আসিয়া খগেন্দ্র কহে বন্দিয়া চরণ।
কি হেতু নিশাতে প্রভু করিলে স্মরণ।।
কি হেতু হইল আজি চিত্ত উচাটন।
শীঘ্রগতি কহ হরি তার বিবরণ।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, সখা পাণ্ডপুত্রগণ।
বসতি করেন যথা করিব গমন।।
এত বলি খগোপরি করি আরোহণ।
নিমিষেতে উপনীত যথা কাম্যবন।।
হেথায় আকুল চ্ত্তি ধর্ম্মের নন্দন।
হেনকালে আসিলেন হরি খগাসন।।
যুধিষ্ঠির শুনি তবে কৃষ্ণ আগমন।
পাইলেন প্রাণ যেন প্রাণহীন জন।।
ব্যগ্র হয়ে কতদূরে গিয়া পঞ্চ জনে।
নিকটেতে পাইলেন দৈবকী নন্দনে।।
আনন্দ বাড়িল তাঁর নাহিক অবধি।
দরিদ্র পাইল যেন মহারত্ন নিধি।।
আনন্দ অধীর অন্তরে দেন আলিঙ্গন।
আনন্দ সলিলে পূর্ণ হইল লোচন।।
পূর্ণ করি মানিলেন মন অভিলাষ।
অন্য অন্য সর্ব্বজনে করিল সম্ভাষ।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা কহ সমাচার।
যুধিষ্ঠির কহে, কৃষ্ণ কি কহিব আর।।
কহিতে বদনে মম নাহি স্ফুরে ভাষা।
এত রাত্রে শিষ্য সহ অতিথি দুর্ব্বাসা।।
প্রভাসের কূলে গেল সন্ধ্যার কারণ।
উপায় করিতে শক্য নহে কোন জন।।
সবংশে মজিনু আমি, বুঝি অভিপ্রায়।
কাতর হইয়া তেঁই ডাকিনু তোমায়।।
তোমা বিনা পাণ্ডবের আর কেহ নাই।
মম নিবেদন এই কহিলাম ভাই।।
রাখহ মারহ তব যাহা মনে লয়।
বিলম্ব না সহে বড় সঙ্কট সময়।।
যুধিষ্ঠির এত যদি কহে নারায়নে।
গোবিন্দ কহেন, চিন্তা না করিহ মনে।।
শিষ্যগণ সহ মুনি আসুক হেথায়।
সবাকারে ভুঞ্জাইব সে আমার দায়।।
এত বলি সানন্দিত করি ধর্ম্মমণি।
ত্বরিতে গেলেন কৃষ্ণ যথা যাজ্ঞসেনী।।
কৃষ্ণে দেখি দ্রৌপদীর পূরে অভিলাষ।
বসিতে আসন দিয়া কহে মৃদুভাষ।।
ভকতবৎসল প্রভু তুমি অন্তর্য্যামী।
দীনবন্ধু নাম সত্য জানিলাম আমি।।
কি জানি তোমার ভক্তি আমি হীনজ্ঞান।
বিপদে পড়িনু, প্রভু কর পরিত্রাণ।।
সন্ধ্যা করি যাবৎ না আইসে মহামুনি।
উচিত বিধান শীঘ্র কর চক্রপাণি।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, তাহা বিচারিব পাছু।
ক্ষুধায় শরীর পোড়ে খাই দেহ কিছু।।
বিলম্ব না সহে, মোরে অন্ন দেহ আনি।
পশ্চাৎ করিব যাহা কহ যাজ্ঞসেনী।।
কৃষ্ণা বলে, জানি নিজে সব সমাচার।
আপনি এমত কহ অদৃষ্ট আমার।।
অন্না দিতে আমি যদি হতেম ভাজন।
ঘোর নিশি তোমারে স্মরিব কি কারণ।।
ছল করি কহ কথা জানিয়া সকল।
বুঝিতে না পারি হরি মম কর্ম্মফল।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, তনু দহে যে ক্ষুধায়।
পাইলে উত্তম পরিহাসের সময়।।
কহিতে নাহিক শক্তি, স্থির নহে মন।
উঠ উঠ বিলম্বেতে নাহি প্রয়োজন।।
এত শুনি কহে দেবী দ্রুপদ তনয়া।
বুঝিতে না পারি দেব কেন কর মায়া।।
যখন হইল গত দশ দণ্ড নিশি।
ভুঞ্জিলেন সেইকালে যত দেব ঋষি।।
অবশেষে ছিল কিছু করিনু ভোজন।
শূন্যপাত্র আছে মাত্র দেখ নারায়ণ।।
দিন নহে, দ্বিতীয় প্রহর হৈল নিশি।
