৮৩তম অধ্যায়
পারিষদ-সুহৃদ ও মন্ত্রী প্রভৃতির লক্ষণ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ। সভাসদ, সহায়, সুহৃদ, মন্ত্রী ও সেনানী প্রভৃতির লক্ষণ কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! যাঁহারা লজ্জাশীল, সত্যপরায়ণ, সরলতাসম্পন্ন ও দমগুণান্বিত এবং যাঁহারা সুচারুরূপে বক্তৃতা করিতে পারেন, তুমি তাঁহাদিগকেই সভাসদপদে নিযুক্ত করিবে। আপদ্কালে বলবীৰ্য্যসম্পন্ন অমাত্য, জ্ঞানবান্ ব্রাহ্মণ ও সন্তুষ্টচিত্ত। উৎসাহসম্পন্ন ব্যক্তিদিগের সাহায্য গ্রহণ করা তোমার কর্ত্তব্য। সৎকুলসম্ভূত ব্যক্তিগণ প্রতিনিয়ত সম্মানিত হইলে কখনই আপনার শক্তি গোপন করেন না এবং রাজা প্রসন্ন, অপ্রসন্ন বা পীড়িত হউন, কদাপি তাঁহাকে পরিত্যাগ করিতে অভিলাষী হয়েন না; অতএব ঐ সমুদয় ব্যক্তির সহিত সৌহার্দ্য সংস্থাপন করা উচিত। তুমি স্বদেশজাত, কুলীন, প্রাজ্ঞ, রূপবান্, বিদ্বান্, প্রগল্ভ ও অনুরক্ত ব্যক্তিদিগকে সৈনাপত্য প্রভৃতি পদ প্রদান করিবে। দুষ্কুলজাত লোভপরায়ণ নির্লজ্জ ব্যক্তিরা যতক্ষণ অর্থলাভ করিতে পারে, ততক্ষণই ভূপতির সেবা করে। কুলীন, সচ্চরিত্র, ইঙ্গিতজ্ঞ, দয়াল, দেশকালজ্ঞ [দেশ ও কালের অবস্থায় অভিজ্ঞ] ও প্রভুহিতৈষী [মনিবের হিতেচ্ছু] ব্যক্তিদিগকেই মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করা রাজার কর্ত্তব্য। অর্থ, মান ও দিব্যবস্ত্রাদি বিবিধ ভোগদ্বারা বিদ্বান, সুশীল, সচ্চরিত্র, সত্যবাদী, মহানুভব ব্যক্তিদিগের তৃপ্তিসাধন করা তোমার নিতান্ত উচিত। তাদৃশ ব্যক্তিরা তোমার সুখের সময়ে সুখভোগ করিয়া আপদ্কালে কদাপি তোমাকে পরিত্যাগ করিতে পারিবেন না।
“যে সমুদয় অনাৰ্য্য, মন্দবুদ্ধি মানব সতত নিয়মলঙ্ঘনে যত্নবান হয়, তাহাদিগকে নিয়মপালনে নিরত করা অবশ্য কর্ত্তব্য। বহুসংখ্যক ব্যক্তিকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক এক ব্যক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা অকর্ত্তব্য বটে, কিন্তু এক ব্যক্তি যদি বহুগুণসম্পন্ন হয়, তবে তাঁহাকে আশ্ৰম করিবার নিমিত্ত অনেককে পরিত্যাগ করা যাইতে পারে। যাঁহারা পরাক্রমশালী, কীর্ত্তিমান, ধর্ম্মাধর্ম্মতত্ত্বজ্ঞ, অভিমানশূন্য, সত্যপরায়ণ ও জিতেন্দ্রিয়, যাঁহারা সতত বলবান্দিগের উপাসনা করেন, যাঁহারা কাম, ক্রোধ, লোভ বা ভয়ের বশীভূত হইয়া ধর্ম্ম পরিত্যাগ করেন না, তাঁহারাই যথার্থ সাধু। তুমি সবিশেষ পরীক্ষা না করিয়াই তাহাদিগের পরামর্শ গ্রহণ করিবে। কুলশীলসম্পন্ন, ক্ষমাবান, কাৰ্য্যদক্ষ, শৌর্য্যশালী ও কৃতজ্ঞ হওয়াই সাধুদিগের প্রধান লক্ষণ। যে বিজ্ঞ ব্যক্তি ঐরূপ গুণসম্পন্ন হইতে পারেন, তাঁহার শত্রুগণও তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া শত্রু ভাব পরিত্যাগ কর। অমাত্যগণের পূর্ব্বাপর গুণাগুণ পরীক্ষা করা ঐশ্বৰ্য্যাভিলাষী বুদ্ধিমান্ রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। যে রাজা সম্পদ্লাভের বাসনা করেন, তিনি