নবতিতম অধ্যায়
যযাতি-কথিত বিবিধ সন্নীতি
অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! ইন্দ্রকাননে অযুতশতাব্দী বাস করিয়া কি কারণে তাহা পরিত্যাগপূর্ব্বক পৃথিবীতে পুনরাগমন করিলেন?” রাজা কহিলেন, “হে অষ্টক! যেমন জ্ঞাতি বা সুহৃজ্জন নির্ধন মনুষ্যকে পরিত্যাগ করে, সেইরূপ ইন্দ্রাদি দেবতারা ক্ষীণপুণ্য ব্যক্তিকে দেবলোক হইতে নিক্ষেপ করিয়া থাকেন।” তখন অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! আপনি তত্ত্বজ্ঞানী, অতএব বলুন দেখি, স্বর্গে কি কারণে পুণ্য ক্ষীণ হয় এবং কি পুণ্য করিলে কোন্ ধামে গমন করিতে পারে, এ বিষয়ে আমার অতীব সন্দেহ আছে।” যযাতি প্রত্যুত্তর করিলেন, “পুণ্যক্ষয় হইলে মনুষ্যেরা বিলাপ ও পরিতাপ করিতে করিতে দেবলোক হইতে এই মর্ত্ত্যলোকস্বরূপ ঘোর নরকে পুনরায় পতিত হয় এবং ভৌমকলেবর পরিগ্রহপূর্ব্বক বিবিধ উপভোগ আসক্ত হইয়া শৃগাল-কুক্কুরের তৃপ্তিসাধনের নিমিত্ত পুৎত্রপৌৎত্রাদিক্রমে বংশ পরিবর্দ্ধিত করিতে থাকে। অতএব যে কর্ম্ম করিলে পৃথিবীতে অতিশয় কষ্টভোগ করিতে হয়, এমত গর্হিত কার্য্যে নিতান্ত অবজ্ঞা ও একান্ত অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা কর্ত্তব্য। হে অষ্টক! যাহা কর্ত্তব্য, তৎসমুদয়ই বলিলাম, এক্ষণে আর কি শুনিতে বাসনা কর, বল।” অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! স্বর্গচ্যুত হইয়া নরলোকে আগমন করিবার কালে পথিমধ্যে পতঙ্গেরা নরকলেবর ভক্ষণ করিয়া থাকে, তবে কিরূপে তাহারা এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়? আর কেনই বা এই নরলোককে নরক বলিয়া নির্দ্দেশ করিলেন?” রাজা কহিলেন, “মনুষ্যেরা জননী-জঠর হইতে কর্ম্মারব্ধ দেহলাভানন্তর এই পৃথিবীতে সঞ্চরণ করে এবং ইহাতেই পতিত হইয়া লক্ষ লক্ষ বৎসর অতিবাহিত করে, এই নিমিত্ত পৃথিবীকে নরক বলিয়া উল্লেখ করিলাম। পৃথিবীতে পতিত হইবার সময়ে তীক্ষ্ণদংষ্ট্র, ভয়ঙ্কর ভৌম রাক্ষসগণ পতনোন্মুখ ব্যক্তিকে কষ্ট দান করিয়া থাকে।” অষ্টক জিজ্ঞাসিলেন, “মহারাজ! পাপপ্রভাবে দেবলোকচ্যুত মনুষ্যগণকে যদি ভীমরূপী রাক্ষসগণ পথিমধ্যে গ্রাস করে, তবে তাহারা কিরূপে পুনরায় এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়, কিরূপে ইন্দ্রিয়সম্পন্ন হয়, আর কি প্রকারেই বা তাহারা গর্ভে আবিষ্ট হয়?” রাজা প্রত্যুত্তর করিলেন, “অশ্রুপ্রবাহে জলভাবাপন্ন মনুষ্যকলেবর রেতোরূপে পরিণত হইয়া পৃথিবীস্থ বনস্পতি, ওষধি, ফল, পুষ্প ও পঞ্চভূতে অনুপ্রবিষ্ট হয়। সেই ফলাদি ভক্ষণ করিলে রেতঃজন্মে। সেই রেতঃ গজে সিক্ত হইলে গর্ভের সঞ্চার হয়, তাহাতেই চতুষ্পদ, দ্বিপদ প্রভৃতি জন্তুগণ গর্ভে আবির্ভূত হইয়া থাকে।” অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! গর্ভভূত জন্তু কি শরীরান্তর দ্বারা কিংবা স্বশরীর দ্বারা গর্ভে অনুপ্রবিষ্ট হয়? আর কিরূপেই বা দেহের ঔন্নত্য, চক্ষুঃশ্রোত্রাদি ইন্দ্রিয়বর্গ এবং