কান্তিময় ব্যানার্জি আমেরিকায় চার বছর আছেন, এখনও তিনি বুধবার রাত্রে দাড়ি কামান। অর্থাৎ, কাজে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকদিন তাকে দাড়ি কামিয়ে যেতে হয়, কিন্তু লক্ষ্মীবার বৃহস্পতিবার তো ব্রাহ্মণের ছেলের চুল-দাড়ি-লোখ কিছুই কাটতে নেই, তাই বৃহস্পতিবারের জন্য তিনি বুধবারই বেশি রাত্রে দাড়ি কামিয়ে রাখতেন। অতদিন ধরে বিদেশে আছেন, কিন্তু একদিনও কারুর বাড়িতে নেমন্তন্ন খাননি, কারণ, কোথায় কে গরু শুয়োরের মাংস মিশিয়ে দেয়, ঠিক কি? আমি অবশ্য বলেছিলাম, সাহেব-সুবোরা ভারতীয়দের নেমন্তন্ন করলে আগে জিগ্যেস করেই নেয়, নিরামিষাশী কি না! আপনি তো নিরামিষ খান বললেই পারেন!
উঁহু। ওরা অনেক সময় রান্না করে চর্বির তেল দিয়ে, সেটা কীসের চর্বি তা কে জানে? এসব স্লেচ্ছদের ব্যাপারে বিশ্বাস আছে?
অনেক সময় অফিসের কাজে ওঁকে নানা জায়গায় যেতে হয়–তখন সেই ক’টা দিন তিনি শুধু ফল খেয়ে থাকেন। সঙ্গে রাখেন নিজের গ্লাস, অপরের মুখে দেওয়া গ্লাসে খাবার বদলে উনি বরং আত্মহত্যা করবেন। একবার একটি আমেরিকান ছেলে ওর ঘরে আড্ডা দিতে আসে, তখন আমিও ছিলাম। আমেরিকান ছেলে-ছোঁকরারা খুব বেশি ভদ্রতা মানে না, কথায়-কথায় হঠাৎ বলে ফেলল, কুড আই হ্যাভ আ কাপ অব টি?ইওর ইন্ডিয়ান টি?
কান্তিবাবুর ঘরে রান্নার এলাহি বন্দোবস্ত, কারণ রান্নাই তাঁর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান, অবসর সময়ে একমাত্র বিলাসিতা। কোন দোকানে টাটকা মাছ পাওয়া যাচ্ছে খুঁজে-খুঁজে বেড়ান প্রত্যেক সন্ধেবেলা, এবং দৈবাৎ টাটকা কাতলা মাছ পাওয়া গেলে সে খবর আবার দিয়েও আসতেন অন্য বাঙালি বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে।
কান্তিবাবু তৎক্ষণাৎ তিন কাপ চা বানিয়ে ফেললেন। খুব ভালো চা। কোনো পুরুষের হাতে তৈরি এত ভালো চা আমি আগে কখনও খাইনি।
আড্ডা শেষে আমেরিকান ছেলেটি উঠে যাওয়ার পর কান্তিবাবু ওর খাওয়া কাপটা অবলীলাক্রমে ময়লা-ফেলা ঝুড়িতে ফেলে দিলেন। আমি হাহা করে উঠে বললুম, ও কী, ও কী?
কান্তিবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, দ্যুৎ! এঁটো কাপে আর কে খাবে? আমার খাওয়া কাপটাও পরে উনি ফেলে দিয়েছিলেন কি না জানি না, কিংবা আমি ওঁর স্বজাত বলে দয়া করেছিলেন কে জানে। আমি আর ভয়ে জিগ্যেস করতে সাহস পাইনি। তবে, ওর বাড়িতে গিয়ে চা খাওয়া আমি এড়িয়ে গেছি এরপর।
কেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট পাওয়ার পর আমেরিকায় রিসার্চ করতে গেছেন, তাঁর এই অবস্থা। প্রতিদিন সন্ধেবেলা ল্যাবরেটরি থেকে ফিরে গলা থেকে টাইটা খুলতেন এমনভাবে, যেন একটা মরা সাপ ছুঁচ্ছেন। সেই সঙ্গে সাহেবদের পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করার জন্য গালাগাল। তারপর বাথরুমে ঢুকে আধঘণ্টা ধরে স্নান করে সাবান দিয়ে পৈতে মেজে, সন্ধ্যা আহ্নিক করতে বসতেন। আমি ওঁকে জিগ্যেস করেছিলুম, এত যখন শুচিবায়ু তখন আপনি এলেন কেন এদেশে?