সুপরীক্ষিত, সৎকুলসম্ভূত, উৎকোচগ্রহণে বিরত, ব্যভিচারদোষবিহীন, সুবিশ্বস্ত, বেদজ্ঞ, নিরহঙ্কৃত[অহঙ্কারহীন], বিনয়বুদ্ধিসম্পন্ন[বিনয়ী ও বুদ্ধিমান], সত্যভাবান্বিত, তেজস্বী, ধীর, ক্ষমাবান, শুচি, অনুরক্ত, কাৰ্য্যদক্ষ, গম্ভীর, অকপট, মিতভাষী, কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্যবিশারদ, ইঙ্গিতজ্ঞ, দয়াশীল, দেশকালজ্ঞ ও প্রভুকার্য্যপরায়ণ মহানুভবদিগকে পথপ্রদান ও অর্থাধিকারে নিয়োগ করিবেন। তেজোবিহীন, বন্ধুবান্ধবপরিত্যক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রী করিলে সমুদয় কাৰ্য্যই সংশায়পন্ন হইয়া উঠে, সন্দেহ নাই। যেমন অল্পজ্ঞানসম্পন্ন অমাত্য সৎকুলোদ্ভব ও ধর্মার্থকামযুক্ত হইলেও মন্ত্র পরীক্ষা করিতে পারেন না, তদ্রূপ অসৎকুলসম্ভূত ব্যক্তি বিলক্ষণ জ্ঞানসম্পন্ন হইলেও নায়কবিহীন [পরিচালক সঙ্গীশূন্য] অন্ধের ন্যায় সূক্ষ্মকাৰ্য্যদর্শনে অসমর্থ হয়। অস্থিরসঙ্কল্প ব্যক্তি বুদ্ধিমান, বিদ্বান্ ও উপায়জ্ঞ হইলেও কাৰ্য্যসাধনে সমর্থ হয় না। দুৰ্ম্মতি মূর্খ ব্যক্তি কাৰ্য্য আরম্ভ করিতে পারে, কিন্তু কোন্ কার্য্যের কি বিশেষ ফল, তাহা জ্ঞাত হইতে পারে না।
“অনুরাগবিহীন মন্ত্রী কখনই বিশ্বাসের পাত্র নহেন; অতএব তাঁহার নিকট মন্ত্রণা প্রকাশ করা রাজার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। কারণ, অগ্নি যেমন সমীরণসহযোগে মহাপাদপ [বৃহৎ বৃক্ষ] ভস্মসাৎ করে, তদ্রূপ অননুরক্ত মন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রীদিগের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া রাজাকে উৎসন্ন করিয়া ফেলে। স্বামী ক্রুদ্ধ হইয়া কখন অনুগতে পদচ্যুত এবং কখন বা তিরস্কৃত করিয়া পুনরায় তাহার প্রতি প্রসন্ন হয়েন। অনুরক্ত ব্যক্তিরাই প্রভুর ঈদৃশ ব্যবহার সহ্য করিতে পারেন। মন্ত্রিগণও অনেক সময় ভূপতির উপর যারপরনাই কোপান্বিত হয়, কিন্তু যে মন্ত্রী রাজার প্রিয়চিকীর্ষু হইয়া সেই ক্রোধ সংবরণ করিতে পারেন, বুদ্ধিমান্ ভূপতি তাঁহাকেই সমদুঃখসুখী জ্ঞান করিয়া তাঁহার সহিত সকল বিষয়ের মন্ত্রণা করিবেন; কুটিল ব্যক্তি বিবিধ গুণসম্পন্ন ও অনুরক্ত হইলেও তাহার নিকট মন্ত্রণা প্রকাশ করা কৰ্ত্তব্য নহে। যে ব্যক্তি শত্ৰুদিগের সহিত মিলিত হয় এবং পুরবাসীদিগের সম্মান না করে, সে শত্ৰুতুল্য; তাহার নিকট মন্ত্রণা প্রকাশ করা নিতান্ত নির্ব্বোধের কার্য্য। অশুচি, অহষ্কৃত, আত্মশ্লাঘাপরায়ণ, অসুহৃদ, ক্রোধপরতন্ত্র ও লুব্ধ ব্যক্তিরা মন্ত্রণাশ্রবণের উপযুক্ত নহে। আগন্তুক ব্যক্তি যদি জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রভুভক্ত হয়েন, পূৰ্ব্বে যাহার পিতাকে অন্যায়সহকারে পরিত্যাগ করা হইয়াছিল, সেই ব্যক্তি যদি পিতার পদে সংস্থাপিত হইয়া বিধিপূৰ্ব্বক সৎকৃত হয় এবং কোন কারণবশতঃ যে ব্যক্তিকে একবার নির্ধন করা যায়, সেই ব্যক্তি যদি অসাধারণ গুণসম্পন্ন হয়, বুদ্ধিমান ব্যক্তি তথাপি তাহাদিগের নিকট মন্ত্রণা প্রকাশ করিবেন