চৈতন্য লাভ করে? এই বিষয়ে আমাদের মহান সংশয় আছে; আপনি তত্ত্বজ্ঞ, অতএব এই সমুদয় বিশেষরূপে বর্ণনা করিয়া আমাদিগের সন্দেহভঞ্জন করুন।” রাজা প্রত্যুত্তর করিলেন, “ঋতুকালে বায়ু পুষ্পরসানুপৃক্ত রেতঃ গর্ভযোনিতে আকর্ষণ করে; সেই রেতঃ প্রথমতঃ তন্মাত্ররূপী হইয়া ক্রমশঃ গর্ভকে পরিবর্দ্ধিত করিতে থাকে। তদনন্তর সেই গর্ভ অঙ্গপ্রত্যঙ্গসম্পন্ন হইয়া পূর্ব্বতন বাসনা অবলম্বনপূর্ব্বক মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হয়। মনুষ্য জাতমাত্রে চৈতন্য-লাভ করিয়া শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা শব্দ, চক্ষু দ্বারা রূপ, ঘ্রাণেন্দ্রিয় দ্বারা গন্ধ, জিহ্বা, দ্বারা রস, ত্বগিন্দ্রিয় দ্বারা শীত, উষ্ণ প্রভৃতি স্পর্শ অনুভব করিতে এবং মন দ্বারা সমুদয় ভাব অবগত হইতে পারে।” অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! মৃত ব্যক্তির কলেবর দগ্ধ, নিখাত বা নিক্ষিপ্ত হইয়া থাকে, তবে মরণান্তর অভাবভূত পুরু কিরূপে পুনর্ব্বার চৈতন্য-লাভ করে?” যযাতি কহিলেন, “পুরুষ প্রাণত্যাগ করিয়া স্বকীয় পুণ্যপাপের অনুসারে অচিরাৎ অন্য যোনি আশ্রয় করে। পুণ্যবান্ ব্যক্তিরা পুণ্যযোনি ও পাপকারী ব্যক্তিরা পাপযোনি প্রাপ্ত হয়। কীট ও পতঙ্গাদি পাপকারী জন্তু; এই নিমিত্ত উহারা পাপযোনির অন্তর্গত; চতুষ্পদ, দ্বিপদ, ষট্পদ ইহারাও পাপস্বভাব, এই নিমিত্ত ইহারাও পাপযোনির অন্তর্গত। হে রাজসিংহ! যাহা বক্তব্য, তাহা সবিস্তারে বলিলাম, এক্ষণে আর কি জিজ্ঞাস্য আছে, বল।” অষ্টক কহিলেন, “মহারাজ! মনুষ্য তপস্যা, বিদ্যা বা যেরূপ কর্ম্মানুষ্ঠান দ্বারা শ্রেষ্ঠলোক প্রাপ্ত হয়, আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি, তৎসমুদয় আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করুন।” যযাতি কহিলেন, “হে অষ্টক! তপস্যা, দান, শম, দম, লজ্জা, সরলতা এবং দয়া এই সাতটি স্বর্গের দ্বার-স্বরূপ। সাধুলোকেরা কহিয়া থাকেন, মনুষ্যেরা অজ্ঞানকূপে মগ্ন হইয়া অহঙ্কারদোষে সর্ব্বদা বিনষ্ট হয়। অধ্যয়নশীল পাণ্ডিত্যাভিমানী যে ব্যক্তি বিদ্যবলে অন্যের যশোলোপ করে, সে পুণ্যলোক হইতে অচিরাৎ ভ্রষ্ট হয় এবং তাহারা সেই অধ্যয়নাদি ব্রহ্মফলপ্রদ হয় না। অগ্নিহোত্র, মৌনব্রত, অধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান এই চতুর্ব্বিধ কর্ম্ম শুভফলপ্রদ সন্দেহ নাই, কিন্তু দম্ভ-অহঙ্কারের সহিত অনুষ্ঠিত হইলে ইহার ফল ভয়ঙ্কর হয়। মানে হর্ষপ্রকাশ ও অপমানে সন্তাপ করিও না। সাধু ব্যক্তিরা সাধুদিগকে সর্ব্বদা সৎকার করিয়া থাকেন। অসাধুরা কদাচ সাধুবুদ্ধি লাভ করিতে পারে না। ‘এত দান করিলাম’, ‘এতব্রতানুষ্ঠান করিলাম, এইরূপ অহঙ্কার অতি ভয়ঙ্কর, অতএব ইহা যত্নপূর্ব্বক পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। যে-সকল মনীষী সকলের আশ্রয়ভূত, তাঁহাদিগের সহিত সঙ্গত হইলে ইহলোকে কীর্ত্তি ও পরলোকে সদ্গতিলাভ হয়।”