ক্ষান্ত হইলেন যদি ভাই পঞ্চজনে।
দুষ্ট জয়দ্রথ তবে বিচারিল মনে।।
পাঠাইয়া দিল মোরে কৌরব প্রধান।
তার কার্য্য সাধিবার বিধি কৈল আন।।
কোন্ লাজে তারে গিয়া দেখাইব মুখ।
উপায় চিন্তিব, যাতে খণ্ডিবেক দুঃখ।।
এত কষ্ট দিল মোরে পাণ্ডব দুরন্ত।
তা সবা জিনিলে মম দুঃখ হবে অন্ত।।
ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম পাণ্ডব সকল।
কেমনে হইব শক্য, আমি হীনবল।।
তপোবলে পাণ্ডবেরা হয় বলবান।
আমার তাপস্যা বিনা গতি নাহি আন।।
কঠোর তপস্যা করি শুদ্ধ কলেবরে।
তপেতে করিব তুষ্ট দেব মহেশ্বরে।।
প্রসন্ন হইবে যবে কৈলাসের নাথ।
পাণ্ডবে জিনিতে বর মাগিব পশ্চাৎ।।
তবে যদি কার্য্যসিদ্ধি নহে কদাচন।
ত্যজিব জীবন এই করিলাম পণ।।
এত বলি হিমালয় পর্ব্বতে সে গেল।
শুচি হয়ে মন আত্মা সংযত করিল।।
নিয়ম করিয়া নিত্য করে নানা ক্লেশ।
তপ আরম্ভিল করি হরের উদ্দেশ।।
কত দিন বঞ্চিলেন খেয়ে মাত্র ফল।
অতঃপর পান করে শুধু মাত্র জল।।
গ্রীষ্মকালে চতুর্দ্দিকে জ্বালিয়া আগুনি।
বসিয়া তাহার মাঝে দিবস রজনী।।
বর্ষাকালে চারিমাস বসি বৃক্ষতলে।
মস্তক পাতিয়া ধরে বরিষার জলে।।
শীতেতে শীতল যথা সুশীতল নীর।
তাহাতে নিমগ্ন হয়ে থাকে মহাবীর।।
তপস্যায় বৎসরেক করি মহাক্লেশ।
কঠোর তপেতে বশ হলেন মহেশ।।
জানিয়া একান্ত ভক্তি দেব মহেশ্বর।
মায়াদেহ ধরে হর বিপ্র কলেবর।।
যথা জয়দ্রথ আছে হিমালয় গিরি।
তাহার নিকটে চলিলেন ত্রিপুরারি।।
সমাধি করিয়া রাজা আছয়ে নির্জ্জনে।
নিমগ্ন করিয়া চিত্ত হরের চরণে।।
হেনকালে ডাকি তারে বলেন ঈশ্বর।
তপস্যা ত্যজহ রাজা, মাগ ইষ্টবর।।
ইহা শুনি জয়দ্রথ উঠিল কৌতুকে।
অপূর্ব্ব ব্রাহ্মণ মূর্ত্তি দেখিল সম্মুখে।।
বিস্মিত হইয়া কহে, তুমি কোন্ জন।
মহেশ কহেন, আমি দেব পঞ্চানন।।
রাজা বলে, তুমি যদি দেব বিশ্বনাথ।
তোমার যে নিজমূর্ত্তি ভুবনে বিখ্যাত।।
কৃপা করি সেই রূপ করহ প্রকাশ।
তবে সে আমার মনে হইবে বিশ্বাস।।
ভক্ত জানি নিজ রূপ ধরিলেন হর।
রজত পর্ব্বত জিনি দীপ্ত কলেবর।।
কটিতটে ফণিরাজ, পরা বাঘছাল।
শিরে জটা বিভূতি ভূষণ অক্ষমাল।।
উপবীত নাগের, গলেতে হাড়মাল।
সুচারু চন্দ্রের কলা শোভিয়াছে ভাল।।
