এইমত কুরুপতি, চন্তিয়া আকুল মতি,
অত্যন্ত উদ্বেগ চিত্ত হয়ে।
ডাকাইয়া সর্ব্বজনে, বসিল নিভৃত স্থানে,
যত পাত্রমিত্রগণ লয়ে।।
দুর্য্যোধন হেনকালে, কর্ণে সম্বোধিয়া বলে,
অবধান কর মোর বোলে।
দুঃখের নাহিক ওর, দগ্ধ হৈল তনু মোর,
অনুক্ষণ চিন্তার অনলে।।
বিশেষ তোমরা সবে, মন্ত্রণার অনুভবে,
যে কিছু করিলে সুবিচার।
করিতে আমার হিত, বিধি কৈল বিপরীত,
এক চিন্তা কৈলে হয় আর।।
পুনঃ পুনঃ এই মত, উপায় করিনু যত,
হিংসা হেতু পাণ্ডুপুত্রগণে।
পরম সঙ্কটে তরে, হিতপক্ষ প্রতিকারে,
না জানি করিল কোন্ জনে।।
সকল বালক মিলে, ক্রীড়ার কৌতুককালে,
ভীমেরে দেখিয়া বলবান।
কেহ তারে নহে শক্য, নিবারিতে প্রতিপক্ষ,
কালকূট করাইনু পান।।
বান্ধি হস্ত পদ গলে, ফেলিনু গভীর জলে,
দৈবযোগে গেল রসাতল।
কেবা দিল প্রাণদান, কিবা সুধা করি পান,
অযুত হস্তীর ধরে বল।।
অনন্তর জতুগৃহে, তারে পোড়াইয়া দেহে,
ভাবিলাম করিব সংহার।
বুদ্ধিবলে তাহে তরি, দুরন্ত রাক্ষস মারি,
পাইল পরম প্রতিকার।।
কাল কাটি অনায়াসে, গেল পাঞ্চালের দেশে,
পাঞ্চালী পাইল স্বয়ন্বরে।
কি দিব ভাগ্যের লেখা, দ্রুপদ হইল সখা,
জিনিলেক লক্ষ দণ্ডধরে।।
অনন্তর রাজ্যে আসি, অবনী-মণ্ডল শাসি,
যে কর্ম্ম করিল যজ্ঞকালে।
কে তার উপমা দিবে, না হইল, না হইবে,
ক্ষিতিমধ্যে ক্ষত্রিয়ের কুলে।।
পিতামহ মুখে শুনি, যদুকুলে চক্রপানি,
পূর্ণব্রহ্ম নিজে অবতার।
ব্রাহ্মণ-চরণ ধৌতে, নিযুক্ত করিল তাতে,
হেনজন যজ্ঞেতে যাহার।।
হইল এমনি ক্রম, স্থলে হৈল জলভ্রম,
তাহাতে ঘটিল যে দুর্দ্দশা।
তাহে পেয়ে অপমান, বাঞ্ছা হল ত্যজি প্রাণ,
সেই দুঃখে খেলাইনু পাশা।।
হারিলেক রাজ্যধন, দাসত্ব করিল পণ,
তাহে জয় হইল আমার।
অন্ধরাজ বুদ্ধিদোষে, আপনার ভাগ্যবশে,
যাজ্ঞসেনী করিল উদ্ধার।।
সবে মিলি পুনর্ব্বার, মন্ত্রণা করিনু সার,
বনবাস কৈনু নিরূপণ।
না পাইল কোন দুঃখ, বনে তার নানা সুখ,
স্বর্গে যেন সহস্রলোচন।।
হিড়িম্বাদি জটাসুরে, মুহূর্ত্তেকে যমপুরে,
পাঠাইল করিয়া বিক্রম।
ভীমসেন শত্রুগণে, নিপাত করিল রণে,
অনায়াসে না জানিল শ্রম।।
একা পার্থ মহাবল, স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতল,
জিনিবারে হইল ভাজন।
দ্বিতীয় বিক্রম সীমা, ভীম পরাক্রম ভীমা,
যার নামে সভয় শমন।।
মধ্যাহ্ন-সূর্য্যের সম, অপ্রমেয় পরাক্রম,
মাদ্রীপুত্র যুগল বিশেষে।
আর এক অনুমানি, লক্ষ্মীরূপা যাজ্ঞসেনী,
পাইল পাণ্ডব পুণ্যবশে।।
তাহার সুকর্ম্ম যত, বিশেষ কহিব কত,
বলিতে না পারি এক মুখে।
এক দ্রব্য সুসংযোগে, স্বর্গের অধিক ভোগে,
বনেতে পাণ্ডব আছে সুখে।।
নিত্য নিয়মিত যত, প্রতিদিন শত শত,
ব্রাহ্মণেরে করায় ভোজন।
লক্ষ লক্ষ যত আসে, তারা সব ভাগ্যবশে,
