৯৪তম অধ্যায়
কৃষ্ণকর্ত্তৃক সন্ধিপ্রস্তাব উত্থাপন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপে সমুদয় সভ্যগণ তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া উপবিষ্ট রহিলেন, মহাত্মা মধুসূদন বর্ষাকালীন সজল জলদগম্ভীর নিস্বনে [মেঘধবনির ন্যায় উচ্চ শব্দ] সভামণ্ডপ প্ৰতিধ্বনিত করিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে অবলোকনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে ভরতবংশাবতংস! আমার মানস যে, কৌরব ও পাণ্ডবগণের মধ্যে পরস্পর সন্ধিস্থাপন হয়; বীরপুরুষগণের বিনাশ না হয়। আমি ইহাই প্রার্থনা করিতে আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। আপনাকে অন্য কিছু হিতোপদেশ প্রদান করিবার আবশ্যকতা নাই; যাহা জ্ঞাতব্য, আপনি তৎসমুদয় অবগত হইয়াছেন। হে রাজন! আপনাদিগের কুল বিদ্যা, সদাচার প্রভৃতি গুণসম্পন্ন ও অন্যান্য সমুদয় ভূপতিগণের কুল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। দয়া, অনৃশংসতা [নির্দয়তা], সরলতা, ক্ষমা ও সত্য কুরুকুলে বিশেষরূপ বর্ত্তমান আছে। অতএব এই কুলে, বিশেষতঃ আপনা হইতে অযুক্ত [অশোভন— অবাঞ্ছিত] কাৰ্য্য সমুৎপন্ন [আচরিত] হওয়া নিতান্ত অনুচিত। আপনি কুরুকুলের শ্রেষ্ঠ ও শাসনকতা থাকিতে কৌরবগণ গোপনে ও প্রকাশ্যে অনৃত [মিথ্যা]। ব্যবহার করিতেছে। দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি আপনার পুত্ৰগণ নিতান্ত অশিষ্ট, মৰ্য্যদানাশক ও লোভপরতন্ত্র। উহারা ধর্ম্মার্থের উপর দৃষ্টিপাত না করিয়া স্বীয় বন্ধুগণের প্রতি নৃশংস ব্যবহার করিতেছে।
“দেখুন, এক্ষণে কুরুকুলে এই ঘোরতর আপদ সমুত্থিত হইয়াছে; যদি আপনি ইহাতে উপেক্ষা করেন, তাহা হইলে ইহা পরিশেষে সমুদয় পৃথিবী বিনষ্ট করিবে। হে মহারাজ! আপনি মনে করিলেই এই আপদ বিনাশ করিতে পারেন; বোধহয়, উভয় পক্ষের শান্তি হওয়া নিতান্ত দুষ্কর নহে। কুরুপাণ্ডবগণের শান্তি আপনার ও আমার অধীন। আপনি আপনার পুত্ৰগণকে শান্ত করুন, আমি পাণ্ডবগণকে নিরস্ত করিব। আপনার আজ্ঞা প্রতিপালন করা আপনার পুত্ৰগণের অবশ্য কর্ত্তব্য, আপনার শাসনে থাকিলে তাহাদের যথেষ্ট শ্রেয়োলাভ হইবার সম্ভাবনা। আপনি শান্তিসংস্থাপন করিলে কৌরব ও পাণ্ডব উভয় পক্ষেরই হিত হইবে; অতএব বৈর নিস্ফল বিবেচনা করিয়া শান্তিসংস্থাপনে যত্নবান হউন; প্ৰাণপণে যত্ন করিলেও পাণ্ডবগণকে পরাজয় করা অসাধ্য। হে রাজন! কৌরবগণ আপনার সহায় আছে, এক্ষণে পাণ্ডবগণকে সহায় করিয়া স্বচ্ছন্দে ধর্ম্মার্থচিন্তায় নিমগ্ন হইয়া থাকুন। আপনি পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইলে ভূপতিগণের কথা দূরে থাকুক, দেবরাজ ইন্দ্রও দেবগণসমভিব্যাহারে আপনার প্ৰতাপ সহ্য করিতে সমর্থ হইবেন না।
