কর্ণ ভঙ্গ দি রণে, ব্যাকুল গন্ধর্ব্ব বাণে,
পলায় সক সেনাপতি।
পলায় ত্রিগর্ত্ত নাথ, সৌবল শকুনি সাথ,
কর্ণ দুঃশাসন বিবিংশতি।।
যত যত মহাবীর, রণেতে নহিল স্থির,
প্রমাদ গণিয়া সর্ব্বজন।
কে করে তাহার লেখা, কেবল রাখিয়া একা,
নারীবৃন্দ সহ দুর্য্যোধন।।
মহাত্রস্ত হয়ে যায়, নারীপানে নাহি চায়,
রথ চালাইয়া শীঘ্রগতি।
অশ্ব গজ ধায় রড়ে, পথেতে পদাতি পড়ে,
উঠে, হেন নাহিক শকতি।।
হেনমতে সৈন্য সব, করি মহা কলরব,
প্রাণ লয়ে পলায় তরাসে।
হাহাকার কোলাহল, পূর্ণ হল বনস্থল,
দেখিয়া গন্ধর্ব্বপতি হাসে।।
তবে দুর্য্যোধনে কয়, দুষ্টবুদ্ধি পাপাশয়,
না জানিস্ গন্ধর্ব্ব কেমন।
আরে মন্দ মতিমান, ভালমন্দ নাহি জ্ঞান,
অহঙ্কারে করিস্ হেলন।।
না জানিস্ নিজ বল, এখনি উচিত ফল,
মোর হাতে অবশ্য পাইবে।
লইব তোমার প্রাণ, ইহাতে নাহিক আন,
মনের বাসনা পূর্ণ হবে।।
এত বলি নিজ অস্ত্র, যুড়িলেন লঘুহস্ত,
গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর ক্রোধমনে।
অব্যর্থ জানয়ে সন্ধি, এবে সে করিয়া বন্দী,
ধরিলেক রাজা দুর্য্যোধনে।।
বন্দী হৈল কুরুশ্রেষ্ঠ, স্বপক্ষ দিলেক পৃষ্ঠ,
দোসর নাহিক আর সাথে।
স্ত্রীবৃন্দ সহিত রাজা, রথে তুলে মহাতেজা,
শীঘ্রগতি যায় স্বর্গপথে।।
ঘোর আর্ত্তনাদ করি, কান্দয়ে সকল নারী,
হায় হায় ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।
কপালে কঙ্কণাঘাত, ঘন ডাকে জগন্নাথ,
পার কর বিপত্তি সাগরে।।
মোরা সর্ব্বধর্ম্ম হীন, পাপকর্ম্ম প্রতিদিন,
তব ভক্তিলেশ নাহি মনে।
সত্য মোরা হীনতপা, কেবল করহ কৃপা,
দীনবন্ধু নামের কারণে।।
ইত্যাদি অনেক করি, স্তুতি করে কুলনারী,
কেহ নিন্দা করে নিজ পতি।
দুষ্টবুদ্ধি স্বামীগণ, ধর্ম্মে হিংসে অনুক্ষণ,
সে কারণে হৈল হেন গতি।।
কুরুশ্রেষ্ঠ ধর্ম্মপতি, ধর্ম্মেতে যাঁহার মতি,
অনুগত ভাই চারি জন।
কেবল ধর্ম্মের সেতু, প্রাণ ত্যজে ধর্ম্ম হেতু,
তাঁরে দুঃখ দিল দুর্য্যোধন।।
সতী সাধ্বী পতিব্রতা, দেব দ্বিজ অনুগতা,
সতত ধর্ম্মেতে যাঁর মতি।
লক্ষ্মীঅংশ যাজ্ঞসেনী, সভামধ্যে তারে আনি,
চুলে ধরি করিল দুর্গতি।।
সে ধর্ম্ম ফলিল আজি, বিপদ সাগরে মজি,
সবাই হারানু জাতি কুল।
বার্ত্তা পেয়ে ধর্ম্মরাজ, জানিয়া কুলের লাজ,
কেবল রক্ষার মাত্র মুল।।
তবে দুর্য্যোধন নারী, এই যুক্তি মনে করি,
অনুচরে কহে শীঘ্রগতি।
বিলম্ব না কর তাত, যথা পাণ্ডবের নাথ,
কহ গিয়া সকল দুর্গতি।।
কহিবে বিনয় করি, মো সবার নাম ধরি,