উপায় করিব কিবা আমি বনবাসী।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যাজ্ঞসেনী শুন বলি।
অবশ্য আছয়ে কিছু দেখ পাক স্থালী।।
রন্ধন ব্যঞ্জন অন্ন যে কিছু আছয়।
অল্পেতে হইব তৃপ্ত, কিছু হৈলে হয়।।
আলস্য ত্যজিয়া উঠ, করহ তল্লাস।
বিলম্ব না সহে আর, ছাড় পরিহাস।।
কৃষ্ণের বচন শুনি কৃষ্ণা গুণবতী।
দখাইতে পাকপাত্র আনে শীঘ্রগতি।।
আনিয়া দ্রৌপদী কহে, দেখ জগন্নাথ।
দেখিয়া কৌতুকে কৃষ্ণ পাতিলেন হাত।।
শাকের সহিত মাত্র এক অন্ন ছিল।
কৃষ্ণের প্রসাদ হেতু অনন্ত হইল।।
ভোজন করিয়া তৃপ্ত দেব দামোদর।
জলপান করিলেন, ভরিল উদর।।
কৌতুকে উঠিয়া তবে দেব জগন্নাথ।
উদগার করয়া দেন উদরেতে হাত।।
দ্রৌপদীরে কহিলেন, মোর ক্ষুধা গেল।
আজিকার ভোজনেতে মহাতৃপ্তি হৈল।।
ইহা বলি পুনঃ পুনঃ তুলেন উদগার।
ত্রিভুবনে সেই মত হইল সবার।।
সর্ব্বভূতে আত্মরূপে যেই নারায়ণ।
তাঁহার তৃপ্তিতে তৃপ্ত হইল ভুবন।।
হেথায় দুর্ব্বাসা ঋষি সহ শিষ্যগণ।
বুঝিতে না পারি কিছু ইহার কারণ।।
উদর পূরিল মন্দানলে সবাকার।
সঘনে নিশ্বাস বহে, উঠিছে উদগার।।
বিস্ময় মানিয়া তবে কহে মুনিরাজ।
নিকটে ডাকিয়া নিজ শিষ্যের সমাজ।।
মুনি বলে, শুন শুন সব শিষ্যগণ।
বুঝিতে না পারি কিছু ইহার কারণ।।
অকস্মাৎ হল দেখ উদর আধ্নান।
পাইতেছি যত কষ্ট নাহি পরিমাণ।।
অনুমান করি কিছু না পারি বুঝিতে।
পথ পরিশ্রমে কিবা বায়ু বৃদ্ধি হৈতে।।
শিষ্যগণ বলে, যাহা কৈলে মহাশয়।
আমা সবাকার মনে হইল বিস্ময়।।
সন্ধ্যা হেতু আসি যবে প্রভাসের জলে।
শরীর দহিতেছিল ক্ষুধার অনলে।।
অকস্মাৎ এই মত হৈল সবাকার।
উদর পূরণে যন উঠিছে উদগার।।
অন্য অন্যে বিচার করেন জনে জন।
কেহ না কহিল কারে লজ্জার কারণ।।
মুনি বলে মহাশ্চর্য্যে ডুবে মম মন।
ব্রহ্মাণ্ড ভাবিয়া কিছু না পাই কারণ।।
যখন সন্ধ্যায় আসি প্রভাসের তীরে।
রন্ধন করিতে বলিলাম যুধিষ্ঠিরে।।
সংগ্রহ করিল তারা করি প্রাণপণ।
কোন্ লাজে গিয়া তারে দেখাব বদন।।
বুঝিয়া বিধান তবে করহ বিচার।
শিষ্যগণ বলে, প্রভু কি কহিব আর।।
আজি তথা গিয়া লজ্জা পাব কি কারণ।
উঠিতে শকতি নাহি কে করে ভোজন।।
ঈশ্বর করিলে কালি উঠিয়া প্রত্যূষে।
অতিথি হইয়া যাব পাণ্ডব সকাশে।।
ইহার উপায় আর নাহি মহাশয়।
মুনি বলে, এই কথা মম মনে লয়।।
বঞ্চিব রজনী আজি প্রভাসের কূলে।
যে কিছু কর্ত্তব্য কালি করিব সকলে।।
এত বলি সবে তবে করিল শয়ন।
জানিলেন সব তত্ত্ব দৈবকী নন্দন।।
কৃষ্ণা সহ যান কৃষ্ণ যথা যুধিষ্ঠির।
সবার সম্মূখে কহে দেব যদুবীর।।
শুন শুন ধর্ম্মরাজ করি নিবেদন।
দ্রৌপদী প্রস্তুত কৈল করিয়া রন্ধন।।
সকল সম্পূর্ণ হৈল বিলম্ব কি আর।
ভীমেরে করহ আজ্ঞা মুনি ডাকিবার।।
শুনিয়া কৃষ্ণের কথা পাণ্ডব নন্দন।
আশ্চর্য্য তখন রাজা ভাবে মনে মন।।
প্রস্তুত হইল সব কারণ জানিল।
মুনিরে ডাকিতে রাজা ভীমে আজ্ঞা দিল।।
কত দূরে গিয়া ডাকে পবন-নন্দন।
আকাশ ভাঙ্গিয়া যেন ভীমের গর্জ্জন।।
