দুর্য্যোধন কহে, সবে কি যুক্তি করিলে।
বিধাতা দিবেক বলি নিশ্চিন্ত রহিলে।।
বিধিকৃত হৈলে জানি অবশ্যই জয়।
তিনি না করিলে, জানি সব মিথ্যা হয়।।
সংসারে থাকিয়া লোক করিবে উদ্যোগ।
নিত্য নিত্য ভুঞ্জিবেক নানা উপভোগ।।
অনুক্ষণ করিবেক স্বকার্য্য সাধন।
পূর্ব্বমত আছে হেন বিধি নির্ব্বন্ধন।।
ফল পায়, যেবা রাখে বিধাতায় মন।
জীবনেতে উপায় করিবে সর্ব্ব জন।।
বুদ্ধিতে পাণ্ডব যদি গুপ্তবাস তরে।
অনর্থ করিবে আসি মহাক্রোধ ভরে।।
ইন্দ্রতুল্য পরাক্রম এক এক জন।
কাহার হইবে শক্তি করিতে বারণ।।
মাতুল ত্রিগর্ত্ত তুমি আমি দুঃশাসন।
মহাশ্রম করিলে না পারি কদাচন।।
মন্ত্রণা করিয়া যাদি সংহারিতে পারি।
উদ্বেগ সাগর হৈতে অনায়াসে তরি।।
কহিলে যতেক কথা, মনে নাহি লয়।
পরাক্রমে পাণ্ডবেরে কে করিবে জয়।।
সুযুক্তি ইহার এই, লয় মম মন।
আনিব দ্রুপদ সুতা করিয়া হরণ।।
দ্রুপদ নন্দিনী হয় পাণ্ডবের প্রাণ।
অশেষ সঙ্কটে নিত্য করে পরিত্রাণ।।
বুদ্ধিবল করি যদি তাহারে হরিবে।
নিশ্চয় দেখিবে তবে পাণ্ডব মরিবে।।
সে কারণে কহি আমি এ সব সম্মত।
গুপ্তবেশে সেই স্থানে যাক জয়দ্রথ।।
বুদ্ধিবলে বিশারদ, তারে ভাল জানি।
প্রকার করিয়া যেন হরে যাজ্ঞসেনী।।
লুকায়ে রাখিব কৃষ্ণা অতি গুপ্তস্থানে।
খুঁজিয়া পাণ্ডব যেন না পায় সন্ধানে।।
কৃষ্ণার বিচ্ছেদে বড় পাইবেক শোক।
এইরূপে পঞ্চ ভাই হইবে বিয়োগ।।
নিষ্কন্টক হবে রাজ্য, ঘুচিবে জঞ্জাল।
নির্ব্বিরোধে রাজ্যবোগ করি চিরকাল।।
তোমা সবাকার যদি হয় ত সম্মতি।
তবে সে কর্ত্তব্য, এই লয় মম মতি।।
এতেক কহিল যদি কৌরব -প্রধান।
প্রশংসা করিল তবে মন্ত্রী জ্ঞানবান।।
ধন্য ধন্য মহাশয় মন্ত্রণা তোমার।
করিলে যে মন্ত্রণা, তা সবাকার সার।।
যোগ্য হয় এ কর্ম্ম মোদের অভিমত।
গুপ্তবেশে সেই স্থানে যাক জয়দ্রথ।।
দুষ্টমতিগণ যদি এতেক কহিল।
শুনিয়া নৃপতি তবে আনন্দিত হৈল।।
তবে জয়দ্রথে আজ্ঞা দিল দুর্য্যোধন।
তুমি শীঘ্র কাম্যবনে করহ গমন।।
অন্তরে থাকিয়া তথা বীর চূড়ামণি।
বুদ্ধিবলে হরিয়া আনিবে যাজ্ঞসেনী।।
এতেক কহিল যদি কৌরব ঈশ্বর।
কতক্ষণে জয়দ্রথ করিল উত্তর।।
তোমার আজ্ঞাতে আমি যাই কাম্যবন।
কিন্তু পাণ্ডবেরে সবে জানহ যেমন।।
দ্বিতীয় শমন তুল্য একৈক পাণ্ডব।
শতাংশ সমান তার নহি মোরা সব।।
বিশেষে, আপনি মনে কর অবধান।
গন্ধর্ব্ব-সমরে একা পার্থ কৈল ত্রাণ।।
জীয়ন্ত ব্যাঘ্রের চক্ষু আনে কোন্ জনে।
কার শক্তি হিংসিবে সে পাণ্ডু পুত্রগণে।।
যদি বা তোমার বাক্য নাহি করি আন।
নিমিষেতে বৃকোদর বধিবেক প্রাণ।।
