০৮৭. ভীষ্ম-যুধিষ্ঠিরসমর

৮৭তম অধ্যায়

ভীষ্ম-যুধিষ্ঠিরসমর

সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনার পুত্ৰ বিকৰ্ণ ভগ্নরথ মনস্বী চিত্ৰসেনের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে রথে আরোপিত করিলেন। তুমুল সঙ্কুল সংগ্রামে শান্তনুতনয় ভীষ্ম সত্বর যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবমান হইলে বহুলনাগাশ্বরথসমবেত [বহু অশ্বগজরথযুক্ত] সৃঞ্জয়গণ তদর্শনে কম্পিত হইয়া উঠল এবং মনে মনে স্থির করিল। যে, ‘ধর্ম্মরাজ কৃতান্তের মুখে নিপতিত হইয়াছেন।’ এদিকে মহারাজ যুধিষ্ঠির মাদ্রীনন্দনদ্বয়সমভিব্যাহারে মহাধনুৰ্দ্ধর শান্তনুতনয়ের অভিমুখীন হইলেন এবং মেঘ যেমন দিবাকরকে আচ্ছাদিত করে, তদ্রূপ শরনিকরদ্ধারা ভীষ্মকে আচ্ছাদিত করিলেন। মহাবীর ভীষ্ম সেই যুধিষ্ঠির প্রমুক্ত সহস্ৰ-সহস্র শর অনায়াসে সহ্য করিয়া অসংখ্য শরসন্ধান করিতে লাগিলেন। ভীষ্মনিক্ষিপ্ত শরনিকর আকাশমণ্ডলে পক্ষিকুলের ন্যায় দৃষ্ট হইতে লাগিল। মহাবীর শান্তনুতনয় নিমেষমধ্যে যুধিষ্ঠিরকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন ও অদৃশ্য করিলেন [বাণে বাণে ঢাকিয়া ফেলিলেন]।

“তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির ক্ৰোধাভরে ভীষ্মের প্রতি আশীবিষসদৃশ এক নারাচ নিক্ষেপ করিলে মহারথ শান্তনুতনয় সেই যুধিষ্ঠিরনিক্ষিপ্ত কালসদৃশ নারাচ অৰ্দ্ধপথে ছেদনপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজের কাঞ্চনভূষণবিভূষিত অশ্বসমুদয় নিহত করিলেন। ধর্ম্মনন্দন সেই হতাশ্বরথ পরিত্যাগপূর্ব্বক সত্বর মহাত্মা নকুলের রথে সমারূঢ় হইলেন। তখন অরাতিকুলনিপাতন শান্তনুতনয় সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া মাদ্রীনন্দনদ্বয়ের সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে শরজালে সমাচ্ছাদিত করিতে লাগিলেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির সেই যমজ ভ্রাতৃদ্বয়কে ভীষ্মের শরে নিতান্ত নিপীড়িত দেখিয়া তাঁহাকে নিধন করিবার নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি চিন্তিত হইলেন; পরে স্বীয় সুহৃৎ ভূপতিগণকে শান্তনুতনয়ের নিধনাৰ্থ আদেশ করিলেন।

