রসনা রাম নাম ভুলনা রে।
দেখ মিছে মায়াজালে, বদ্ধ করে কালে,
ডুবায় অকূল পাথারে।।
ইন্দ্র-রথ রাবণ দেখিয়া রণস্থলে।
চিন্তিত রাবণ-রাজা টুটে আসে বলে।।
রথের সারথি রামে কৈল প্রদক্ষিণ।
রথে উঠে রঘুনাথ সংগ্রামে প্রবীণ।।
চিনিল রাবণ-রাজা ইন্দ্রের বিমান।
মনে মনে দশানন করে অনুমান।।
কোথা গেল ইন্দ্রজিৎ ভাই কুম্ভকর্ণ।
এখনি দেবতা বেটায় করিতাম চূর্ণ।।
এত দিন করে সেবা সেবকের মত।
অসময় দেখে হলো শত্রু-অনুগত।।
শত্রুকে পাঠায় রথ আমা বিদ্যমানে।
এত বলি কোপ-দৃষ্টে চাহে স্বর্গপানে।।
কোপ-মনে মাতলিবে কহে লঙ্কেশ্বর।
সবলের অনুবল যতেক অমর।।
এইবার যুদ্ধে যদি বাঁচয়ে জীবন।
একে এক কাটিব সকল দেবগণ।।
কোপ সম্বরিয়া রাজা বসি মনোদুঃখে।
রথ চালাইয়া দিল রামের সম্মুখে।।
কোপেতে রাবণ করে বাণ-অবতার।
তিন লক্ষ বাণ মারে মারে সর্পের আকার।।
সর্পবাণ দেখি রামে লাগিল তরাস।
বুঝি পুনঃ এড়িল বন্ধন নাগপাশ।।
নাগপাশ নিবারণে জানেন সন্ধান।
মন্ত্র পড়ি শ্রীরাম এড়েন খগবাণ।।
গরুড় হইয়া বাণ আকাশেতে বুলে।
রাবণের সর্পবাণ ধরে ধরে গিলে।।
সর্পবাণ ব্যর্থ গেল কুপিল রাবণ।
রামের উপরে করে বাণ বরিষণ।।
বাণ বরষিয়া বিন্ধে ইন্দ্রের মাতলি।
জর্জ্জর ইন্দ্রের অশ্ব মুখে ভাঙ্গে নালি।।
কোপেতে রাবণ বজ্র-জাঠা লয় হাতে।
জাঠা দেখি দেবগণ লাগিল চিন্তিতে।।
জাঠাগাছ হাতে করি তর্জ্জে লঙ্কেশ্বর।
ডাকিয়া রামেরে তবে করিছে উত্তর।।
এই আমি জাঠা মারি পূরিয়া সন্ধান।
রক্ষা কর দেখি রাম ধরে ধনুর্ব্বাণ।।
মন্ত্র পড়ি দশানন জাঠাগাছ এড়ে।
যতদূর যায় জাঠা তার ততদূর পুড়ে।।
বৃক্ষের নিকটে গেলে সব বৃক্ষ জ্বলে।
আলো করি আসে জাঠা গগন মণ্ডলে।।
যত বাণ এড়ে রাম জাঠা নিবারিতে।
সর্ব্ব অস্ত্র পুড়ে যায় জাঠার অগ্নিতে।।
বাণ পোড়াইয়া জাঠা আসে বায়ুবেগে।
মাতলি কহেন তখন শ্রীরামের আগে।।
ইন্দ্র পাঠাইল শেল সংসার-বিজয়।
সেই শেল মার প্রভু জাঠা হবে ক্ষয়।।
এড়িলেন শেলপাট মাতলির বোলে।
রাবণের জাঠা কাটি পাড়ে ভূমিতলে।।
জাঠাগাছ কাটা গেল রুষিল রাবণ।
রামের উপরে করে বাণ বরিষণ।।
বাছিয়া বাছিয়া বাণ এড়ে লঙ্কেশ্বর।
বাণ ফুঁটে রঘুনাথ হইল কাতর।।
কাতর হইয়া রাম ধনু দিলা টান।
বিন্ধি রাবণের অঙ্গ কৈলা খান খান।।
দুইজনে মহাযুদ্ধ সংগ্রাম ভিতরে।
কোপে রাম গালি পাড়ে রাবণের তরে।।
সবে বলে তোমারে রাবণ মহারাজ।
পরস্ত্রী হরিতে তোর মুখে নাহি লাজ।।
সীতা যদি আনিতে আমার বিদ্যমানে।
সেই দিন পাঠাতাম যমের সদনে।।
বিদ্যমানে না আনিয়া করিলি যে চুরি।
দেখাদেখি আজি পাঠাইব যমপুরী।।
দশমুণ্ড সাজায়েছ নানা অলঙ্কারে।
গড়াগড়ি যাবে মুণ্ড সমুদ্রের ধারে।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর দেবেন্দ্র বাসুকি।
পড়িলি আমার হাতে কার সাধ্য রাখি।।
গালি দিয়া শ্রীরামের বল বেড়ে আসে।
