৮৮তম অধ্যায়
অষ্টম-দিবসীয় যুদ্ধ-কৌরবব্যূহরচনা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে নরনাথ! এইরূপে সেই উভয়পক্ষীয় বীরপুরুষগণ নিদ্রাসুখ অনুভব ও রজনী অতিবাহিত করিয়া প্ৰভাতে পুনরায় যুদ্ধাৰ্থ নিৰ্গত হইলেন। উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণের যুদ্ধযাত্রাকালে সাগরধ্বনিসদৃশ তুমুল কোলাহল সমুত্থিত হইল। তখন মহারাজ দুৰ্য্যোধন চিত্ৰসেন, বিবিংশতি, রথিশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম ও মহাবলরাক্রান্ত দ্রোণাচাৰ্য্য একত্র মিলিত হইয়া ব্যূহরচনা করিতে লাগিলেন। কৌরবশ্রেষ্ঠ শান্তনুতনয় সাগরসদৃশ মহাব্যূহ নির্ম্মাণপূর্ব্বক স্বয়ং মালব, আবন্ত্য ও দাক্ষিণাত্যগণসমভিব্যাহারে সর্ব্বসৈন্যের অগ্রবর্ত্তী হইয়া গমন করিলেন। তৎপশ্চাৎ প্রতাপশালী দ্রোণ পুলিন্দ, পারদ ও ক্ষুদ্রক মালবগণসমভিব্যাহারে; তৎপশ্চাৎ প্রবল ভগদত্ত মাগধ, কলিঙ্গ ও পিশাচগণসমভিব্যাহারে; তৎপশ্চাৎ কোশলাধিপতি বৃহদ্বল মেনক, ত্রৈপুর ও চিচ্ছিলগণসমভিব্যাহারে; তৎপশ্চাৎ প্রস্থলাধিপতি ত্ৰৈগর্ত্ত বহুতর কাম্বোজ ও যবনসমভিব্যাহারে; তৎপশ্চাৎ অশ্বত্থামা সিংহনাদে ধরাতল নিনাদিত করিয়া; তৎপশ্চাৎ মহারাজ দুৰ্য্যোধন সর্ব্বসৈন্য ও সোদরগণে পরিবৃত হইয়া এবং তৎপশ্চাৎ কৃপ গমন করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই সাগরসদৃশ মহাব্যূহ গমন করিতে আরম্ভ করিলে, তন্মধ্যে সমুদয় পতাকা, শ্বেতচ্ছত্র, বিচিত্র অঙ্গদ ও মহার্হ শরাসন শোভা পাইতে লাগিল।
পাণ্ডবব্যূহরচনা
“হে মহারাজ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই কৌরবপক্ষীয় মহাব্যূহ অবলোকন করিয়া সত্বর স্বীয় পৃতনাপতি [সেনাপতি], ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিলেন, “হে মহাধনুৰ্দ্ধর! ঐ দেখ, কৌরবেরা সাগরসদৃশ ব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়াছে; অতএব তুমিও অচিরাৎ প্রতিব্যূহ প্রস্তুত কর।” পাঞ্চালতনয় যুধিষ্ঠিরের নির্দেশানুসারে পরব্যূহবিনাশন মহান শৃঙ্গাটক[চতুষ্পথাকার-চারিটি পথসমন্বিত]-ব্যূহ রচনা করিলেন। ঐ ব্যূহের শৃঙ্গদ্বারে অনেক সহস্ৰ রথ, অশ্ব ও পদাতিসমবেত মহারথ ভীম ও সাত্যকি, নাভিদেশে শ্বেতাশ্ব বানরকেতু ধনঞ্জয় এবং মধ্যস্থলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও মাদ্রীনন্দনদ্বয় অবস্থান করিতে লাগিলেন; ব্যূহশাস্ত্ৰবিশারদ মহাধনুৰ্দ্ধর অন্যান্য ভূপতিগণ সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সেই ব্যূহ পরিপূরিত করিলেন। ব্যূহের পশ্চাদভাগে