ভীষ্মের বিরুদ্ধে বহু ভূপতির অভিযান

“ভূপতিগণ যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাপ্ৰাপ্ত হইবামাত্র রথসমুদয় লইয়া ভীষ্মকে বেষ্টন করিলেন। মহাবীর শান্তনুতনয় এইরূপে সেই ভূপতিগণকর্ত্তৃক চতুর্দ্দিকে পরিবৃত হইয়া ক্ৰোধভরে শরাসন সঞ্চালনপূর্ব্বক সেই মহারথগণকে নিপাতিত করিয়া সঞ্চরণ করিতে লাগিলেন। তখন পাণ্ডবগণ অরণ্যে মৃগকুলমধ্যস্থ [হরিণদলমধ্যস্থিত] মৃগরাজশিশুর [সিংহশাবক] ন্যায় তাঁহাকে অবলোকন করিতে লাগিলেন এবং মৃগযূথ যেমন মৃগপতিকে নিরীক্ষণ করিয়া ভীত হয়, তদ্রূপ মহাবীর ভীষ্ম সমরে শূরগণকে তৰ্জিত [বীরদৰ্পে দুর্ব্বল] ও সায়কদ্বারা সংত্রাসিত করিতেছেন দেখিয়া সাতিশয় ভীত হইলেন। ক্ষত্ৰিয়গণ কক্ষদহনাভিলাষী পবনসহায় হুতাশনের গতির ন্যায় শান্তনুতনয়ের গতি অবলোকন করিতে লাগিলেন। যেমন সুনিপুণ ব্যক্তি তালতরু হইতে পরিপকক্ক ফলসমুদয় পাতিত করে, তদ্রূপ মহাবীর ভীষ্ম রথিগণের মস্তক নিপাতিত করিলেন। বীরগণের মস্তক ভীষ্মের শরে ছিন্ন হইয়া ধরণীতলে নিপতিত হওয়াতে প্রস্তরপতনশব্দের ন্যায় তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইল।

“হে মহারাজ! সেই দারুণ সংগ্রাম ক্রমে ক্রমে তুমুল হইয়া উঠিলে সমুদয় সৈন্যগণ পরস্পর মিলিত হইল, সেনাগণের পরস্পর মিলনে ব্যূহ ছিন্নভিন্ন হইলে ক্ষত্ৰিয়গণ এক-এক জন এক-এক জনকে আহ্বানপূর্ব্বক সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। দ্রুপদতনয় শিখণ্ডী ভীষ্মকে লক্ষ্য করিয়া ‘থাক্‌ থাক্‌’ বলিয়া তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলে মহাবীর শান্তনুতনয় শিখন্ডীর স্ত্রীত্ব চিন্তা করিয়া তাহার প্রতি অনাদর প্রকাশপূর্ব্বক সৃঞ্জয়গণের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। সৃঞ্জয়গণ ভীষ্মকে সমাগত দেখিয়া হৃষ্টচিত্তে সিংহনাদ ও শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় ভগবান ভাস্কর পশ্চিমদিক অবলম্বন করিলেন। উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণের ঘোর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল।

“মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও মহারথ সাত্যকি অসংখ্য শক্তি, তোমর ও সায়কদ্বারা কৌরবসৈন্যগণকে পীড়ন করিতে লাগিলেন। সৈন্যগণ তাঁহাদের শরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াও বীরজনোচিত বুদ্ধিপ্রভাবে সমর পরিত্যাগ না করিয়া উৎসাহসহকারে শক্রসংহারে প্রবৃত্ত হইল।

কৌরব-পাণ্ডব পরস্পর যুদ্ধ-কৌরবপলায়ন

“অনন্তর তাহারা মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নের শরে একান্ত আহত হইয়া ঘোরতর চীৎকার করিতে লাগিল। তখন অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ সেই সৈন্যগণের চীৎকারধ্বনি শ্রবণ করিয়া সত্বর ধৃষ্টদ্যুম্নের অভিমুখীন হইলেন এবং অবিলম্বে অশ্বসমুদয় বিনষ্ট করিয়া তাঁহাকে শরজালে সমাচ্ছাদিত করিলেন। তখন মহাবীর পাঞ্চালরাজতনয় অবিলম্বে সেই অশ্বশূন্যরথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক মহাত্মা সাত্যকির রথে সমারূঢ় হইলেন। ধর্ম্মানন্দন যুধিষ্ঠির ক্ৰোধাভরে মহতী সেনাসমভিব্যাহারে বিন্দ ও অনুবিন্দের সমীপে গমন করিলেন। তদর্শনে মহারাজ দুৰ্য্যোধন সসৈন্যে বিন্দ ও অনুবিন্দের রক্ষার্থে তাঁহাদিগকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক অবস্থান করিতে লাগিলেন।