বাম করে শোভে শৃঙ্গ, দক্ষিণে ডমরু।
দেখিয়া এমত রূপ বাঞ্ছাকল্পতরু।।
আপনারে কৃতকৃত্য মানে মহাবল।
দণ্ডবৎ হয়ে তবে পড়ে ভূমিতল।।
অষ্টাঙ্গ লোটায় ধরি অভয় চরণ।
ভক্তিভাবে বহুবিধ করিল স্তবন।।
অনাথের নাথ তুমি, কৃপার নিধান।
কৃপা করি নিজ গুণে কর পরিত্রাণ।।
মহেশ কহেন, রাজা মাগ ইষ্টবর।
শুনি জয়দ্রথ কহে যুড়ি দুই কর।।
আমারে অনাথ দেখি কৃপা কর যদি।
জিনিব পাণ্ডবে, আজ্ঞা কর কৃপানিধি।।
এত শুনি শূলপাণি করেন উত্তর।
মনোনীত দেখি রাজা চাহ অন্য বর।।
জয়দ্রথ বলে, অন্য বরে কার্য্য নাই।
জিনিব পাণ্ডবে আজ্ঞা করহ গোঁসাই।।
মহেশ বলেন, তুমি নহ জ্ঞানযুত।
পুনঃ পুনঃ কি কারণে কহ অসঙ্গত।।
পাণ্ডব ভুবন-জয়ী, শুন মহামতি।
তাহারে জিনিতে পারে কাহার শকতি।।
মনুষ্য জানিয়া তুমি করহ অবজ্ঞা।
আমিত তোমার মত নহি হীন প্রজ্ঞা।।
প্রয়োজন নাহি আর কহিতে বিস্তর।
অন্য যাহা ইচ্ছা, রাজা মাগ সেই বর।।
আপনার ইষ্ট যে, সে শিবের অনিষ্ট।
স্পষ্ট বুঝি পুনঃ কহে জয়দ্রথ দুষ্ট।।
এখন জানিনু তুমি পাণ্ডবের সখা।
কি হেতু আসিয়া দিলে অধমেরে দেখা।।
যাহ প্রভু নিজ স্থানে করহ গমন।
প্রাণ ত্যাগ করিব, করিনু নিরূপণ।।
ধূর্জ্জটি বলেন, বাক্যবয় কর মিছা।
করিবে যে কর, তবে আপনার ইচ্ছা।।
পরাণ ত্যজহ কিম্বা যাহা লয় মতি।
এই বর দিতে নাহি কাহার শকতি।।
জয়দ্রথ পুনঃ বলে, করহ গমন।
হেথায় রহিয়া তবে কোন্ প্রয়োজন।।
নৃপতির এই বাক্য শুনি দিগম্বর।
কৈলাস শিখরে যান দুঃখিত অন্তর।।
পুনর্ব্বার জয়দ্রথ আরম্ভিল তপ।
পাণ্ডবের পরাভব অন্তরেতে জপ।।
নানা ক্লেশে মহাবীর বঞ্চে অহির্নিশি।
তার তপ দেখি চমকিত সর্ব্ব ঋষি।।
ঊর্দ্ধপদে অধোমুখে করি অনাহার।
হেনমতে বৎসরেক গেল পুনর্ব্বার।।
হেরিয়া জয়দ্রথের তপ জপ ভক্তি।
হরের রহিতে আর না হইল শক্তি।।
যথায় নৃপতি বসি সহে তপঃক্লেশ।
সন্নিকটে পুনরপি আসিয়া মহেশ।।
রাজারে কহেন, তপ কর কি কারণ।
চতুর্ব্বগ চাহ, যাহে লয় তব মন।।
রাজ্য অর্থ বিধ্যা কিম্বা সন্ততি বৈভব।
যাহা চাহ, তাহা লহ, কি আছে দুর্ল্লভ।।
ইহা কহিলেন যদি করুণার নিধি।
জয়দ্রথ নৃপতিরে বিড়ম্বিল বিধি।।
মহামদে অন্ধ, রোষে আচ্ছাদিত মন।