টাকা! শুধু টাকা! দুলক্ষ টাকা জমুক আমার এদেশে–সঙ্গে-সঙ্গে ফিরে যাব!
আমি কান্তিবাবুর এসব স্বভাব মনেপ্রাণে অপছন্দ করতুম। কিন্তু ওঁর সঙ্গে তর্ক করতে গিয়ে দেখেছি সুবিধে হয়নি। উনি বলতেন, আপনি যা বলছেন সবই আমি জানি। ঠিক, আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু আমার সংস্কার আমি ছাড়তে পারি না।
তখন আমি ওঁকে সবিস্তারে আমার অখাদ্য কুখাদ্য খাবার গল্প করতুম! এসব সত্বেও যে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল তার কারণ পাশের বাড়িতে একজনের সঙ্গে বাংলায় কথা বলার সুযোগ। ঝগড়া করলেও তা বাংলায় করতুম। এবং কান্তিবাবুর একটি বিশেষ গুণ ছিল। উনি খুব ভালো বাংলা পল্লিগীতি জানতেন। অন্ধকার ঘরে বসে উনি যখন নীচু গলায় পদ্মাপারের ভাটিয়ালি গাইতেন, তখন আমেরিকার এক ক্ষুদ্র শহরে বসে, বাইরে বরফ পড়ছে, বাংলা দেশের জন্য আমার বুকটা হু-হুঁ করে উঠত।
শুচিবায়ু ছাড়াও কান্তিবাবুর আর একটি প্রধান দোষ ছিল, প্রতি কথায় আমেরিকানদের নিন্দে করা। আমেরিকানদের চরিত্রে নিন্দে করার অনেক জিনিস আছে, কিন্তু কান্তিবাবু যেগুলি বলতেন, আমি তার একটিও মানতে পারিনি। যেমন আমেরিকানরা ভদ্রতা জানে না। এ রকম অভদ্র জাত, দেখলেন দুম করে কীরকম চা খেতে চাইল? ছেলেমেয়েগুলো তো অসভ্যের একশেষ। আপনি তো কলেজে যান না, গেলে দেখতেন, ছোঁড়াগুলো ক্লাসের মধ্যে বসেই মাস্টারের সমানে সিগারেট টানছে। বেঞ্চির ওপর পা তুলে দিয়ে বসে আছে! একটু শ্রদ্ধা-ভক্তি নেই! ভদ্রতা শিখতে হয় ভারতবর্ষের কাছে! এই আমেরিকানদের আমরা কান ধরে ভদ্রতা সহবত শেখাতে পারি!