“এদিকে মহাবীর ধনঞ্জয় দানবদলনসমুদ্যত পুরন্দরের ন্যায় ক্ৰোধাভরে ক্ষত্ৰিয়গণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। দুৰ্য্যোধনের প্ৰিয়চিকীর্ষু দ্রোণাচাৰ্য্যও ক্রোধান্বিতচিত্তে অনলের তুলারাশি-দহনের ন্যায় পাঞ্চলগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধনপ্রমুখ ধাৰ্তরাষ্ট্ৰগণ ভীষ্মকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের সহিত সংগ্ৰাম করিতে আরম্ভ করিলেন।

“মরীচিমালী ভগবান ভাস্কর ক্ৰমে ক্ৰমে লোহিতবর্ণ হইয়া অস্তাচলচুড়াবলম্বী হইলে মহারাজ দুৰ্য্যোধন কৌরবসৈন্যগণকে সত্বর হইতে আদেশ করিলেন। সৈন্যগণ তদনুসারে সংগ্রামস্থলে অসাধারণ বলবিক্রম প্রকাশ্যপূর্ব্বক দুষ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিলে অতি ভীষণ তরঙ্গসমাকুল রুধিরনদী প্রবাহিত হইতে লাগিল; অশিব শিবাকুল [অমঙ্গলসূচক শৃগালদল] ভৈরব রব করিয়া উহার তীরে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। রাক্ষস, পিশাচপ্রভৃতি বিবিধ অসংখ্য পিশতাশন [মাংসাশী] ইতস্ততঃ দৃষ্ট হইতে লাগিল। এইরূপে ভূতসমূহসমাকুল সেই সমর অতি ভীষণ হইয়া উঠিল।

“অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় সুশর্ম্মাপ্রভৃতি সসৈন্য ভূপতিগণকে এবং ভীমসেন দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি রথিগণকে পরাজয় করিয়া শিবিরাভিমুখে গমন করিলেন। কুরুকুলচূড়ামণি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণকে সমভিব্যাহারে লইয়া এবং সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন যোদ্ধৃগণের সহিত মিলিত হইয়া স্কন্ধাবারে [শিবিরে] গমন করিতে লাগিলেন। এদিকে রাজা দুৰ্য্যোধন শান্তনুতনয় এবং দ্ৰোণ, অশ্বত্থামা, কৃপ, শল্য ও কৃতবর্ম্মা সৈন্যগণকে সমভিব্যাহারে লইয়া শিবিরাভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। কৌরবগণ ও পাণ্ডবগণ নিশাকালে প্রথমে একত্ৰ মিলিত হইয়া পরে স্ব স্ব শিবিরে প্রতি গমনপূর্ব্বক পরস্পর যথাবিহিত সম্মানপ্রদর্শন, শূরগণের রক্ষা, যথাবিধি গুল্ম[সৈন্যগণের ঘাঁটি বা থানা]সংস্থাপন, গাত্রের শল্য অপনয়ন ও বিভিন্ন জলে স্নান করিয়া গীতবিদ্যাদিদ্বারা আমোদপ্রমোদ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণগণ তাঁহাদের স্বস্ত্যয়ন ও বন্দিগণ স্তব করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময়ে কৌরব ও পাণ্ডবগণের শিবির স্বৰ্গসদৃশ বোধ হইতে লাগিল। বীরপুরুষগণ কেহ যুদ্ধবিষয়ক কোন কথাই উত্থাপন করিলেন না। যোদ্ধৃগণ এইরূপে ক্ষণকাল আমোদপ্রমোদ করিয়া নিদ্রিত এবং হস্তী ও অশ্বসকল প্রসুপ্ত হইলে সেই সমরশ্রান্ত উভয় সৈন্য অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল।”