বিমুখ না যায় কোন জন।।
সেহেতু হিংসিতে তারে, পাঠাইনু দুর্ব্বাসারে,
শিষ্য দশ সহস্র সংহতি।
শুনিলাম লোকমুখে, ভোজন করিয়া সুখে,
মুনি গেল আপন বসতি।।
ইহা পূর্ব্বে সর্ব্ব জনে, গেলাম প্রভাস স্নানে,
দেখিনু সকল বিদ্যমান।
যে কর্ম্ম করিল তায়, বুঝিলাম অভিপ্রায়,
নহি তার শতাংশ সমান।।
তপ জপ যজ্ঞ ব্রত, বল বুদ্ধি ধৈর্য্য যত,
পাণ্ডবের আছয়ে সকল।
সবার সমান গুণ, বিশেষতঃ ভীমার্জ্জুন,
ক্ষিতিমধ্যে দুই মহাবল।।
যে কিছু উপায় শেষে, মন্ত্রণার সমাবেশে,
যদ্যপি না হয় প্রতিকার।
বুদ্ধিবল অনায়াসে, কাল কাটি কোন দেশে,
আসিয়া করিব মহামার।।
মধ্যাহ্ন মার্ত্তণ্ডসম, যেন মহাকাল যম,
বারণ করিবে কোন্ জন।
এই চিন্তা অবিরত, কুম্ভকার চক্রবত,
সতত অস্থির মম মন।।
অতি সে উদ্বিগ্ন মনে, সবাকার বিদ্যমানে,
কহিল কৌরব অধিপতি।
দুর্য্যোধন মনঃক্লেশে, জানি হিত উপদেশ,
সূর্য্যপুত্র কহে মহামতি।।
মহারাজ কি কারণে, এতেক উদ্বিগ্ন মনে,
কি হেতু পাণ্ডবে কর ভয়।
তোমার বৈভব বলে, স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে,
উপমার যোগ্য হেন নয়।।
কহিলে যে মহারাজা, পাণ্ডব প্রবল তেজা,
আসিয়া করিবে মহামার।
বহুদিন তারা আছে, আমরাও আছি কাছে,
হিংসা কবে করিল কাহার।।
বনের নিবাস গত, শেষ দিন আছে যত,
যদ্যপি বঞ্চিবে মহাক্লেশে।
কহ কোথা আছে ঠাঁই, লুকাইবে পঞ্চ ভাই,
অজ্ঞাতে বঞ্চিবে কোন্ দেশে।।
যতেক নৃপতিচয়, কেবল তোমার ভয়,
কাছে না রাখিবে কোন জন।
পাঠাইব চরগণে, নগর পর্ব্বত বনে,
খুঁজিলে পাইবে দরশন।।
আছে পূর্ব্ব নিরূপণ, দ্বাদশ বৎসর বন,
বঞ্চিবেক অজ্ঞাত বৎসর।
এতেক যে কালান্তরে, কেবা জীয়ে কেবা মরে,
চিরজীবী নহে কোন নর।।
শুভ ভাগ্যবশে যদি, বঞ্চিয়া অজ্ঞাত বিধি,
আসিবেক যখন সকল।
বনবাস মহাকষ্ট, চিন্তাকুল জ্ঞানভ্রষ্ট,
শক্তিহীন হইবে দুর্ব্বল।।
তখন করিব ক্রম, প্রকাশিয়া পরাক্রম,
স্বকার্য্য সাধিব কুতূহলে।
নিমিষেতে পঞ্চ জনে, পাঠাইব যমস্থানে,
তোমার পুণ্যের মহাবলে।।
আমার বিক্রম জানি, কি কারণে নৃপমণি,
ক্ষুদ্র জনে কর এত ভয়।
ভীষ্ম দ্রোণ অশ্বত্থামা, সবে অনুগত তোমা,
কি করিবে পাণ্ডুর তনয়।।
এত বলি কর্ণবীর, হিতপক্ষ নৃপতির,
কহিল শুনিল সর্ব্বজন।
সূর্য্যপুত্র কহে যত, তাহা নহে অন্যমত,
সবাই করিবে প্রাণপণ।।
এই মত সর্ব্বজনে, কহিলেন দুয্যোধনে,
আশ্বাস করিয়া বহুতর।
শুনিয়া এ সব বাণী, দুর্য্যোধন মহামানী,
কতক্ষণে করিল উত্তর।।
বলবুদ্ধি অনুভবে, যে কিছু কহিবে সবে,
অন্যথা না করি কদাচন।
কিন্তু নহি দীর্ঘজীবী, সর্ব্বদা এ সব ভাবি,
যোগবৎ চিন্তি অনুক্ষণ।।
বনের চরিত্র কথা, শ্রবণে মঙ্গল গাঁথা,
প্রকাশিল মহামুনি ব্যাস।
সেই কথা মনুঃসুখে, শুনিয়া লোকের মুখে,
পাঁচালি রচিল তাঁর দাস।।