৯২তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের লোমশসহ তীর্থযাত্ৰাসঙ্কল্প
লোমশ কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! ধনঞ্জয় যাহা কহিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করুন। ‘হে তপোধন! আপনি আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে ধর্ম্মকর্ম্মে নিয়োগ করবেন। আপনি পরমধর্ম্ম, তপস্যা ও রাজাদিগের সনাতনধর্ম্ম অবগত আছেন; অতএব আপনি পাণ্ডবগণকে তীৰ্থপৰ্য্যটনজনিত পুণ্যে পরিপূর্ণ ও পাবন পুরুষ নারায়ণের প্রতি অনুরক্ত করিবেন। রাজা যুধিষ্ঠির যাহাতে তীৰ্থপৰ্যটন ও গোদান-ক্রিয়ায় তৎপর হয়েন, তদ্বিষয়ে যত্নবান হইবেন।” তিনি আরও কহিলেন যে, “আপনি তাঁহাদিগকে তীর্থভ্রমণ-সময়ে দুৰ্গম ও বিষম-প্রদেশে রাক্ষসগণ হইতে রক্ষা করিবেন। যেমন দধীচ মুনি ইন্দ্রকে ও অঙ্গিরাঃ আদিত্যকে রক্ষা করিয়াছিলেন, সেইরূপ আপনিও পাণ্ডবগণকে রাক্ষসগণ হইতে পরিত্ৰাণ করিবেন। আপনি পাণ্ডবগণকে রক্ষা করিলে বিকটমূর্ত্তি ভীষণকায় রাক্ষসগণ কদাচ তাহাদিগের নিকটবর্ত্তী হইতে সমর্থ হইবে না।”
“আমি দেবরাজ ইন্দ্র ও অর্জ্জুনের নিয়োগানুসারে রক্ষকস্বরূপ হইয়া আপনাদিগের সহিত পৰ্য্যটন করিব। আমি বারদ্বয় তীৰ্থসকল সন্দর্শন করিয়াছি, এক্ষণে আমি আবার আপনাদিগের সহিত তৃতীয়বার সেই দৃষ্টপূর্ব্ব তীর্থসকল সন্দর্শন করিব। পুণ্যশীল মনু প্রভৃতি রাজর্ষিগণ এই ভয়াবহ তীর্থযাত্রার অনুসরণ করিয়াছিলেন। যে-সকল ব্যক্তি ঋজুতাবর্জ্জিত, আত্মজ্ঞানবিহীন, অকৃতবিদ্য ও পাপকারী, তাহারা কদাচ তীৰ্থ-স্নানে সমুৎসুক হয় না। আপনি নিত্যধর্ম্মপরায়ণ ও সত্যসঙ্গর; অতএব আপনি ভগীরথের ন্যায়, গদ প্রভৃতি ভূপতিগণের ন্যায়, যযাতির ন্যায় পুনরায় পাপীজনক সকলপ্রকার সংসৰ্গ হইতে বিমুক্ত হইবেন সন্দেহ নাই।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! আপনার বাক্যশ্রবণে আমার শরীরে এরূপ আনন্দের আবির্ভাব হইয়াছে যে, আমি আপনার কথার কি প্রকার উত্তর প্রদান করিব, তাহাও বিস্মৃত হইতেছি। যে ব্যক্তি দেবরাজের স্মৃতিপথে সমুদিত হয়, তাহা অপেক্ষা আর কোন ব্যক্তি গৌরবশালী হইতে পারে? আপনি যাহার সহবাসী, ধনঞ্জয় যাহার সহোদর ও দেবরাজ যাহাকে স্মরণ করেন, তাহা অপেক্ষা আর কোন ব্যক্তি মহিমান্বিত হইতে পারে? সে যাহা হউক, আপনি যে তীর্থদর্শনের নিমিত্ত অনুরোধ করিতেছেন, আমি ইতিপূর্ব্বেই ধৌম্য মহাশয়ের বাক্যানুসারে তদ্বিষয়ে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছি; অতএব আপনি যে সময় তীর্থযাত্রার অনুকুল ও প্রশস্ত বলিয়া বোধ করেন, সেই সময়ে গমন করা স্থির করিলাম।”
অনন্তর লোমশ-মুনি তীর্থগমনোৎসুক যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহারাজ! পরিবারসংখ্যার স্বল্পতাসম্পাদন করুন; কারণ, অল্পপরিবারে পরিবৃত হইয়া স্বচ্ছন্দে গমন করিতে পরিবেন।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “যে-সকল ভিক্ষোপজীবী ব্রাহ্মণ ও যতি ক্ষুৎপিপাসা, পথশ্ৰম, আয়াস ও সীতবাতাদি সহ্য করিতে অসমর্থ যে-সকল ব্রাহ্মণ মিষ্টান্নভোজী, যাঁহারা পক্কান্ন, লেহ্য, পেয় ও মাংসের অভিলাষী, যাহারা ভোজনের নিমিত্ত সর্ব্বদা সূপকারের অনুবর্ত্তী, তাঁহারা সকলেই তীর্থাভিগমনে বিনিবৃত্ত হইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করুন। আমি যাঁহাদিগকে যথোচিত জীবিকা প্ৰদান করিয়া প্রতিপালন করিতেছি এবং যে-সকল পৌরজন রাজভক্তি প্রদর্শনপূর্ব্বক আমার অনুগত হইয়া কালব্যাপন করিতেছেন, তাঁহারা এক্ষণে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের নিকট গমন করুন, তিনি তাঁহাদিগকে সময়সমুচিত যোগ্য জীবিকা প্ৰদান করিবেন; অথবা আমাদের হিতের নিমিত্ত পাঞ্চালরাজ তাঁহাদিগের জীবিকানির্ব্বাহ করিতে পারেন; কিন্তু এ স্থানে থাকিলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কখনই তাহাদিগকে বৃত্তি প্রদান করবেন না।’
অনন্তর পৌরজন, বিপ্ৰ ও যতিগণ হস্তিনানগরে গমন করিলে, রাজা ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি প্রেমপরতন্ত্র হইয়া তাঁহাদিগকে যথাবিধি প্রতিগ্রহ ও সমুচিত ধনদানপূর্ব্বক তাঁহাদিগের সন্তোষসাধন করিলেন। এদিকে পাণ্ডবগণ অল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণে পরিবৃত হইয়া লোমশ-মুনির সহিত প্রীতি-প্ৰফুল্লচিত্তে কাম্যাকবনে ত্রিরাত্র বাস করিলেন।