“দেখুন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, বিবিংশতি, অশ্বত্থামা, বিকৰ্ণ, সোমদত্ত, বাহ্লীক, সৈন্ধব, কলিঙ্গ, কম্বোজ, সুদক্ষিণ, যধিষ্ঠির, ভীমসেন, ধনঞ্জয়, নকুল, সহদেব, সাতকি ও মহারথ যুযুৎসু, এই সমুদয় মহাবীরগণের সহিত কোন যোদ্ধা যুদ্ধ করিতে সাহসী হইবে? অতএব স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, আপনি কৌরব ও পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইলে অনায়াসে সমুদয় লোকের অধীশ্বরত্ব ও শক্রগণের অজেয়ত্ব লাভ করিতে পরিবেন। কি সমকক্ষ, কি আপনা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, সকল ভূপতিই আপনার সহিত সন্ধিসংস্থাপন করিবেন। তখন আপনি পুত্র, পৌত্র, ভ্রাতা, পিতা ও সুহৃদগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া সমুদয় পৃথিবী ভোগ করিয়া সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিতে পরিবেন। আপনি স্বীয় পুত্ৰগণ ও পাণ্ডবগণের প্রভাবে অনায়াসে অন্যান্য শত্রুগণকে পরাজয় করিয়া পুত্র ও অমাত্যগণসমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের উপার্জিত ভূমি ভোগ করিতে পরিবেন।
“হে মহারাজ! সংগ্রাম মহাক্ষয়ের হেতু। দেখুন, কৌরব ও পাণ্ডব এই উভয় পক্ষের কোন পক্ষ বিনষ্ট হইলে আপনার যথেষ্ট হানি হইবে; পাণ্ডবগণ বা কৌরবগণ সংগ্রামে নিহত হইলে আপনার কি সুখোদয় হইবে? পাণ্ডবগণ সকলেই শূর, কৃতাস্ত্র ও যুদ্ধাভিলাষী, তাঁহারাও আপনার আত্মীয়; অতএব আপনি তাহাঁদিগকে এই ভাবী বিপদ হইতে রক্ষা করুন। আমাদিগকে যেন সমুদয় কৌরব ও পাণ্ডবগণকে সমরে ক্ষীণ ও রথিগণকে রথিগণকর্ত্তৃক নিহত দেখিতে না হয়। ভূমণ্ডলস্থ সমস্ত ভূপালেরা ক্রুদ্ধ হইয়া সমবেত হইয়াছেন; তাঁহাদের ক্ৰোধে সমস্ত প্রজা বিনষ্ট হইবে, সন্দেহ নাই। হে মহারাজ! আপনি প্ৰজাগণকে রক্ষা করুন; উহারা যেন বিনষ্ট না হয়। আপনি প্রকৃতিস্থ হইলেই ইহাদের পরস্পর বিবাদভঞ্জন হইবে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া পবিত্ৰকুলসম্ভূত বদান্য অতি যশস্বী লজ্জাপরবশ মহামান্য পরস্পর মিত্রভাবসম্পন্ন কুরুপাণ্ডবগণকে এই মহাদজয় হইতে পরিত্রাণ করুন। এইসকল ভূপতিগণ পরস্পর মিলিত হইয়া ক্ৰোধ ও বৈর পরিত্যাগপূর্ব্বক উত্তম বসন ও মাল্য ধারণ করিয়া একত্ৰ পান ও ভোজন করিয়া স্ব স্ব গৃহে প্ৰতিগমন করুন। পূর্ব্বে পাণ্ডবগণের সহিত আপনার যেরূপ সৌহার্দ্য ছিল, এক্ষণেও সেইরূপ হউক; আপনি সন্ধিস্থাপনে যত্ন করুন। পাণ্ডবেরা বাল্যাবধি পিতৃহীন হইয়া আপনাকর্ত্তৃক পুত্ৰনির্ব্বিশেষে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন; অতএব এক্ষণে তাঁহাদিগের এবং স্বীয় পুত্ৰগণকে যথাবিধি প্রতিপালন করুন। পাণ্ডবগণ সকল সময়ে বিশেষতঃ আপৎকালে আপনারই রক্ষণীয়; অতএব আপনি তাহার বিপরীতানুষ্ঠান করিয়া ধর্ম্মাৰ্থ নাশ করিবেন না।
“হে মহারাজ! পাণ্ডবেরা আপনাকে অভিবাদনপূর্ব্বক প্রসন্ন করিয়া কহিয়াছেন যে, “আমরা আপনাকে পিতা জ্ঞান করিয়া আপনার আদেশানুসারে দ্বাদশ বৎসর বনে বাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিয়া নিরন্তর ক্লেশ ভোগ করিয়াছি। এই ব্ৰাহ্মণগণ জানেন যে, আমরা প্ৰতিজ্ঞা প্রতিপালন করিয়াছি। অতএব এক্ষণে যাহাতে আমরা স্বীয় রাজ্যাংশ লাভ করিতে পারি, এরূপ করুন। আপনি ধর্ম্মার্থতত্ত্বজ্ঞ, আমরা আপনাকে গুরুর ন্যায় জ্ঞান করিয়া অশেষ প্রকার ক্লেশ সহ্য করিয়া আছি; অতএব এক্ষণে মাতাপিতার ন্যায় আমাদিগকে এই বিপদ হইতে পরিত্ৰাণ করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। হে রাজন! শিষ্যের গুরুর প্রতি যাদৃশ ব্যবহার করা উচিত, আমরা আপনার প্রতি সেইরূপ করিতেছি, আপনি আমাদিগের প্রতি গুরুর ন্যায় ব্যবহার করুন। আমরা উৎপথগামী [অসৎ পথে প্রবর্ত্তিত] হইলে আমাদিগকে সৎপথাবলম্বী করা আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য; অতএব আপনি ধর্ম্মপথে বর্ত্তমান থাকিয়া আমাদিগকে সেই পথে আনীত করুন।”