নিশ্চয় মজিল কুরুবংশ।
মো সবার কর্ম্মফলে, এ কুৎসা কলঙ্ক কুলে,
চিত্রসেন হাতে জাতি ধ্বংস।।
অনুচর কহে বাণী, সত্য কহ ঠাকুরাণী,
পাসরিলা পূর্ব্বকথা সব।
যে কর্ম্ম করিয়া তাঁরে, পাঠাইলা বনান্তরে,
তাহা বিনা কে আছে বান্ধব।।
যে আজ্ঞা তোমার মাতা, এখনি যাইব তথা,
কহিব সকল সমাচার।
ধর্ম্মরাজ মহাশয়, বীর বটে ধনঞ্জয়,
ভীম হস্তে নাহিক নিস্তার।।
রাণী বলে ধর্ম্মরাজ, জানিয়া কুলের লাজ,
আমা সবার আপদ ভঞ্জনে।
না করিবে ভেদমতি, পরদুঃখে দুঃখী অতি,
উদ্ধারিতে পাঠাবে অর্জ্জুনে।।
স্বামী মোর অপরাধী, ইহাতে অবজ্ঞা যদি,
করিয়া উদ্ধার না করিবে।
মিলিয়া সকল নারী, বিষ ভগ্নি ভর করি,
কিংবা জলে প্রবেশি মরিবে।।
এত শুনি শীঘ্র দূত, গেল যথা ধর্ম্মসুত,
মাদ্রীর তনয় ভীমার্জ্জুন।
বেষ্টিত ব্রাহ্মণভাগে, করযোড় করি আগে,
কহিতে লাগিল সকরুণ।।
অবধান মহারাজ, দৈবের দুর্গতি কাজ,
রাজা এল প্রভাসের স্নানে।
বিধির নির্ব্বন্ধ কর্ম্ম, খণ্ডন না যায় ধর্ম্ম,
বন্দী হৈল চিত্রসেন-বাণে।।
গন্ধর্ব্বের মায়াবলে, পোড়াইল অস্ত্রানলে,
প্রাণেতে কাতর যত সেনা।
কর্ণ শাল্ব দুঃশাসন, যত মহাযোধগণ,
প্রাণ লয়ে যায় সর্ব্বজনা।।
একা ছিল দুর্য্যোধন, রক্ষা হেতু নারীগণ,
প্রাণপণে যুঝিল রাজন।
যতেক নারীর সহ, করাইয়া রথারোহ,
লয়ে যায় করিয়া বন্ধন।।
প্রতিকারে নহে শক্য, পৃষ্ঠভঙ্গ দিল পক্ষ,
শেষে যায় জাতি কুল প্রাণ।
আকুল হইয়া মনে, তব ভ্রাতৃ বধূগণে,
পাঠাইয়া দিল তব স্থান।।
আরো বা কি কব আমি , আজন্ম আমার স্বামী,
অপরাধী তোমার চরণে।
কুলের কলঙ্ক ভয়, ভয়ার্ত্ত জনের ভয়,
দূর কর আপনার গুণে।।
ইহা সবাকার দোষে, যদি এই অভিরোষে,
উদ্ধার না কর ধর্ম্মপতি।
হইবে বধের ভাগী, জীব বা কিসের লাগি,
অনল গরল জলে গতি।।
তোমার কুলের নারী, গন্ধর্ব্ব লইয়া হরি,
যাবৎ না যায় অতি দূর।
দেখিয়া উচিত কর্ম্ম, করহ কুলের ধর্ম্ম,
রক্ষা কর কুলের ঠাকুর।।
শুনিয়া চরের কথা, মর্ম্মে পাইলেন ব্যথা,
ধর্ম্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির।
কুলের কলঙ্ক আর, ভয়ান্বিত অবলার,
রক্ষা হেতু হৈলেন অস্থির।।
বিষম নিগ্রহ জানি, বিচারিয়া নৃপমণি,
অর্জ্জুনে কহেন সবিশেষ।
শীঘ্র আন দুর্য্যোধনে, কহি চিত্রসেন স্থানে,
যাবৎ না যায় নিজ দেশ।।
বিনয় পূর্ব্বক তথা, কহিবা মধুর কথা,
বহুবিধ আমার বিনয়।
যদি তাহে সাম্য নহে, দ্বৈপায়ন দাস কহে,
দণ্ড দিবা উচিত যে হায়।।