বিশেষ দ্রুপদসুতা লক্ষ্মী-অবতার।
মহাবল পঞ্চ ভাই রক্ষক তাহার।।
একান্ত থাকিবে যার জীবনের আশা।
সে কেন করিবে হেন দুরন্ত প্রত্যাশা।।
জয়দ্রথ মুখে তবে এই বাক্য শুনি।
বিনয় পূর্ব্বক তারে কহে নৃপমণি।।
কহিলে যতেক কথা, আমি সব জানি।
পাণ্ডবের সম্মুখে কে হরে যাজ্ঞসেনী।।
কি ছার কৌরব সেনা, তোমা গণি কিসে।
অন্যে কি করিবে যারে দণ্ডপাণি ত্রাসে।।
একা পার্থ জিনিলেক এ তিন ভুবন।
সুরাসুর নাগ নরে সম কোন্ জন।।
সুযুক্তি করেছি এই, শুন দিয়া মন।
আনিবে দ্রুপদসুতা করিয়া গোপন।।
নিকটে নিকটে সদা রবে সাবধানে।
অতি সঙ্গোপনে, যেন কেহ নাহি জানে।।
স্নান দানে যবে সবে যাবে চারিভিত।
সেই কালে সেই স্থানে হবে উপনীত।।
হরিয়া দ্রুপদসুতা প্রকার বিশেষে।
যত্ন করি লুকাইবে অতি দূরদেশে।।
খুঁজিয়া পাণ্ডব যেন উদ্দেশ না পায়।
তার শোকে পাণ্ডবেরা মরিবে নিশ্চয়।।
সুসিন্ধ হইবে তবে মনের অভীষ্ট।
নিঃসঙ্কটে রাজ্যভোগ করিব যথেষ্ট।।
তোমা বিনা অন্য জন ইথে নহে শক্য।
সহায় সম্পদ মোর তুমি সে স্বপক্ষে।।
বিস্তর কহিয়া আর নাহি প্রয়োজন।
অমূল্যে কিনিবে তুমি রাজা দুর্য্যোধন।।
পুনঃ পুনঃ কহে রাজা মৃদু মৃদু ভাষ।
শুনি জয়দ্রথ করে বচন প্রকাশ।।
কি কারণে এত কথা কহ নরপতি।
অবশ্য পালিব আমি তব অনুমতি।।
এই আমি চলিলাম কাম্যক-কানন।
প্রাণপণে সম্পাদিব তব প্রয়োজন।।
এত শুনি তুষ্ট হৈল প্রধান কৌরব।
সাজাইয়া দিল রথ করিয়া গৌরব।।
সবে সম্ভাষিয়া বীর চড়ে গিয়া রথে।
চালাইয়া দিল কাম্য-কাননের পথে।।
যাইতে যাইতে পথে করিল বিচার।
রাজার সাহসে আজি কৈনু অঙ্গীকার।।
পড়িলে ভীমের হাতে নাহিক নিস্তার।
ঈশ্বর করেন যদি, হইব উদ্ধার।।
এতেক চিন্তিয়া মনে যুক্তি কৈল সার।
চৌর্য্য বিনা কার্য্য সিদ্ধি নহিবে আমার।।
এইরূপে জয়দ্রথ চিন্তাকুল মনে।
উপনীত হৈল গিয়া মহাঘোর বনে।।
দুদিকে কানন শোভা, মধ্য দিয়া পথ।
নানাবর্ণ মৃগ পশু দেখে শত শত।।
বিবিধ কুসুমে দেখে শোভিয়াছে বন।
মকরন্দ পান করে সুখে অলিগণ।।
বিবিধ প্রকার শোভা দেখিয়া কাননে।
কাম্যবন নিকটে আইল কতক্ষণে।।
নন্দনকানন তুল্য দেখে কাম্যবন।
অনেক আশ্রম তথা দেখে মুনিগণ।।
স্থানে স্থানে দেখে কত দেবের আশ্রম।
বিবিধ বিহঙ্গ রব করে নানাক্রম।।
এরূপ কৌতুক মনে করিতে ভ্রমণ।
উত্তরিল কতক্ষণে যথা পঞ্চ জন।।
তাহার নিকটে লুকাইল জয়দ্রথ।
ছিদ্র চাহি থাকে বীর নিরখিয়া পথ।।
শমন সমান জানি ভীম ধনঞ্জয়।
নিকটে যাইতে নারে পরাণের ভয়।।
হেনমতে রহে তথা হইয়া গোপন।
এক দিন শুন রাজা দৈবের ঘটন।।