দ্বিনবতিতম অধ্যায়
যযাতির স্বধর্ম্মানুরক্তি
অষ্টক যযাতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “উক্ত উভয়বিধ ভিক্ষুর মধ্যে অগ্রে কাহার মুক্তিলাভ হইয়া থাকে?” যযাতি কহিলেন, “যিনি গৃহস্থাশ্রমে বাস করিয়াও আশ্রমবিবর্জ্জিত এবং কামাচারপরাঙ্মুখ, তিনিই অগ্রে মুক্তিলাভ করেন। যথার্থ জ্ঞানী হইয়া পাপাচরণ করিলেও ধারাবাহিক সুখভোগ করিতে পারেন। যে-ব্যক্তি পণ্ডশ্রম মনে করিয়া ধর্ম্মোপাসনা করে, তাহার সেই ধর্ম্মাচরণ বিফল; কেবল ক্রুরতা মাত্র।”
মহারাজ! রাজা যযাতির একম্প্রকার ধর্ম্মসংগীত শ্রবণ করিয়া, অষ্টক জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহারাজ! আপনি যুবা, মাল্যধারী, তেজস্বী এবং দর্শনীয়; কোন্ ব্যক্তি আপনাকে দূতরূপে প্রেরণ করিয়াছেন এবং আপনি কোথা হইতে আগমন করিলেন ও কোন দিকে গমন করিবেন? আপনার কি পার্থিব স্থানে গমন করিতে হইবে?” যযাতি কহিলেন, “আমার পূণ্যক্ষয় হওয়াতে স্বর্গ হইতে চ্যুত হইয়া এই পৃথিবীরূপ ভৌম নরকে পতিত হইতেছি; আপনাদিগের সহিত কথোপকথন করিয়া অচিরে ভূতলে পতিত হইব; যেহেতু ব্রহ্মলোকরক্ষকেরা আমার ভূলোকপতনের নিমিত্ত ত্বরা করিতেছেন। আর পতনকালে ইন্দ্র আমাকে এই বর দিয়াছেন, ‘হে নরেন্দ্র! তুমি সাধুসমাজে পতিত হইবে’, তাহাও হইল।” অষ্টক কহিলেন, “তুমি পতিত হইও না, হে রাজন! যদি আমার অন্তরীক্ষ বা দিব্য কোন লোক থাকে, আমি তোমাকে তাহার অধিকারী করিলাম।” যযাতি কহিলেন, “মহারাজ! যতদিন পৃথিবীতে গবাশ্ব প্রভৃতি জীবজন্তু আছে, ততদিন আপনার স্বর্লোকে অধিকার আছে।” অষ্টক কহিলেন, “আমার দিব্য বা অন্তরীক্ষ যে-কোন লোক থাকে, তাহা তোমাকে প্রদান করিলাম, তুমি অচিরাৎ সেই স্থানে গমন কর।” যযাতি প্রত্যুত্তর করিলেন, “হে রাজশ্রেষ্ঠ বেদবিৎ ব্রাহ্মণেরাই প্রতিগ্রহ করিয়া থাকেন, মাদৃশ ক্ষৎত্রিয়েরা কদাচ যাচ্ঞাদৈন্য স্বীকার করেন না; বরং ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতির অভাবে প্রাণত্যাগ করা কর্ত্তব্য, তথাপি যাচ্ঞাজনিত লঘুতা স্বীকার করা অনুচিত।”
পরে অষ্টকের সমভিব্যাহারী প্রতর্দ্দন কহিলেন, “হে দর্শনীয়! আমি প্রতর্দ্দন, তুমি তত্ত্বজ্ঞানী, অতএব যদি অন্তরীক্ষে বা স্বর্গে আমার কোন স্থান থাকে, আমি তোমাকে তাহার অধিকারী করিলাম।” যযাতি কহিলেন, “হে নরেন্দ্র! আপনার অতি উৎকৃষ্ট বহুসংখ্যক লোক আছে। সেই সকল লোক আপনাকে প্রতীক্ষা করিতেছে; উহা এত অধিকসংখ্যক যে, প্রতি সপ্তাহে এক এক লোক ভোগ করিলেও নিঃশেষিত হয় না।” প্রতর্দ্দন কহিলেন, “আমি তোমাকে সেই সকল লোক প্রদান করিলাম। তুমি মোহ পরিত্যাগপূর্ব্বক শীঘ্র তথায় গমন কর।” রাজা প্রত্যুত্তর করিলেন, “সমতেজস্ক শ্রেষ্ঠ রাজারা অন্যের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেন না। ধর্ম্মপরায়ণ রাজা ধর্ম্ম্য মান্য ও যশস্কর কর্ম্ম যত্নপূর্ব্বক সম্পাদন করিয়া থাকেন; কিন্তু আপনি যেরূপ বলিতেছেন, মাদৃশ লোক এরূপ কৃপণ কর্ম্ম করিতে সম্মত নহেন। মদ্বিধ লোকের কর্ত্তব্য যে, যাহা অন্যে না করিয়াছে তদ্রূপ অপূর্ব্ব কর্ম্ম সম্পাদন করে।” রাজা যযাতি এইরূপ কহিতেছেন, ইত্যবসরে মহারাজ বসুমান্ তাঁহাকে বলিতে আরম্ভ করিলেন।