৮৪তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের যুদ্ধযাত্রা
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! তাঁহারা এই রূপ কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময়ে ধনঞ্জয় যুধিষ্ঠির ও অন্যান্য সুহৃগণকে সন্দর্শন করিবার অভিলাষে তাঁহাদের সম্মুখে আগমন পূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করিয়া তাঁহার অর্থে দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন ধর্ম্মরাজ প্রীতি প্রফুল্লচিতে আসন হইতে সমুত্থিত হইয়া বাহু দ্বারা তাঁহাকে আলিঙ্গন ও তাঁহার মস্তক আঘ্রাণ করিয়া আশীৰ্বাদ প্রয়োগ পূর্ব্বক সম্মিতবদনে কহিলেন, অর্জ্জুন! তোমার যেরূপ কান্তি এবং জনার্দ্দন আমাদের প্রতি যেরূপ প্রসন্ন, তাহাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে যে, যুদ্ধে তোমারই জয় লাভ হইবে। তখন ধনঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! আপনার কল্যাণ হউক, আমি কেশবের প্রসাদে অতি আশ্চর্য্য বিষয় দর্শন করিয়াছি। মহাবীর অর্জ্জুন এই বলিয়া সুহৃদগণকে আশ্বাসিত করিবার নিমিত্ত স্বপ্নে শিব সমাগমের বিষয় আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন। তাঁহারা তৎশ্রবণে বিষ্ময়াপন্ন হইয়া মস্তক দ্বারা ধরাতল স্পর্শ পূর্ব্বক দেবাদিদেব মহাদেবকে নমস্কার করিয়া ধনঞ্জয়কে সাধুবাদ প্ৰদান করিতে লাগিলেন।
অনন্তর ধর্ম্মরাজ সমুদয় সুহৃদগণকে সংগ্রামে গমন করিতে আদেশ করিলে, তাঁহারা তাঁহার অনুজ্ঞানুসারে ত্বরমান, সুসম্বব্ধ ও প্রফুল্লচিত্ত হইয়া যুদ্ধার্থে বহির্গত হইলেন। মহাবীর সাত্যকি বাসুদেব ও ধনঞ্জয় রাজাকে অভিবাদন পূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। দুধর্ষ সাত্যকি ও বাসুদেব এক রথে আরোহণ পূর্ব্বক অর্জ্জুননিবেশনে উপনীত হইলেন। তথায় বাসুদেব সারথির ন্যায় ধনঞ্জয়ের বানরধ্বজ রথ সুসজ্জিত করিতে লাগিলেন। মেঘ গম্ভীরনির্ঘোষ তপ্ত কাঞ্চন প্রভা সম্পন্ন সেই উৎকৃষ্ট রথ সুসজ্জিত হইয়া তরুণ দিবাকরের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। অনন্তর ধনঞ্জয়ের আহ্নিকার্য্যসমাপ্ত হইলে পুরুষশ্রেষ্ঠ বাসুদেব তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘ধনঞ্জয়! রথ সুসজ্জিত হইয়াছে।’ তখন মহাবীর ধনঞ্জয় কিরীট, হেমবৰ্ম্ম, শরাসন ও শর ধারণপূর্ব্বক রথ প্রদক্ষিণ করিয়া তাহাতে আরোহণ করিলেন। তপঃপরায়ণ, বিদ্যাসম্পন্ন, বয়োবৃদ্ধ, ক্রিয়াশালী জিতেন্দ্রিয়গণ জয়বাদ পূর্ব্বক তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন। সুমেরু শৃঙ্গে দিবাকরের যেরূপ শোভা হয়, কাঞ্চনমণ্ডিত রথিশ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয় সেই জৈত্রেয় ও সাংগ্রামিক মন্ত্রে অভিমন্ত্রিত কাঞ্চনময় রথে আরোহণ করিয়া সেইরূপ শোভা ধারণ করিলেন। যেমন অশ্বিনীকুমার যুগল শর্ষাতির যজ্ঞে আগমনকালে ইন্দ্রের সহিত রথারোহণ করিয়াছিলেন, সেইরূপ যুযুধান ও জনার্দ্দন অর্জ্জুনের সহিত রথারূঢ় হইলেন। বৃত্রাসুর বধার্থ গমন কালে মাতলি যেমন ইন্দ্রের অশ্বরশ্মি ধারণ করিয়া ছিলেন, সেইরূপ সারথিশ্রেষ্ঠ গোবিন্দ ধনঞ্জয়ের অশ্বরশ্মি ধারণ করিলেন। শশধর যেমন তিমিরনাশের নিমিত্ত বুধ ও শুক্রের সহিত গমন করেন, ইন্দ্র যেমন তারা নিমিত্তক যুদ্ধে বরুণ ও সূর্যের সহিত গমন করিয়াছিলেন; সেইরূপ ধনঞ্জয় সিন্ধুরাজাকে বধ করিবার নিমিত্ত সাত্যকি ও কৃষ্ণের সহিত রথারোহণ পূর্ব্বক গমন করিতে লাগিলেন। বাদকগণ বাদিত্রশব্দ এবং সূত ও মাগধগণ মাঙ্গল্য স্তুতি পাঠ করিতে আরম্ভ করিল। জয়াশীৰ্বাদ, পুণ্যাহ ধ্বনি এবং সূত ও মাগধগণের স্তুতি নিনাদ বাদ্য ধ্বনির সহিত মিশ্রিত হইয়া বীরগণের হর্ষবর্দ্ধন করিতে লাগিল, ঐ সময় পুণ্যগন্ধবাহী শুভসমীরণ পাণ্ডবগণকে হর্ষিত ও তাঁহাদের অরাতিগণকে শোষিত করিয়া অর্জ্জুনের অনুকূলে প্রবাহিত হইতে লাগিল এবং জয়সূচক বিবিধ শুভ নিমিত্ত প্রাদুর্ভূত হইল।
ধনঞ্জয় জয়লাভের লক্ষণ-সকল নিরীক্ষণ করিয়া দক্ষিণ পার্শ্বস্থিত মহাধনুর্দ্ধর সাত্যকিকে কহিলেন, হে যুযুধান! আজি যেরূপ নিমিত্ত সকল অবলোকন করিতেছি, তাহাতে নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, আমার জয় লাভ হইবে। অতএব জয়দ্রথ আমার বীর্য্য প্রভাবে যমলোকে গমন করিবার নিমিত্ত যেস্থানে অবস্থান করিতেছে, আমি সেই স্থানে গমন করিব কিন্তু জয়দ্রথকে বধ করা যেমন আমার অবশ্য কর্ত্তব্য, ধর্ম্ম রাজকে রক্ষা করাও সেইরূপ নিতান্ত আবশ্যক, অতএব আজি রাজার রক্ষার্থে তোমায় নিযুক্ত করিলাম। আমি তাঁহাকে যে প্রকার রক্ষা করিয়া থাকি, তুমিও সেই প্রকার রক্ষা করিবে সন্দেহ নাই। তোমাকে যুদ্ধে পরাজয় করিতে পারে, এমন লোক নয়নগোচর হয় না। তুমি যুদ্ধে বাসুদেবের সমান; ইন্দ্রও তোমাকে জয় করিতে সমর্থ নহেন। তুমি বা মহারথ প্রদ্যুম্ন ধর্ম্মরাজকে রক্ষা করিবার ভার গ্রহণ করিলে আমি নিশ্চিন্ত হইয়া জয়দ্রথকে বধ করিতে পারি। আমার নিমিত্ত তোমার কিছুমাত্র চিন্তা নাই। যেস্থানে আমি বাসুদেবের সহিত মিলিত হইয়া অবস্থান করি, সেখানে কখনই বিপদ হয় না। অতএব তুমি আমার নিমিত্ত কিছুমাত্র চিন্তিত না হইয়া সাধ্যানুসারে রাজাকে রক্ষা করিও, অরাতি নিপাতন সাত্যকি অর্জ্জুনের বাক্যে স্বীকার করিয়া অবিলম্বে যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিলেন।”
প্রতিজ্ঞাপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।