৮৭তম অধ্যায়
চতুর্দ্দশদিন যুদ্ধ – সূচীব্যূহে জয়দ্রথসংস্থাপন
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! সেই রজনী প্রভাত হইলে শস্ত্রধারিগণের অগ্রগণ্য মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য স্বীয় সৈন্য সমুদায় লইয়া ব্যূহ রচনা করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় মহাবল পরাক্রান্ত অমর্ষপূর্ণ সৈন্যগণের নানা প্রকার কোলাহল শ্রবণ গোচর হইতে লাগিল। উহাদের মধ্যে অনেকে শরাসন বিস্ফারণ এবং কেহ কেহ জ্যা পরিমার্জ্জন ও নিশ্বাস পরিত্যাগ করত ধনঞ্জয় কোথায় বলিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল; কেহ কেহ কোষ নিষ্কাশিত সুনিৰ্ম্মিত উৎকৃষ্ট মুষ্টি সম্পন্ন আকাশ- সন্নিভ, নিশিত অসি নিক্ষেপ করিতে লাগিল; সহস্র সহস্র বীর সংগ্রাম করিবার মানসে অসিমার্গে ও শরাসনমার্গে বিচরণ পূর্ব্বক শিক্ষানৈপুণ্য প্রদর্শনে প্রবৃত্ত হইল; কেহ কেহ চন্দন দিগ্ধ স্বর্ণ ও হীরকে বিভূষিত ঘণ্টাসংযুক্ত গদা উৎক্ষেপণ পূর্ব্বক অর্জ্জুনকে আহ্বান করিতে লাগিল; কেহ কেহ বলমদে উন্মত্ত হইয়া উচ্ছ্রিত ইন্দ্র ধ্বজ সদৃশ পরিঘদ্বারা আকাশমার্গ আচ্ছাদন করিয়া ফেলিল এবং অনেকে সংগ্রাম মানসে বিচিত্র মাল্যে বিভূষিত হইয়া নানা প্রহরণ ধারণ পূর্ব্বক ‘অর্জ্জুন কোথায়, মানী ভীমসেন কোথায়?’, কৃষ্ণ কোথায়, এবং তাঁহাদের সুহৃদৰ্গই বা কোথায় বলিয়া মহা অস্ফালন করিতে আরম্ভ করিল।
তখন মহাবীর দ্রোণাচার্য্য শঙ্খনিনাদ ও স্বয়ং অশ্ব সঞ্চালনপূর্ব্বক প্রবল বেগে পরিভ্রমণ করত ব্যূহরচনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর সমরোৎসাহী দ্রোণ, সৈন্যগণ যথা স্থানে সন্নিবেশিত হইলে জয়দ্রথকে কহিলেন, ‘হে সিন্ধুরাজ! তুমি সৌমদত্তি, মহারথ কর্ণ, অশ্বত্থামা, শল্য, বৃষসেন, কৃপ, এক লক্ষ অশ্ব, ষড়যুত রথ, চতুর্দ্দশ সহস্র মত্ত হস্তি ও একবিংশতি সহস্ৰ বৰ্মধারী পদাতি লইয়া আমার ছয় ক্রোশ অন্তরে অবস্থান কর। তথায় পাণ্ডবের কথা দূরে থাকুক, ইন্দ্রাদি দেবগণও তোমাকে আক্রমণ করিতে সমর্থ হইবেন না অতএব তুমি আশ্বাসিত হও। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ দ্রোণের বাক্যে আশ্বাসিত হইয়া গান্ধার দেশীয় মহারথ ও বৰ্মধারি প্রাসপাণি অশ্বারোহিগণ সমভিব্যাহারে দ্রোণ নির্দ্দিষ্ট স্থানে গমন করিলেন। চামরালঙ্কৃত সুবর্ণ বিভূষিত ত্রিসহস্র সিন্ধুদেশীয় অশ্ব ও সপ্ত সহস্র অন্যবিধ অশ্ব তাঁহার সমভিব্যাহারে গমন করিতে লাগিল।
