরিশেষে স্বয়ং সমুলে নির্মূল হইয়া থাকে। হে মহারাজ! আমি ইহা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি, অনেকানেক দৈত্য ও দানব অধর্ম্মাচরণদ্বারা অভ্যুদয় লাভ করিয়া পরিশেষে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে। পূর্ব্বে সত্যযুগে দেবগণ ধর্ম্মপথ পরিগ্রহ করিয়াছিলেন, কিন্তু অসুরেরা তাহা পরিত্যাগ করিয়াছিল। দেবতারা তীৰ্থপৰ্যটনে সতত প্ৰবৃত্ত থাকেন, কিন্তু অসুরেরা তদ্বিষয়ে সম্পূর্ণ পরাঙ্মুখ হয়। অহঙ্কার প্রথমেই অধর্ম্মপথ অসুরগণের শরীরমধ্যে প্রবেশ করে। সেই অহঙ্কার হইতে অভিমান, অভিমান হইতে ক্রোধ ও ক্ৰোধ হইতে নির্লজ্জতা জন্মে, সেই নির্লজ্জতাপ্রভাবেই তাহারা বিনাশপ্রাপ্ত হইয়াছিল। ক্ষম, লক্ষ্মী ও ধর্ম্ম ইঁহারা নির্লজ্জ, হীনচরিত্র ও অকৃতব্ৰত অসুরদিগকে অচিরকালমধ্যেই পরিত্যাগ করিলেন। লক্ষ্মী দেবগণমধ্যে আবির্ভূত হইলেন, অলক্ষ্মী অসুরদিগের আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। অনন্তর কলি অলক্ষ্মীসমাবিষ্ট অহঙ্কারপরতন্ত্র দৈত্যদানবগণমধ্যে প্রবেশ করিল। অসুরগণ কলিকর্ত্তৃক সমাক্রান্ত, অহঙ্কারপরিপূর্ণ, অভিমানে অভিভূত ও ক্রিয়াবিহীন হইয়া অবিলম্বে বিনষ্ট হইতে লাগিল; এইরূপে দানবকুল ক্ৰমে ক্রমে সমূলে নির্মূল হইয়া গেল, এদিকে ধর্ম্মশীল দেবতারা সাগর, সরিৎ, সরোবর ও পুণ্য আয়তন পৰ্যটন করিতে লাগিলেন এবং তাপ, যজ্ঞ, দানব ও আশীর্ব্বাদ-প্রভাবে সর্ব্বপাপবিনির্ম্মুক্ত হইয়া শ্রেয়োলাভ করিলেন।
“হে মহারাজ! দেবগণ এইরূপে সরলতাদিগুণসম্পন্ন ও অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া তীৰ্থপৰ্যটন করিয়াছিলেন; এই নিমিত্ত তাহাদিগের শ্ৰীবৃদ্ধি হইয়াছে। অতএব আপনিও অনুজগণসমভিব্যাহারে সমুদয় তীর্থে অবগাহন করিলে পুনরায় লক্ষ্মীলাভ করিবেন। আমি আপনাকে যেরূপ কহিলাম, ইহাই সনাতন পথ। যেমন রাজা নৃগ, শিবি, ঔশীনর, ভগীরথ, বনুমানঃ পয়, পুরু, পুরূরবা ইঁহারা মহাত্মাদিগের দর্শন তীর্থগমন, তীৰ্থস্নান ও তপশ্চৰ্য্যদ্বারা বিধূতপাপ হইয়া পবিত্ৰ যশ ও বিপুল ধনলাভ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আপনিও প্রভূত সম্পদ লাভ করিবেন। যাদৃশ মহারাজ ইক্ষাকু, মুচকুন্দ, মান্ধাতা ও মরুত্ত বিপুল-ধনের অধীশ্বর হইয়াছিলেন, কালক্রমে আপনিও সেইরূপ হইবেন সন্দেহ নাই। যদ্রূপ দেবর্ষি ও দেবগণ তপঃপ্রভাবে পবিত্র কীর্ত্তিলাভ করিয়াছেন, কালক্রমে আপনিও সেইরূপ মহীয়সী। কীর্ত্তিলাভ করিবেন। ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ মোহাচ্ছন্ন ও অধর্ম্মে পরিপূর্ণ হইয়া দৈত্যগণের ন্যায় অনতিকালমধ্যেই কালকবলে প্রবিষ্ট হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”