ত্রিনবতিতম অধ্যায়
যযাতির ত্যাগশীলতা
বসুমান্ কহিলেন, “মহারাজ! আমি উষদশ্বের পুৎত্র, আমার নাম বসুমান্। যদি স্বর্গে বা অন্তরীক্ষে আমার ভোগ্য কোন স্থান থাকে, তাহা আমি তোমাকে প্রদান করিলাম।” রাজা কহিলেন, “অন্তরীক্ষ, পৃথিবী, দিক এবং যে-সকল লোক সূর্য্যদেবের তাপে উত্তপ্ত হয়, তাদৃশ বহুসংখ্যক লোক আপনার গমন-প্রতীক্ষা করিতেছে।” বসুমান্ প্রত্যুত্তর কহিলেন, “মহারাজ! আর ভূমণ্ডলে নিপতিত হইতে হইবে না, আমি সেই লোক আপনাকে প্রদান করিতেছি, উহা আপনারই ভোগ্য হউক; যদি প্রতিগ্রহ করা আপনার পক্ষে নিতান্ত দূষণীয় হয়, তবে তৃণ দ্বারা উহা ক্রয় করুন।” রাজা প্রত্যুত্তর করিলেন, “হে নরেন্দ্র! তুমি সাধু ব্যক্তিদিগকে কদাচ অবমাননা কর নাই, অতএব তোমার বিদ্যুৎ প্রায় অনন্ত লোক বিদ্যমান আছে।” শিবি কহিলেন, “মহারাজ! যদি এই সকল লোক ক্রয় করা আপনার অনভিমত হয়, তবে তাহা আপনাকে সম্প্রদান করিতেছি, আপনি তাহা গ্রহণ করুন। আমি দান করিয়া পুনরায় তাহা গ্রহণ করিব না, যেহেতু বিদ্বান ব্যক্তিরা দান করিয়া কদাচ অনুতাপ করেন না।”যযাতি কহিলেন, “হে নরদেব! আপনি দেবরাজতুল্য প্রভাবসম্পন্ন এবং আপনার ভোগ্য লোকও অনন্ত বটে, কিন্তু আমার অদ্যাপি অন্যদত্ত লোকে স্পৃহা হয় নাই; অতএব আপনার দান আমার অভিমত নহে।” তখন অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! যদি অস্মদ্দত্ত এক একটি লোক স্বীকার না করেন, তবে আমরা আপনাকে সমুদয় প্রদান করিয়া বরং নরকে গমন করিব।” রাজা প্রত্যুত্তর করিলেন, “আমার পক্ষে যাহা উপযুক্ত বোধ হয়, তাহা সম্পাদন করিতে যত্নবান্ হউন, কারণ, সাধু ব্যক্তিরা স্বভাবতঃ সত্যপরায়ণ হইয়া থাকেন; কিন্তু যাহা আমার অদৃষ্টলভ্য নহে, তদ্বিষয় ভোগ করিতে আমি কখনই সম্মত হইতে পারি না।” অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! যে-সকল সুবর্ণময় রথে আরোহণ করিয়া লোকে শাশ্বতলোকে গমন করিতে অভিলাষ করে, তদ্রূপ পাঁচখানি রথ দেখা যাইতেছে, উহা কাহার?” রাজা কহিলেন, “ঐ সকল সুবর্ণময় রথ তোমাদিগকে বহন করিবে। উহা জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় পরিদৃশ্যমান হইতেছে।” অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! তুমি ঐ রথে আরোহণ করিয়া অন্তরীক্ষে গমন কর এবং নির্দ্দিষ্টকাল উপস্থিত হইলে আমারাও তোমার অনুসরণ করিব।” রাজা কহিলেন, “আমরা কর্ম্মফলে সকলেই স্বর্গলোক জয় করিয়াছি, অতএব চল, সকলে সমবেত হইয়া তথায় গমন করিব। এই আমাদিগের দেবলোকে প্রস্থান করিবার নিষ্কণ্টক পথ দেখাইতেছে।”