বাছিয়া বাছিয়া বাণ মারেন হরিষে।।
বানরেতে গাছ পাথর ফেলে চারিভিতে।
চারিদিকে মারে বাণ না পারে সহিতে।।
আয়ুঃশেষ হয় রাবণ টুটে আসে বলে।
চারিদিকে রামরূপ রাবণ নেহালে।।
বজ্র-অস্ত্র মারে রাম রাবণ উপর।
মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে রথের উপর।।
হাত পা আছাড়ি রাজা করে ধড়ফড়।
ক্ষণেক বিলম্বে উঠি নিল ধনুঃশর।।
আরবার দুই জনে বাধে মহারণ।
বিষ্ণুমন্দ্রে গদা মারিলেন রাম পুনঃ।।
কালচক্রে কাটে গদা রাজা দশানন।
গদা ব্যর্থ গেল ভাবে কমল-লোচন।।
পাশুপত-বাণ মারে রাজা দশানন।
বিষ্ণুচক্রে কাটিলেন শ্রীরাম তখন।।
অতি ক্রোধে এড়িলেন বাণ মহাকাল।
রাবণের বুকে বিন্ধি প্রবেশে পাতাল।।
বাণ খেয়ে দশানন ভাবে মনে মন।
যোড়হাতে স্তব করে শ্রীরামে তখন।।
হাতের ধনুক বাণ ফেলি ভূমিতলে।
কর যুড়ি করে স্তব বস্ত্র দিয়ে গলে।।
বিশ্বের আরাধ্য তুমি অগতির গতি।
নিদানে সৃজিতে সৃষ্টি তুমি প্রজাপতি।।
তুমি সৃষ্টি তুমি স্থিতি তোমাতে প্রলয়।
কালে মহাকাল বিশ্ব কালে কর লয়।।
তুমি চন্দ্র তুমি সুর্য্য তুমি চরাচর।
কুবের বরুণ তুমি যম পুরন্দর।।
নিরাকার সাকার সকল রূপ তুমি।
তোমার মহিমা সীমা কি জানিব আমি।।
না জানি ভকতি স্তুতি জাতি নিশাচর।
শ্রীচরণে স্থান দান দেহ গদাধর।।
তুমি হে অনাদি আদি অসাধ্য-সাধন।
কটাক্ষে ব্রহ্মাণ্ড কর খণ্ড বিনাশন।।
আখণ্ডল চঞ্চল চিন্তিয়া শ্রীচরণ।
কটাক্ষে করুণা কর কৌশল্যা-নন্দন।।
জন্মিয়া ভারত-ভূমে আমি দুরাচার।
করেছি পাতক বহু সংখ্যা নাহি তার।।
অপরাধ মার্জ্জনা কর হে দয়াময়।
কুড়ি হস্ত যুড়ি রাজা এক দৃষ্টে রয়।।
কুড়ি চক্ষে বারিধারা বহে অনিবার।
রাম বলে না হইল সীতার উদ্ধার।।
কার্য্য নাই রাজপাটে পুনঃ যাই বনে।
রাবণ পরম ভক্ত মারিব কেমনে।।
কেমনে এমন ভক্তে করিব সংহার।
বিশ্বে কেহ রামনাম না করিবে আর।।
কেমনে মারিব বাণ ভক্তের উপর।
এত বলি ত্যজেন হাতের ধনুঃশর।।
বিমুখ হইয়া রাম বসিলেন রথে।
ইন্দ্র আদি দেবগণ লাগিল চিন্তিতে।।
স্তবে তুষ্ট হৈলা যদি কমল-লোচন।
তবে ত মজিল সুষ্ট না মৈল রাবণ।।
এত বলি দেবগণ করিয়া যুকতি।
উত্তরিল গিয়া যথা দেবী সরস্বতী।।
দেবগণ বলে মাতা করি নিবেদন।
প্রমাদ ঘটিল বড় না মৈল রাবণ।।
শ্রীরামে করিল স্তব দুষ্ট নিশাচর।
স্তবে তুষ্ট হয়ে রাম ত্যজিল সমর।।
তুমি বৈস রাবণের কণ্ঠের উপর।
রিপুভাবে শ্রীরামে বলাও কটূত্তর।।
এত শুনি বাগবাদিনী চলিলা সত্বর।
বসিলেন রাবণের কণ্ঠের উপর।।
ডাক দিয়া বলে রাবণ শুন রঘুপতি।
প্রাণের ভয়েতে তোমা নাহি করি স্তুতি।।
অবশ্য যুঝিব আমি আইস সত্বর।
এক বাণে ভণ্ড বেটা যাবি যমঘর।।
শ্রীরাম বলেন মৃত্যু ইচ্ছিলি রাবণ।
এখনি পাঠাব তোরে যমের সদন।।
এত বলি কোপেতে কম্পিত রঘুবর।
পুনর্ব্বার তুলিয়া নিলেন ধনুঃশর।।