শীঘ্র এস মুনিগণ, বিলম্বে কি কাজ।
প্রস্তুত হয়েছে সব, ডাকে ধর্মরাজ।।
ভীমের পাইয়া শব্দ যত মুনিগণ।
শীঘ্রগতি মিলি সবে দুর্ব্বাসারে কন।।
শুন শুন ডাকে অই পবন-নন্দন।
ইহার উপায় মুনি কি হবে এখন।।
এই রাত্রে যদি সবে করিব ভোজন।
চলিতে না হবে শক্তি হইবে মরণ।।
নাহি গেলে মহাবীর আসিবে হেথায়।
মনেতে ভাবিয়া মুনি করহ উপায়।।
তুমি না করিলে ত্রাণ কে করিবে আর।
পলাইতে শক্তি নাই তুমি কর পার।।
সকলে পাইল ভয় যত ঋষি মুনি।
অন্তরে জপেন নাম রাখ চক্রপাণি।।
উদর হয়েছে ভারি, উঠিছে উদগার।
এ সময়ে যদুনাথ সবে কর পার।।
এইমত বহু স্তব কৈল সর্ব্ব জন।
ভীমেরে ডাকেন কৃষ্ণ শুনহ বচন।।
পথশ্রমে নিদ্রায় আছেন মুনিগণ।
নিদ্রাভঙ্গ নাহি কর পবন নন্দন।।
শুনিয়া কৃষ্ণের আজ্ঞা পবন নন্দন।
তথা হৈতে ধর্ম্ম কাছে যান ততক্ষণ।।
অনন্তর মিষ্ট বাক্যে কহে জগন্নাথ।
আনন্দেতে যাহ নিদ্রা পাণ্ডবের নাথ।।
মুনির কারণ মনে না করিহ ভয়।
আজি না আসিবে মুনি জানিহ নিশ্চয়।।
স্নান দান করি কালি প্রভাসের জলে।
ভোজন করিবে সবে আসিয়া সকালে।।
শুনিয়া কৃষ্ণের মুখে এতেক বচন।
ধর্ম্ম বলেন বিলম্ব তাই এতক্ষণ।।
তোমার অসাধ্য দেব আছে কোন্ কর্ম্ম।
পাণ্ডবকুলের আজি হৈল পুনর্জ্জন্ম।।
বিস্তর কহিয়া আর নাহি প্রয়োজন।
সহায় সম্পদ মম তুমি নারায়ণ।।
না জানি পূর্ব্বেতে কত করিনু কুকর্ম্ম।
সে কারণে দুঃখে শোকে গেল মম জন্ম।।
প্রথম বয়সে বিধি দিল নানা শোক।
অল্পকালে পিতা মম গেল পরলোক।।
গোঁয়াইনু সেইকালে পরের আলয়।
দুঃখ না জানিনু অতি অজ্ঞান সময়।।
তদন্তরে দুষ্টবুদ্ধি দিলেক যন্ত্রণা।
জতুগৃহে প্রাণ পাই বিদুর-মন্ত্রণা।।
বনের অশেষ দুঃখ ভ্রমণ সঙ্কটে।
আপনি রাখিলে ধৃতরাষ্ট্রের কপটে।।
এ সব সঙ্কট হতে তুমি মাত্র ত্রাতা।
এমত সংযোগ আনি করিল বিধাতা।।
রাজ্যনাশ বনবাস হীন সর্ব্ব ধর্ম্মে।
বিধির নিযুক্ত এই পূর্ব্বমত কর্ম্মে।।
সবে মাত্র পূর্ব্ববংশে ছিল উগ্রতপা।
কেবল তাহার ফলে তুমি কর কৃপা।।
এতেক কহেন যদি ধর্ম্মের নন্দন।
তদন্তরে কহিলেন দেব নারায়ণ।।
শুন ধর্ম্মসুত যুধিষ্ঠির নৃপমণি।
কহিলে যতেক কথা সব আমি জানি।।
পাইলে যতেক দুঃখ অন্যথা না হয়।
কিন্তু তুমি ধর্ম্ম নাহি ত্যজ মহাশয়।।
আর যে কহিলে, তুমি হীন সর্ব্বধর্ম্মে।
পৃথিবী পবিত্র হৈল তোমার সুকর্ম্মে।।
দান ধর্ম্মে রাজনীতে এ তিন ভুবনে।
আছয়ে তোমার তুল্য, নাহি লয় মনে।।
দুর্ব্বলের বল ধর্ম্ম, আমি জানি ভালে।
এই দুঃখ তোমার খণ্ডিবে অল্পকালে।।
অধর্ম্মী জনের সুখ কভু স্থায়ী নয়।
জোয়ারের জল প্রায় ক্ষণকাল রয়।।
মনেতে রাখিবে মম এই নিবেদন।
মহাকষ্টে সত্য নাহি ছেড়ো কদাচন।।
এত বলি জনার্দ্দন লইয়া বিদায়।
গরুড় উপরে চড়ি যান দ্বারকায়।।
কৃষ্ণেরে বিদায় করি ভাই পঞ্চ জন।
হৃষ্ট মনে সবে তবে করেন শয়ন।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে রচে কাশীরাম দাস।।