অনন্তর ধর্ম্মশীল ভূপালগণ রথারোহণপূর্ব্বক স্বীয় প্রভাপুঞ্জ দ্বারা নভোমণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। এই অবসরে অষ্টক কহিলেন, “আমি মনে করিয়াছিলাম, মহাত্মা ইন্দ্র আমার সখা, আমি অগ্রে তাঁহার নিকট গমন করিব; কিন্তু উশীনরতনয় শিবি মহাবেগে অশ্বগণকে অতিক্রম করিয়া গমন করিতেছেন, ইঁহার অভিপ্রায় কি?” যযাতি প্রত্যুত্তর করিলেন, “উশীনরপুৎত্র যত ধন উপার্জ্জন করিয়াছিলেন, সমুদয়ই দেবলোকে সমর্পণ করিয়াছেন; অতএব শিবিরাজ আমাদিগের সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। অসামান্য-বুদ্ধিসম্পন্ন শিবিরাজ দান, তপস্যা, সত্য,ধর্ম্ম, লজ্জা, ক্ষমা ওবিধিৎসা প্রভৃতি প্রভূত গুণে অলঙ্কৃত; বিশেষতঃ শিবিরাজ অতিশয় সুশীল ও সৌম্য; এই কারণে শিবি সর্ব্বাগ্রে গমন করিতেছেন।” অনন্তর অষ্টক সকৌতুকচিত্তে পুনর্ব্বার মাতামহকে জিজ্ঞাসিলেন, “মহারাজ! জিজ্ঞাসা করি, আপনি কোথা হইতে আগমন করিতেছেন এবং কাহার পুৎত্র? আর আপনি যে-সকল কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন, তাদৃশ অন্য কোন ক্ষৎত্রিয় বা ব্রাহ্মণ তদ্রূপ কর্ম্ম র পারেন না কেন? এই সমুদায় যথার্থরূপে বর্ণন করুন।” রাজা প্রত্যুত্তর করিলেন, “আমি নহুষতনয়, আমার নাম যযাতি। আমি পৃথিবী-রাজ্যের সম্রাট্ ছিলাম, আমি তোমাদিগের সমক্ষে সমুদয় রহস্য প্রকাশ করিতেছি। আমি তোমাদের মাতামহ, আমি সমস্ত অবনীমণ্ডল জয় করিয়াছি, ব্রাহ্মণদিগকে একশত সুরূপ পবিত্র অশ্ব ও বস্ত্র দান করিয়াছি এবং শত অর্ব্বুদ গো, বাহন, সুবর্ণ ও ধনের সহিত এই সসাগরা ধরিত্রী বিপ্রসাৎং করিয়াছি;পৃথিবী ও স্বর্গে আমার সত্যের প্রভাব দেদীপ্যমান আছে। সত্যপ্রভাবেই মানুষ্যলোকে অগ্নি প্রজ্বলিত হইতেছে। আমি যাহা কহিা থাকি, সকলই সত্য। আমার বাক্য কদাচ বিফল হয় না; যেহেতু সাধুলোকেরা সত্যের সম্মান করিয়া থাকন। হে অষ্টক! আমি সত্যই কহিতেছি , উষদশ্বের পুত্র প্রতর্দ্দন, মুনি ও দেবগণ ইহারা সত্য-প্রভাবেই সকলের পুজনীয় ও মান্য হইয়াছেন। আমরা স্বীয় পুণ্যবলে সুরলোক জয় করিয়াছি; অতএব যে ব্যক্তি আমাদিগের নিকট অকপটে স্বকিয় রহস্য ভেদ করিবেন এবং বিপ্রগণের প্রতি অসূয়া- শূন্য হইবেন, তিনি উত্তরকালে আমাদিগের সালোক্য লাভ করিতে পারিবেন। এইরূপে রাজা যযাতি স্বয় দৌহিত্রগণ দ্বারা তারিত হইয়া মহীয়সী কীর্ত্তি-সংস্থাপনপূর্ব্বক পৃথিবী পরিত্যাগ করিয়া ত্রিদশালয়ে গমন করিলেন।