“পাণ্ডবগণ সভাসদগণকেও কহিয়াছেন যে ‘ধৰ্মজ্ঞ সভ্যগণ সে স্থানে থাকিতে অন্যায় কাৰ্য্য হওয়া কদাপি বিধেয় নহে। যদি সভাসদগণের সমক্ষে অধৰ্মপ্রভাবে ধর্ম্ম ও অসত্যপ্রভাবে সত্য বিনষ্ট হয়, তাহা হইলে তাহারা বিনাশপ্ৰাপ্ত হইয়া থাকেন। যদি কোন সভামধ্যে ধর্ম্ম অধৰ্মস্বরূপ শল্যে বিদ্ধ হয়, আর তত্রস্থ সভ্য সেই শল্য ছেদন না করেন, তাহা হইলে তাঁহারাই সেই শল্যে বিদ্ধ হয়েন। নদী যেমন তীরস্থ বৃক্ষসমুদয় ভগ্ন করে, তদ্রূপ। ধর্ম্ম উক্তরূপ সভ্যগণকে বিনষ্ট করিয়া থাকেন। যাঁহারা ধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া অবস্থান করেন, তাঁহারাই সত্য, ধর্ম্মানুগত ও ন্যায্য বাক্য কহিয়া থাকেন।”
“হে মহারাজ! আমি পাণ্ডবগণকে রাজ্যপ্ৰদানপূর্ব্বক তাঁহাদের সহিত সন্ধি করা ভিন্ন আপনাকে অন্য কিছু বলিতে পারি না; অথবা অত্ৰস্থ পরিষদ [সভাসদ]গণ এ বিষয়ে যাহা সঙ্গত হয়, বলুন। হে মহীপাল! যদি আমার বাক্য ধর্ম্মার্থসঙ্গত ও সত্য বলিয়া আপনার বোধ হইয়া থাকে, তাহা হইলে এই সমুদয় ভূপতিগণকে মৃত্যুপাশ হইতে মুক্ত করুন। হে ভরতকুলপ্রদীপ! এক্ষণে প্রশান্ত হউন, ক্রোধাপরবশ হইবেন না; পাণ্ডবগণকে তঁহাদের পৈতৃক রাজ্যাংশপ্রদানপূর্ব্বক পুত্ৰগণসমভিব্যাহারে সুখস্বচ্ছন্দে বিবিধ ভোগ উপভোগ করুন। মহাত্মা যুধিষ্ঠিরকে সতত ধৰ্মপথাবলম্বী বলিয়া জানিবেন। ঐ মহাপুরুষ আপনার ও আপনার পুত্ৰগণের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিয়া থাকেন, তাহা আপনার অবিদিত নাই। আপনি তাহাকে দাহিত [দুঃখানলে দগ্ধ] নির্ব্বাসিত করিয়াছিলেন; তিনি তথাপি আপনার আশ্রয় গ্ৰহণ করিয়াছেন। আপনিই আপনার পুত্ৰগণের পরামর্শানুসারে তাঁহাকে ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করিতে আদেশ করিয়াছিলেন; তিনি তদনুসারে তথায় বাস করিয়া স্বপ্রভাবে সমুদয় ভূপতিগণকে বশীভূত করিয়া আপনারই অধীন করিয়াছিলেন; আপনার মৰ্য্যাদা কখনই অতিক্রম করেন নাই। কিন্তু সুবলনন্দন শকুনি আপনার মতানুসারে কপটযুদ্ধে তাঁহার রাজ্য ও ধনসম্পত্তিসকল অপহরণ করিল। তিনি সেই অবস্থায় সভামধ্যে দ্রৌপদীর অবমাননা নিরীক্ষণ করিয়াও ক্ষত্রধর্ম্ম হইতে বিচলিত হইলেন না।
“আমি এক্ষণে আপনাদের উভয় পক্ষের মঙ্গলবাসনায় এই সকল কথা কহিতেছি, আপনি প্ৰজাগণকে ধর্ম্ম, অর্থ ও সুখভ্রষ্ট করিবেন না। আপনার পুত্ৰগণ অনর্থকে অর্থ ও অর্থকে অনর্থ বলিয়া জ্ঞান করিতেছে, আপনি তাহাদিগকে শাসন করুন। ফলতঃ পাণ্ডবগণ সন্ধি ও বিগ্ৰহ উভয়েই সম্মত আছেন; আপনার যাহা অভিরুচি হয়, করুন।”
তত্ৰস্থ সমস্ত পারিষদ মনে মনে কৃষ্ণের বাক্যের প্রশংসা করিতে লাগিলেন; কিন্তু অগ্ৰে স্পষ্টভিধানে [স্পষ্টবাক্যে] কেহই কিছু কহিতে পারিলেন না।