এসব কথা বলছেন যে কান্তিবাবু, তিনি বাড়িতে কোনও বিদেশি ডাকতে এলে দরজা খুলে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলেন, ভেতরে আসতে বলেন না পর্যন্ত। পাছে চা খাওয়াতে হয়।
আমি একদিন ওঁকে আমার দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম। বলে, জিগ্যেস করেছিলাম, এবার আপনি বলুন, এদের কাছ থেকে আমরা, না আমাদের কাছ থেকে এরা কে কতখানি ভদ্রতা শিখবে।
প্রথম ঘটনাটি খুব সামান্য। পোস্ট অফিসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম একটা প্যাকেট পাঠাব বলে। তখন ক্রিসমাসের সময় বিষম ভিড়। নারী-পুরুষ সবাই নিঃশব্দে লাইন দিয়ে আছে। লাইন আস্তে আস্তে এগুচ্ছে, কোথাও কোনও গোলমাল নেই।
কান্তিবাবু আমায় বাধা দিয়ে বললেন, এ আর এমন কী! আমাদের দেশের লোকেরাও আজকাল লাইন দিতে শিখেছে। না হয়, লাইনে দাঁড়িয়ে লোকেরা একটু গোলমাল করে। কিন্তু কী আর তফাত। আপনার সবতাতেই আদিখ্যেতা।
আমি হেসে বললুম, বাকিটা শুনুন। লাইন আস্তে আস্তে এগুচ্ছে। তখনও জনপঞ্চাশ মেয়ে পুরুষ দাঁড়িয়ে। হঠাৎ একটা লোক ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ঢুকল। এবং লাইনে না দাঁড়িয়ে সোজা কাউন্টারে চলে গেল। দুমিনিটের মধ্যে একটা প্যাকেট রেজিস্ট্রি করে, তৎক্ষণাৎ আবার চলে গেল। লাইন তখনও নিঃশব্দ। আবার এগুতে লাগল। এ ঘটনাকে আপনি কী বলবেন। একটা লোকও চেঁচিয়ে উঠল না, ও দাদা, লাইনে দাঁড়ান! আমরা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি কি মুখ দেখতে। কে হে তুমি খাঞ্জাখাঁ? ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কিছু বলেনি। সবাই নিঃশব্দ। এমন কী কাউন্টারে লোকটিও আপত্তি করেনি। কেন? কারণ সবাই ধরে নিয়েছে, লোকটির নিশ্চয়ই বিষম দরকার, লাইনে দাঁড়াবার সময় নেই। অথবা তা যদি নাও হয়; লোকটি অভদ্র হয়, তবুও অন্যেরা অভদ্র হয়ে গেল না। তারা চুপ করে রইল। ভদ্রতা একেই বলে। আর ভদ্রতার পরাকাষ্ঠার দেশ ভারতবর্ষে এ ব্যাপার হলে, লাইনের সবক’টা লোক হা-রে-রে-রে করে চেঁচিয়ে উঠত না?
আর একটি ঘটনা কলেজের। ঠিকই আমি কলেজে যাই না। কিন্তু এদেশের কলেজে পড়ানোর পদ্ধতিটা কী রকম তা দেখার জন্য আমি দু-একটা ক্লাসে গিয়েছিলাম। একদিন একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
খুব বড় ক্লাস, ছেলেমেয়েতে ভরতি। সত্যিই অনেক ছেলেমেয়ে বিড়ি-সিগারেট খাচ্ছে। অনেকের পা বেঞ্চির ওপর তোলা। কেউ কেউ যখন ইচ্ছে আসছে, যখন ইচ্ছে বেরিয়ে যাচ্ছে। জামাকাপড় অনেকের অদ্ভুত। এ সবই আমাদের চোখে দৃষ্টিকটু লাগে। কারণ আমাদের অন্যরকম দেখা অভ্যেস। কিন্তু এগুলো সবই হল চালচলন। এগুলিকে ভদ্রতা-অভদ্রতার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলা যায় না। ‘ভদ্রতা’ শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ অন্যরকম।