সকল ছাড়িয়া চাহে পরের হিংসন।।
জয়দ্রথ বলে, যদি তুমি বর দিবে।
নিশ্চয় আমার মন, জিনিব পাণ্ডবে।।
ইহা বিনা অন্য বরে মম কার্য্য নাই।
বুঝিয়া বিধান এই করহ গোঁসাই।।
শুনিয়া কহেন শিব, শুনহ পামর।
পৃথিবীতে কত শত আছে ইষ্ট বর।।
ইহা ছাড়ি ইচ্ছা কর পরের হিংসন।
বিশেষে পাণ্ডব তাহে, নহে অন্য জন।।
অচ্ছেদ্য অভেদ্য যেই, অজেয় সংসারে।
কোন জন হবে শক্য, জিনিতে তাহারে।।
বিশেষ অর্জ্জুন নামে তাহে একজন।
তাহার মহিমা বল জানে কোন জন।।
পরম পুরুষ যেই ব্রহ্মা-সনাতন।
দুই দেহ ধরিলেন নিজে নারায়ণ।।
বিশেষে হরিতে পৃথিবীর মহাভার।
নর নারায়ণ রূপে পূর্ণ অবতার।।
নররূপ ধরে পার্থ কুন্তীর নন্দন।
যদুকুলে শ্রীগোবিন্দ নিজে নারায়ণ।।
মহামদে অন্ধমতি, না জান কারণ।
অর্জ্জুনে জিনিতে বর দিবে কোন জন।।
হইবে গোবিন্দ যবে অর্জ্জুনের পক্ষ।
বর কিসে গণি, আমি না হইব শক্য।।
যদ্যপি একান্ত কৃপা আছয়ে আমায়।
আজ্ঞা কর জিনি যেন সহ ধনঞ্জয়।।
জীবন সফল তবে, পূর্ণ হবে আশ।
এত শুনি কহিলেন, পুনঃ কৃত্তিবাস।।
বড় বংশ জন্মি তোর হীন বুদ্ধি হয়।
কি কারণে করা রাজা অসৎ আশ্রয়।।
অর্জ্জুন অজেয় জান, এ তিন ভুবনে।
সুরাসুর নাগ নর আমা আদি জনে।।
আমার একান্ত ভক্ত পার্থ মহাবীর।
অভেদ অর্জ্জুন আমি, একই শরীর।।
বিশেষ আমার মিত্র প্রধান যাদব।
তাঁহার প্রধান সখা তৃতীয় পাণ্ডব।।
আর ইন্দ্রদেব হৈতে লভিয়াছে জন্ম।
ত্রিভুবনে বিখ্যাত যে অর্জ্জুনের কর্ম্ম।।
জিনিতে নারিবে রাজা কভু হেন জনে।
উপায় করিব এক তোমার কারণে।।
অভিমন্যু পুত্র তার অতি বলবান।
কৃষ্ণের ভাগিনা, প্রিয় প্রাণের সমান।।
জিনিবে সমরে তারে দিলাম এ বর।
বিমুখ করিবে আর চারি সহোদর।।
আত্মা হৈতে পুত্র হয়, শাস্ত্রে হেন কয়।
অভিমন্যু বধিলে জিনিবে ধনঞ্জয়।।
আর দেখ অবধ্য পাণ্ডব পঞ্চ জন।
অস্ত্রাঘাতে কদাচিৎ না হবে মরণ।।
কি কর্ম্ম করিবে তারে করিয়া বিমুখ।
চিরকাল পুত্রশোকে পাইবেক দুখ।।
এত শুনি তুষ্টমতি হয়ে নরপতি।
চরণে ধরিয়া বহু করিল প্রণতি।।
কৈলাস শিখরে তবে যান মহেশ্বর।
জয়দ্রথ যায় তবে হস্তিনা নগর।।
মহাভারতের কথা সুধা সমতুল।
কাশী কহে, ব্যাসের গাথা বিশ্বে অতুল।।