পুনর্ব্বার লাগে যুদ্ধ শ্রীরাম রাবণে।
বাণে বাণে কাটাকাটি উঠিল গগনে।।
সিংহে সিংহে পর্ব্বতে যেমন বাজে রণ।
সেইরূপ বাজে যুদ্ধ শ্রীরাম-রাবণ।।
পঞ্চবাণ যুড়ে রাম ধনুকের গুণে।
সেই বাণ কাটে রাবণ অগ্নিমুখ-বাণে।।
গন্ধর্ব্বাস্ত্র মারে রাম রাবণের গায়।
দশানন মোহ গেল সেই অস্ত্র ঘায়।।
হেনকালে যুক্তি দিল রাক্ষস বিভীষণ।
ব্রহ্ম-কবচ কাটি পাড় মরুক রাবণ।।
ব্রহ্ম-মন্ত্র পড়ি রাম ব্রহ্ম-অস্ত্র হানে।
কবচ কাটিয়া পাড়ে শ্রীরামের বাণে।।
ব্রহ্ম-কবচ কাটি রাম তীক্ষ্ণ অস্ত্র হানে।
তবু যুঝে দশানন শ্রীরামের সনে।।
ডাক দিয়া শ্রীরামেরে বলিছে রাবণে।
কি করিতে পার রাম মনুষ্য-পরাণে।।
রাবণের কথা শুনি শ্রীরামের হাস।
অবশ্য রাবণ তৈরি করিব বিনাশ।।
যত বাণ মারে রাম না মরে রাবণ।
রাবণ মরিবে কিসে ভাবে নারায়ণ।।
সন্ধান পূরিয়া রাম কালচক্র এড়ে।
রাবণের মাথা কাটি ভূমিতলে পাড়ে।।
এক মাথা কাটা গেল দেখে দেবগণ।
পুনঃ মাথা সেইখানে উঠে ততক্ষণ।।
আরবার রঘুনাথ অর্দ্ধচন্দ্র বাণে।
দুই মাথা কাটিয়া পাড়িলা সেইখানে।।
রণস্থলে রাবণের উঠে দুই মাথা।
দেখি চমৎকার হৈল সকল দেবতা।।
আরবার রঘুনাথ এড়ে ব্রহ্মজাল।
তিন মাথা কাটি বাণ সান্ধায় পাতাল।।
তিন মাথা কাটা গেল দেখে দেবগণে।
পুনঃ তার তিন মাথা উঠে সেইক্ষণে।।
আরবার সন্ধান পূরিলা রঘুবীর।
ঐষিক বাণেতে তার কাটিলেন শির।।
চারি মাথা কাটা গেল অতি চমৎকার।
ব্রহ্মা-বরে চারি মাথা উঠে আরবার।।
মাথা কাটা গেল নাহি মরে লঙ্কেশ্বর।
ব্রহ্ম-অস্ত্রে পঞ্চ মাথা কাটেন সত্বর।।
পাঁচ মাথা কাটি রাম মনে আনন্দিত।
সেই পাঁচ মাথা তখন উঠে আচম্বিত।।
আরবার রামচন্দ্র এড়ি যমদণ্ড।
মুকুট সহিত কাটে ছয়গোটা মুণ্ড।।
মাথা কাটা গেল তবু রণে নাহি টুটে।
সেইক্ষণে রাবণের ছয় মাথা উঠে।।
ধর্ম্মচক্র-বাণ রাম যুড়েন ধনুকে।
সাত মাথা কাটিলেন সর্ব্বজন দেখে।।
মাথা কাটা গেল তবু যুঝিছে রাবণ।
সপ্তমুণ্ড রাবনের উঠে ততক্ষণ।।
সপ্তসার-বাণে রাম অষ্টমুণ্ড কাটে।
ব্রহ্মার বরেতে তার অষ্টমুণ্ড উঠে।।
নয় মাথা কাটিলেন রঘুনাথ কোপে।
সেইক্ষণে নয় মাথা উঠে এক চাপে।।
দশ মাথা কাটে পুনঃ দশ মাথা উঠে।
তথাপি রাবণ যুঝে রামের নিকটে।।
শ্রীরাম বলেন বেটা বড়ই দুর্ব্বার।
মাথা কাটা গেল তবু যুঝে আরবার।।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে রাম পূরিলা সন্ধান।
রাবণের মধ্যে কাটি করে দুইখান।।
অর্দ্ধ অঙ্গ পড়ে যেন পর্ব্বতের চূড়া।
ব্রহ্মা-বরে অর্দ্ধ অঙ্গ, অঙ্গে লাগে যোড়া।।
তবু নাহি পড়ে রাবণ বড়ই দুর্ব্বার।
রামের উপরে করে বাণ-অবতার।।
রাবণের বাণে রাম জর্জ্জর শরীর।
সম্বরিয়া আকর্ণ পূরেন রঘুবীর।।
শতবার কাটিলেন রাবণের মাথা।
কাটিবামাত্রেতে উঠে তিলে নাহি ব্যথা।।
না মরে কাটিলে মাথা, যুঝয়ে রাবণ।
কৃত্তিবাস রচিলেন গীত রামায়ণ।।