না। যিনি প্রজ্ঞাবান্, মেধাবী, বিশুদ্ধস্বভাব, শাস্ত্রজ্ঞ, জ্ঞানসম্পন্ন, আত্মতুল্য, প্রিয়সুহৃদ, সত্যবাদী, সচ্চরিত্র, গম্ভীরস্বভাব, লজ্জাশীল, মৃদু, পাপদ্বেষী[পাপের ও পাপাচারীর প্রতি বিরক্ত], প্রগল্ভ, সন্তোষপরায়ণ, যন্ত্রজ্ঞ, কালদর্শী[কালের দোষ-গুণদর্শনে অভিজ্ঞ], শৌৰ্য্যসম্পন্ন, যুদ্ধনিপুণ ও নীতিবিশারদ, যিনি সান্ত্ববাদদ্বারা লোকসকলকে বশীভূত করিতে পারেন, পুরগ্রামবাসী[অন্তঃপুরবাসী ও গ্রামবাসী] ধার্ম্মিক লোকেরা যাঁহাকে বিশ্বাস করে এবং আপনার ও শত্ৰুদিগের অমাত্য প্রভৃতির বিষয় যাঁহার বিলক্ষণ বিদিত থাকে তিনিই মন্ত্রণাশ্রবণের উপযুক্ত। মন্ত্রী ঐরূপ গুণসম্পন্ন ও সৎকৃত হইলে নিশ্চয়ই রাজার মঙ্গলবিধানে যত্নবান্ হয়েন।
“স্বীয় প্রভুর, প্রজাগণের ও শত্রুপক্ষের রন্ধ্রান্বেষণে সচেষ্ট হওয়া মন্ত্রীর অবশ্য কর্ত্তব্য। মন্ত্রীদিগের মন্ত্রণাবলেই রাজার রাজ্য পরিবর্দ্ধিত হইয়া থাকে। বিজ্ঞতম মন্ত্রীগণ অরাতির ছিদ্র দর্শন করিবামাত্র তাঁহাকে আক্রমণ করিবেন এবং এরূপ সাবধান হইয়া চলিবেন যে, যেন শত্রুপক্ষ তাঁহার কোন ছিদ্র নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ না হয়। কূর্ম্ম যেমন আপনার অঙ্গপ্রত্যঙ্গসমুদয় গোপন করিয়া রাখে, তদ্রূপ মন্ত্রী রন্ধ্র ও মন্ত্রণাসমুদয় গোপন করিয়া রাখিবেন। রাজা মন্ত্রণাকে বৰ্ম্মের ন্যায় এবং অন্যান্য লোকেরা উহাকে অঙ্গের ন্যায় জ্ঞান করিবেন। মন্ত্রণা ও চরই রাজ্যরক্ষার মূল কারণ। মন্ত্রীসকল বৃত্তিলাভার্থ রাজার অনুসরণ করিয়া থাকেন। রাজা ও মন্ত্রী উভয়ে অহঙ্কার, ক্রোধ, অভিমান ও ঈর্ষা পরিত্যাগ করিলে উভয়েই সুখী হইতে পারেন, সন্দেহ নাই। রাজা অকপট মন্ত্রীগণের সহিত সতত মন্ত্রণা করিবেন। অন্ততঃ তিনজন মন্ত্রী নিযুক্ত করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। তিনি ঐ তিনজনের মতগ্রহণ এবং উহা সবিশেষ অনুধাবনপূর্ব্বক ধর্ম্মার্থকাম গুরুর সন্নিধানে গমন করিয়া তাঁহাদের ও আপনার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন। গুরু ঐ চারিজনের মত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিয়া তদ্বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত করিয়া দিলে যদি সেই সিদ্ধান্ত সাধারণেরই মতানুসারী হয়, তবে তদনুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করাই ভূপতির কর্ত্তব্য। মন্ত্রনির্ণয়কুশল মহাত্মারা মন্ত্রণা করিবার এইরূপ রীতি নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। উত্তমরূপে মন্ত্রণা করিতে পারিলে প্রজাগণকে অনায়াসে বশীভূত করা যায়। মহীপাল যে স্থানে মন্ত্রণা করিবেন, তথায় যেন বামন, কুব্জ, কৃশ, খঞ্জ, অন্ধ, জড়, নপুংসক বা তির্য্যগ্যোনি অবস্থান না করে। নৌকায় আরোহণ বা কুশকাশ[কুশ ও কেশে] বিহীন অনাবৃত জনশূন্য প্রদেশে অবস্থান করিয়া বাক্যদোষ বা অঙ্গদোষ [অঙ্গচালনাদি—হাঁটু কাঁপান, পা নাচান প্রভৃতি]সমুদয় পরিহারপূর্ব্বক মন্ত্রণা করিবে।”