৯০তম অধ্যায়
কৃষ্ণের দুৰ্য্যোধনগৃহে গমন-আতিথ্যে প্রত্যাখ্যান
বৈশম্পয়ন কহিলেন, ভূপাল! মহাত্মা গোবিন্দ এইরূপে স্বীয় পিতৃষ্বসাকে আমন্ত্রণ ও প্ৰদক্ষিণ করিয়া অসামান্য শ্ৰীসম্পন্ন, পুরন্দর [ইন্দ্র] গৃহসদৃশ, বিচিত্ৰাসনযুক্ত দুৰ্য্যোধনের গৃহে গমন করিলেন। তিনি দ্বারবানকর্ত্তৃক অনিবারিত [অনিষিদ্ধ] হইয়া ক্ৰমে ক্ৰমে কক্ষা [প্রকোষ্ঠ-মহল] অতিক্রমপূর্ব্বক গিরিশৃঙ্গের ন্যায় সমুন্নত সুধাধবল [শুভ্ৰ] পরমশোভাসম্পন্ন প্রাসাদে আরোহণ করিলেন এবং দেখিলেন, মহাবাহু দুৰ্য্যোধন বহুল ভূপাল ও কৌরবগণে পরিবেষ্টিত হইয়া মহার্হ [অতিমূল্যবান] আসনে উপবিষ্ট আছেন; দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনি তাঁহার সমীপে অত্যুৎকৃষ্ট আসনে সমাসীন রহিয়াছেন। মহাযশাঃ ধৃতরাষ্ট্রতনয় গোবিন্দকে অবলোকন করিবামাত্র অমাত্যগণসমভিব্যাহারে আসন হইতে উত্থিত হইয়া তাহার অভ্যর্থনা করিলেন। বৃষ্ণিবংশাবতংস বাসুদেব এইরূপে দুৰ্য্যোধনের সহিত মিলিত হইয়া পরিশেষে বয়ঃক্রমানুসারে ভূপতিগণের সহিত আলাপ করিয়া বিবিধ আস্তরণে আস্তীর্ণ [পাতঞ্চি দিয়া ঢাকা] জাম্বুনন্দময় [স্বর্ণ] পৰ্য্যন্ধে উপবিষ্ট হইলেন। দুৰ্য্যোধন তাঁহাকে গো, মধুপৰ্ক, জল, গৃহ ও রাজ্য সমর্পণ করিলে অন্যান্য কৌরবগণ তাঁহাকে অর্চ্চনা করিতে লাগিলেন।
অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন কৃষ্ণকে ভোজন করিতে নিমন্ত্রণ করিলে তিনি তাহাতে সম্মত হইলেন না। তখন দুৰ্য্যোধন কর্ণের সমক্ষে শঠতাপূর্ণহৃদয়ে মৃদুবাক্যে বাসুদেবকে কহিলেন, “হে জনাৰ্দন! এই সমুদয় অন্ন, পান, বসন ও শয়ন আপনার নিমিত্তই আনীত হইয়াছে; আপনি কি নিমিত্ত ইহা গ্ৰহণ করিতেছেন না? আপনি আমাদের উভয় পক্ষে সাহায্যকারী ও হিতানুষ্ঠানপরায়ণ এবং আমার পিতার আত্মীয় ও দায়িত [প্রিয়]। আপনি ধর্ম্মার্থের তত্ত্ব যথার্থরূপে অবগত আছেন; অতএব আপনার নিকট উক্ত বিষয়ের কারণ অবগত হইতে ইচ্ছা করি।”
আতিথ্যপ্ৰত্যাখ্যানের কারণ প্ৰদৰ্শন
মহামতি গোবিন্দ দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণানন্তর তাঁহার বিপুল বাহু গ্ৰহণ করিয়া মেঘগম্ভীর নিস্বনে স্পষ্টাক্ষর অর্থপূর্ণ হেতুগর্ভ [যুক্তিপূর্ণ] বাক্যে কহিতে লাগিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! দূতগণ কাৰ্য্যসমাধান্তেই ভোজন ও পূজা গ্রহণ করিয়া থাকেন; অতএব আমি কৃতকাৰ্য্য হইলেই আপনার পূজা গ্রহণ করিব।”
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে মধুসূদন! আমাদিগের প্রতি এরূপ অনুচিত বাক্য প্রয়োগ করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। আপনি কৃতাৰ্থ হউন অথবা অকৃতাৰ্থই হউন, আমরা আপনাকে পূজা করিতে যত্ন করিব; কিন্তু আপনার পূজা করা আমাদের সাধ্য নহে। যাহা হউক, আমরা প্রীতিপূর্ব্বক পূজা করিলেও আপনি যে কি নিমিত্ত উহা গ্ৰহণ করেন না, ইহার যথার্থ কারণ কিছুই জানিতে পারিতেছি না। আপনার সহিত, আমাদের বৈরী [শত্ৰুতা] বা বিগ্ৰহ [কলহ] নাই; অতএব ঈদৃশ বাক্য প্রয়োগ করা আপনার একান্ত অনুচিত।”