অধ্যাপক পড়াচ্ছেন। ক্লাস সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ। ছেলেমেয়েগুলো যতই দুর্দান্ত আর বদমাশ হোক, ক্লাসে কিন্তু এরা গণ্ডগোল করে না। মাঝে মাঝে দু-একজন প্রশ্ন করছে, যা শুনলেই বোঝা যায়, মনোযোগ দিয়ে পড়ানো না শুনলে এরকম প্রশ্ন করা যায় না।
বাইরে অবিশ্রান্ত বরফ পড়ছে, শূন্য ডিগ্রির অনেক নীচে শীত। ঝড়ের হাওয়া দিচ্ছে! এমন সময় আরেকজন ছাত্রী ঢুকল। সঙ্গে একটা কুকুর। আমি তো হতভম্ব হয়ে গেছি কুকুর নিয়েও ক্লাসে আসা যায় নাকি? সত্যি আমেরিকা দেখছি আজব দেশ। অধ্যাপক একবার চোখ তুলে তাকালেন কুকুর সমেত নবাগত ছাত্রীটির দিকে। তারপর আবার পড়াতে লাগলেন। ছাত্রছাত্রীরা কেউ একটি কথা বলল না।
কিন্তু অমন বন্ধ ঘরে অতগুলো মানুষের মধ্যে এসে কুকুরটা চুপ করে বসে থাকবে কেন? একটু বাদেই কুঁইকুই শব্দ আরম্ভ করে দিল! তারপর বেশ জোরে ডাক, সেই সঙ্গে শিকলের ঝনঝন। অধ্যাপক পড়ানো বন্ধ করলেন। ছাত্রছাত্রীরা চুপ। সেই ছাত্রীটি মুখ দিয়ে চুঃ-চুঃ শব্দ করে কুকুটাকে শান্ত করতে লাগল। আবার পড়ানো শুরু হল। একটু পরেই আবার ঘেউ করে কুকুরের ডাক। অধ্যাপক আবার পড়ানো বন্ধ করে হাতের আঙুল দেখতে লাগলেন। কুকুরটা একটু চুপ করতে অধ্যাপক আবার আরম্ভ করলেন। এরপর হঠাৎ কুকুরটা মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে ছুটে বেড়াতে লাগল ঘরময়, মেয়েটি উঠে পেছন-পেছন ছুটতে লাগল। তারপর শিকলটা ধরে ফেলে–আবার টেনে এনে বসল, কুকুরটা অবিশ্রান্তভাবে ঘেউঘেউ করে ডাকতে লাগল।
এই প্রথম অধ্যাপক তাঁর দুরূহ বিনয় ছেড়ে ছাত্রীটির দিকে তাকিয়ে অন্য কথা বললেন। একটু হেসে বললেন, ক্যাথরিন, তোমার কুকুরের বোধ হয় আমার পড়াননা পছন্দ হচ্ছে না। ও বোধহয় বাইরে যেতে চায়!
–কিন্তু বরফ পড়লে কুকুরটা যে তখন আমাকে ছাড়া একদম থাকতে চায় না!
–কিন্তু, তোমার কুকুরকে চুপ করাতে পারি, এমন বিদ্যে যে আমার নেই, ক্যাথরিন! তুমি না হয় ক্লাসটা আজ নাই করলে। তুমি যদি কুকুরটাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য
–বাঃ, এমন দামি ক্লাশটা আমি মিস করব নাকি?
–ওঃ, আচ্ছা! তাহলে, আজ বরফ পড়ার সময়, তোমার কুকুরের মেজাজ খারাপ বলে সেই সম্মানে আমাদের ক্লাস আজ এখানেই শেষ। ধন্যবাদ ক্যাথরিন। ক্লাস শেষ হয়ে গেল। ছাত্র-ছাত্রীরা কিন্তু সারাক্ষণ চুপ করেছিল–একটি কথাও বলেনি। অথচ ক্লাসটা ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। এ অবস্থায়, কান্তিবাবু আমাদের দেশের যে-কোনও কলেজের কথা ভেবে দেখুন। ক্লাশ শুষ্টু সবাই কি ওই সময়টা কুকুর ডাকত না? ওই ছাত্রীটি হয় অত্যন্ত অভদ্র অথবা কুকুর-প্রীতিতে পাগল। কিন্তু ওর অভদ্রতা দেখেও আপনার ওই সিগারেট খাওয়া, টেবিলে-পা-তোলা ছাত্রের দল একটুও অভদ্রতা করেনি। এমন কি অধ্যাপকও তাঁর ক্ষমতা দেখাবার জন্য চোখ-মুখ লাল করেননি। শেষ পর্যন্ত ভদ্রতা করেছেন। একেই বলে খাঁটি ভদ্রতা, যখন অপরের অভদ্রতা দেখলেও একজন নিজের ভদ্রতা হারায় না। এর তুলনায় আমাদের ভারতীয়, বা প্রাচ্য ভদ্রতা এখন প্রবাদ মাত্র। তার আর কোনও অস্তিত্ব নেই!