মহারথ অভিমন্যু, বিরাট, দ্রৌপদীতনয়গণ ও হিড়িম্বাতনয় ঘটোৎকচ অবস্থিত হইলেন। জয়াভিলাষী পাণ্ডবগণ এইরূপে মহাব্যূহ, রচনা করিয়া যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইয়া রহিলেন। চতুর্দ্দিকে তুমুল ভেরীশব্দ, শঙ্খনিঃস্বন, সিংহনাদ, আস্ফোটন [বীরদর্পসহকারে স্বশরীরে করতলাঘাতে শব্দকরণ] ও উৎক্রোশ [উচ্চ চীৎকার] হইতে লাগিল।
উভয়পক্ষীয় বীরগণের পরস্পর সংঘর্ষ
“তখন মহাবীরগণ পরস্পর মিলিত হইয়া পরস্পরের প্রতি অনিমেষলোচনে দৃষ্টিপাত করিয়া প্রথমে মনে মনে যুদ্ধকল্পনা করিয়া পশ্চাৎ পরস্পরকে আহ্বানপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। উভয়পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ব্যাদিতবদন [মুখ হাঁ করা] অতি ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ নিশিত নারাচ নিকর, ঘনঘটাবিনিঃসৃত [মেঘগর্জ্জন হইতে নিৰ্গত] দেদীপ্যমান বিদ্যুৎসদৃশ তৈলধৌত সুশাণিত শক্তিসমুদয় ও গিরিশৃঙ্গসদৃশ বিমল পট[বস্ত্ৰনির্ম্মিত আবেষ্টন]সমাচ্ছাদিত স্বৰ্ণভূষিত গদাসকল চতুর্দ্দিক হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। নির্ম্মল নভোমণ্ডলসন্নিভ নিস্ত্রিশসমুদয় ও ঋষভচর্ম্মবিনিন্দিত [বৃষচর্ম্ম হইতেও শক্ত] শতচন্দ্ৰ, শোভিত চর্ম্ম[ঢাল]সকল ইতস্ততঃ পতিত হইয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ পরস্পর তুমুল সংগ্রামে প্রবৃত্ত দেবাসুর সৈন্যের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। রথি ভূপতিগণ যুগদ্বারা বিপক্ষ রথিগণের যুগ আক্রমণপূর্ব্বক সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। যুধ্যমান দন্তিগণের দন্তসংঘর্ষসঞ্জাত সধূম হুতাশন চতুর্দ্দিকে দৃষ্ট হইতে লাগিল। কোন কোন গজারোহী প্রাসদ্বারা অভিহিত ও ভূতলে নিপতিত হইয়া গিরিশৃঙ্গ হইতে পতিত বৃক্ষনিচয়ের ন্যায় শোভিত হইল। বিচিত্ররূপধারী পদাতিগণ নখর [নখের মত তীক্ষ্নশর] ও প্রাসদ্বারা বিপক্ষপক্ষীয় পদাতিদিগকে নিহত করিতে লাগিল। এইরূপে কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় সেনাগণ পরস্পর মিলিত হইয়া নানাবিধ শরে পরস্পর সংহার করিতে আরম্ভ করিল।
“তখন মহাবীর শান্তনুতনয় রথঘোষে [রথশব্দে] রণস্থল প্রতিধ্বনিত ও শরাসনশব্দে পাণ্ডবগণকে বিমোহিত করিয়া সমুপস্থিত হইলেন। ধৃষ্টদ্যুন্নপ্রভৃতি পাণ্ডবপক্ষীয় রথিগণও ভীষণ ধ্বনি করিয়া যুদ্ধে গমন করিলেন। পরে উভয়পক্ষীয় নর, অশ্ব ও হস্তিসমুদয় পরস্পর মিলিত হইয়া ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে লাগিল।”