হে মহারাজ! তখন আপনার পুত্র দুৰ্ম্মৰ্ষণ সুনিপুণ আরোহি-সমারূঢ় বৰ্মধারী ভীষণাকার সার্দ্ধ-সহস্র মত্তমাতঙ্গ লইয়া যুদ্ধার্থে সমুদায় সৈন্যের অগ্রভাগে অবস্থান করিতে লাগিলেন। আপনার পুত্র দুঃশাসন ও বিকর্ণ সিন্ধুরাজের অর্থসিদ্ধির নিমিত্ত অগ্রগামী সৈন্যগণের মধ্যে রহিলেন। ঐ সময় মহাবীর দ্রোণাচার্য্য মহাবল পরাক্রান্ত অসংখ্য ভূপতি এবং বহুসংখ্য রথ, অশ্ব, গজ ও পদাতি দ্বারা এক ব্যূহ রচনা করিলেন। ঐ ব্যূহের পূৰ্বার্দ্ধ শকটাকার ও পশ্চার্দ্ধ চক্রাকার। উহার দৈর্ঘ্য চতুর্বিংশতি ক্রোশ ও পশ্চার্দ্ধের বিস্তৃতি দশ ক্রোশ। মহাবীর দ্রোণ ঐ ব্যূহের পশ্চার্দ্ধস্থিত পদ্মকৃতি ব্যূহমধ্যে সূচী নামে দুর্ভেদ্য গুঢ় এক ব্যূহ নির্ম্মাণ করিলেন। ধনুর্ধারী মহাবীর কৃতবর্ম্মা সূচীমুখে সমবস্থিত হইলেন, কৃতবর্ম্মার পশ্চাৎ কাম্বোজ ও জলসন্ধ এবং তৎপশ্চাৎ রাজা দুৰ্য্যোধন ও কর্ণ অবস্থান করিতে লাগিলেন। শতসহস্র যুদ্ধ বিশারদ বীরপুরুষ শকটের অগ্রভাগ রক্ষায় নিযুক্ত হইলেন। মহারাজ জয়দ্রথ অসংখ্য সৈন্যের সহিত তাহাদের সকলের পশ্চাৎ সেই সূচীনামক গুঢ় ব্যূহের পার্শ্বে অবস্থান করিলেন । মহাবাহু দ্রোণাচার্য্য শ্বেতবৰ্ম ও উৎকৃষ্ট উষ্ণীষ ধারণপূর্ব্বক শরাসন বিস্ফারণ করত ক্রুদ্ধ অন্তকের ন্যায় শকটের মুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ভোজ ভূপতি দ্রোণের পশ্চাৎ সমবস্থিত হইলেন। মহাবীর দ্রোণ স্বয়ং তাঁহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। আচার্য্যের রক্তাশ্বযুক্ত রথ এবং বেদী ও কৃষ্ণাজিনসম্পন্ন ধ্বজ নিরীক্ষণ করিয়া কৌরবগণের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। সিদ্ধ ও চারণগণ সেই দ্রোণ নির্মিত ক্ষুব্ধার্ণবসদৃশ অদ্ভুত ব্যূহ অবলোকন করিয়া সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। সমুদায় প্রাণিগণের বোধ হইল যে, এই ব্যূহ, শৈল সাগর ও অরণ্য সমাকুল বিবিধ জনপদ পূর্ণ এই পৃথিবীকে গ্রাস করিতে পারে। মহারাজ দুৰ্য্যোধন সেই অসংখ্য রথী, পদাতি, অশ্ব ও নাগে সমাকীর্ণ, ভয়ঙ্কর, অরাতিগণের হৃদয়ভভেদকারী অদ্ভুত শকটব্যূহ অবলোকন করিয়া যারপর নাই আনন্দিত হইলেন।