৯০তম অধ্যায়
দুঃশাসনের পলায়ন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! এইরূপে মহাবীর কিরীটা অশ্বপক্ষীয় সৈন্যগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলে কোন্ কোন্ বীর সেই সমরে ধনঞ্জয়ের সম্মুখীন হইয়াছিল? তৎকালে কোন মহাবীর কি অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন, অথবা সকলেই তাঁহার নিকট পরাজিত ও হতাশ্বাস হইয়া অকুতোভয় মহাবীর দ্রোণাচার্য্যের আশ্রয় গ্রহণের নিমিত্ত শকট ব্যূহে প্রবেশ করিলেন?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! ইন্দ্রতনয় ধনঞ্জয় নিশিত শরনিকর দ্বারা সৈন্য সংহারে প্রবৃত্ত হইলে অস্মৎপক্ষীয় অসংখ্য বীর নিহত এবং সকলেই হতোৎসাহ ও পলায়ন পরায়ণ হইল; কেহই অর্জ্জুনকে অবলোকন করিতে সমর্থ হইল না। তখন আপনার পুত্র মহাবীর দুঃশাসন সৈন্যগণের তদ্রূপ অবস্থা অবলোকন করিয়া ক্রোধভরে যুদ্ধার্থে অর্জ্জুনাভিমুখে গমন করিলেন। ঐ সুবর্ণ কবচ সমাবৃত, সুবর্ণশিরস্ত্রাণধারী, অমিত পরাক্রম মহাবীর অসংখ্য নাগসৈন্য দ্বারা সব্যসাচীকে পরিবৃত করিতে লাগিলেন। গজঘণ্টার শব্দ, শঙ্খের ধ্বনি, জ্যাম্ফালন নিনাদ ও করিবৃংহিত দ্বারা ভূমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও আকাশমণ্ডল সমাচ্ছন্ন হইল। হে মহারাজ! ঐ মুহুৰ্ত্ত অতিভীষণ হইয়া উঠিল। দুঃশাসনের করি সৈন্য যেন পৃথিবীমণ্ডল গ্রাস করিতে লাগিল।
পুরুষশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয় অঙ্কুশচালিত লম্বিতশুণ্ড গজগণকে পক্ষবিশিষ্ট পর্ব্বতের ন্যায় ক্রোধভরে আগমন করিতে দেখিয়া উচ্চস্বরে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক তাহাদের উপর শরনিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং মকর যেমন উত্তাল তরঙ্গমালাসঙ্কুল, বাতাহত মহাসাগরে প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই করি সৈন্য মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। সমরাঙ্গণস্থ সকলেই তাঁহাকে প্রলয় কালীন মার্কণ্ডের ন্যায় অবলোকন করিতে লাগিল। অশ্বগণের খুরশব্দ, রথসমুদায়ের চক্রনির্ঘোষ, জনসমূহের চীৎকার, কার্ম্মুকের জ্যানির্ঘোষ, নানাবিধ বাদিত্রের শব্দ, গাণ্ডীব নিনাদ এবং পাঞ্চজন্য ও দেবদত্ত শঙ্খের নিস্বনে নর ও নাগগণ মন্দবেগ ও অচেতন হইয়া পড়িল। মহাবীর ধনঞ্জয় অসংখ্য সায়ক দ্বারা তাহাদের কলেরব ভেদ করিতে লাগিলেন। কুঞ্জরগণ গাণ্ডীব নিক্ষিপ্ত শত শত তীক্ষ্ণ বিশিখ-প্রহারে ক্ষত বিক্ষতাঙ্গ হইয়া ঘোরতর চীৎকার করত ছিন্নপক্ষ অদ্রির ন্যায় অনবরত ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। অনেক হস্তী দন্ত ও শুণ্ডের সন্ধি, কুম্ভ, এবং গণ্ড দেশে দারুণ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া রাক্ষসের ন্যায় বারংবার চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল।
তখন মহাবীর কিরীটী সন্নতপর্ব্ব ভল্লদ্বারা গজারূঢ় পুরুষগণের মস্তক ছেদন করিতে লাগিলেন। গজারোহিগণের কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক সকল ধরাতলে নিপতিত হইতে আরম্ভ হইলে বোধ হইল যেন মহাত্মা পার্থ পদ্ম-নিচয় দ্বারা দেবাৰ্চনা করিতেছেন। মাতঙ্গগণ রণস্থলে ভ্ৰমণ করিতে আরম্ভ করিলে মনুষ্যগণ যন্ত্রবদ্ধ, ব্ৰণাৰ্ত্ত ও রুধিরাক্তকলেবর হইয়া করিগণের অঙ্গে লম্বমান হইতে লাগিল। ঐ যুদ্ধে অনেকবার অর্জ্জুনের এক সুশাণিত শরে দুই তিন জন মনুষ্য বিদীর্ণ হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইল। হস্তিগণ নারাচ দ্বারা গাঢ় – বিদ্ধ হইয়া রুধির বমন করত আরোহীর সহিত দ্রুমবান পর্ব্বতের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। মহাবীর অর্জ্জুন সন্নতপর্ব্ব ভল্ল দ্বারা রথিগণের মৌৰ্ব্বী, ধ্বজ, ধনু, যুগ ও ঈষা ছেদন করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি যে কখন শর গ্রহণ কখন শর সন্ধান, কখন শরাকর্ষণ, আর কখনই বা শরমোচন করিতে লাগিলেন, তাহা কিছুমাত্র লক্ষিত হইল না। কেবল এই মাত্র বোধ হইতে লাগিল যে, যেন মহাবীর ধনঞ্জয় শরাসন মণ্ডলাকার করিয়া রণস্থলে নৃত্য করিতেছেন। ঐ সময় অনেক মাতঙ্গ অর্জ্জুনের নারাচে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া রক্তোদগার করত ভূতলে শয়ন করিতে লাগিল।
হে মহারাজ! সেই রণস্থলে চতুর্দ্দিকেই অসংখ্য কবন্ধ সমুত্থিত হইল। কার্ম্মুক, অঙ্গুলিত্র, খড়্গ, কেয়ূর ও কনকালঙ্কার ভূষিত ছিন্ন বাহু সকল দৃষ্ট হইতে লাগিল। দিব্যভূষণ ভূষিত আসন, ঈষাদণ্ড, চক্রবিমথিত অক্ষ, ভগ্ন যুগ, নিপতিত মহাধ্বজ, রাশি রাশি মালা, আভরণ ও বস্ত্র এবং রণনিহত অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও চৰ্ম্ম-চাপধারী ক্ষত্রিয়গণ ইতস্তত সঙ্কীর্ণ হওয়ায় রণভূমি অতি ঘোর দর্শন হইয়া উঠিল। হে রাজন! এইরূপে দুঃশাসনের সৈন্যগণ অর্জ্জুন শরে নিতান্ত নিপীড়িত ও ব্যথিত হইয়া রণ পরিত্যাগ পূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিল। দুঃশাসনও পার্থশরে জর্জ্জরিতাঙ্গ – হইয়া শঙ্কিত চিত্তে সৈন্যগণ সমভিব্যাহারে দ্রোণের আশ্রয় গ্রহণার্থে শকট ব্যূহে প্রবেশ করিলেন।