তখন বাসুদেব ঈষৎ হাস্য করিয়া দুৰ্য্যোধনের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে কৌরব! আমি কাম, ক্ৰোধ, দ্বেষ, অর্থ, কপটতা বা লোভনিবন্ধন কদাচ ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে পারি না। লোকে হয় প্রীতিপূর্ব্বক অথবা বিপন্ন হইয়া অন্যের অন্ন ভোজন করে; আপনি প্রীতিসহকারে আমাকে ভোজন করাইতে বাসনা করেন নাই, আমিও বিপদগ্ৰস্ত হই নাই, তবে কি নিমিত্ত আপনার অন্ন ভোজন করিব? আপনি অকারণে প্রিয়ানুবর্ত্তী সর্ব্বগুণসম্পন্ন সোদরকল্প পাণ্ডবগণের দ্বেষ করিয়া থাকেন; উহা নিতান্ত অকর্ত্তব্য। পাণ্ডবগণ ধর্ম্মপথাবলম্বী; কাহার সাধ্য তাঁহাদিগকে কোন কথা কহে? যে ব্যক্তি পাণ্ডবগণের দ্বেষ করে, সে আমারও দ্বেষ্টা, আর যে ব্যক্তি তাঁহাদের অনুগত, সে আমারও অনুগত। ফলতঃ আমি পাণ্ডবগণ হইতে ভিন্ন নাহি। যে ব্যক্তি কাম, ক্ৰোধ বা মোহের বশবর্ত্তী হইয়া লোকের সহিত বিরোধ করিতে বাসনা করে ও গুণবানের দ্বেষ করে, সে নরাধম। যে ব্যক্তি কল্যাণকর গুণসম্পন্ন জ্ঞাতিগণকে অকারণে দুষ্ট [দুরভিপ্রায়সম্পন্ন] জ্ঞান ও তাহাদের ধন অপহরণ করিতে ইচ্ছা করে, সেই অজিতাত্মা দুরাচার কখনই চিরসঞ্চিতসম্পত্তি সম্ভোগ করিতে পারে না, আর গুণসম্পন্ন ব্যক্তি আপনার অপ্রিয় হইলেও যে তাহাকে প্রিয়াচরণদ্বারা বশীভূত করে, সে চিরকাল যশস্বী হইয়া থাকে। যাহা হউক, এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে, আপনি কোন দুরভিসন্ধি করিয়া আমাকে ভোজন করিতে অনুরোধ করিতেছেন; অতএব আমি কখনই আপনার এই সকল ভক্ষ্যসামগ্ৰী ভোজন করিব না; কেবল বিদুরের ভবনে ভোজন করাই আমার শ্ৰেয়ঃ বোধ হইতেছে।”
বিদুরগৃহে কৃষ্ণের অন্নভোজন
মহাবাহু বাসুদেব অমর্ষসম্পন্ন [ঈৰ্ষাপরায়ণ] দুৰ্য্যোধনকে এই কথা বলিয়া তাঁহাকে নিকেতন হইতে নির্গত হইয়া মাহাত্মা বিদুরের ভবনে গমন করিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বাহ্লীক ও অনেকানেক কৌরবগণ বিদুরভবনে তাহার সন্নিধানে গমন করিয়া তাঁহাকে আপনাদিগের ভবনে গমন করিতে অনুরোধ করিলে তিনি কহিলেন, “হে মহাত্মাগণ! আপনারা স্ব স্ব নিকেতনে গমন করুন; আমি আপনাদের সমুদয় পূজা প্রাপ্ত হইয়াছি।”
এইরূপে কৌরবগণ ভগবান বাসুদেবের নিয়োগানুসারে স্ব স্ব ভবনে প্রতিগমন করিলে মাহাত্মা বিদুর পরম যত্নসহকারে সর্বোপকরণদ্বারা কৃষ্ণকে পূজা করিয়া অতি পবিত্র বিবিধ সুমিষ্ট অন্ন ও পানীয় প্রদান করিলেন। মহাত্মা মধুসূদন সেই বিদূরপ্রদত্ত অন্নপানদ্বারা সর্ব্বাগ্রে বেদবিৎ ব্রাহ্মণগণকে পরিতৃপ্ত করিয়া বহুবিধ ধনসম্পত্তি প্ৰদানপূর্ব্বক পরিশেষে সুরগণসমবেত বাসবের ন্যায় অনুযায়ি[সহচর]গণসমভিব্যাহারে সেই ব্রাহ্মণগণের ভুক্তাবিশিষ্ট অন্ন ভোজন করিলেন।