৮৩তম অধ্যায়
কৃষ্ণের নিকট যুধিষ্ঠিরের প্রার্থনা
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির জনার্দ্দনকে প্রত্যভিনন্দনপূর্ব্বক কহিলেন, হে মধুসূদন! তুমি ত সুখে রজনী অতিবাহিত করিয়াছ? তোমার জ্ঞান সকল প্রসন্ন হইয়াছে?” মহাত্মা বাসুদেবও তাঁহাকে সেইরূপ প্রশ্ন করিলেন। অনন্তর দৌবারিক যুধিষ্ঠিরের নিকট আগমনপূর্ব্বক করপুটে নিবেদন করিল, মহারাজ! বীরগণ সমুপস্থিত হইয়াছেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বীরগণের আগমন বার্তা শ্রবণ করিয়া তাঁহাদিগকে প্রবেশিত করিতে অনুজ্ঞা প্রদান করিলেন। তখন বিরাট, ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি, চেদিপতি ধৃষ্টকেতু, মহারথ দ্রুপদ, শিখণ্ডী, নকুল, সহদেব, চেকিতান, কৈকেয়গণ দ্রৌপদীর পুত্রগণ ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণ যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞানুসারে তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়া নিৰ্ম্মল আসনে উপবেশন করিলেন। মহাত্মা মহাদ্যুতি মহাবল বীর্য্যশালী কৃষ্ণ ও সাত্যকি একাসনে সমাসীন হইলেন।।
অনন্তর যুধিষ্ঠির সেই সকল ক্ষত্রিয়গণের সমক্ষে কমললোচন কৃষ্ণকে মধুর বাক্যে কহিলেন, হে জনার্দ্দন! অমরগণ যেমন ইন্দ্রকে আশ্রয় করিয়াছিলেন, আমরা সেইরূপ একমাত্র তোমাকে আশ্রয় করিয়া যুদ্ধে জয় ও সনাতন সুখ প্রার্থনা করিতেছি। তুমি আমাদিগের রাজ্যনাশ, শত্রুগণ কর্ত্তৃক প্রত্যাখ্যান ও নানাবিধ ক্লেশ, সকলই অবগত আছ। হে সৰ্ব্বেশ! হে ভক্তবৎসল! হে মধুসূদন! আমাদের সকলেরই সুখ ও যুদ্ধে গমন তোমাতেই নির্ভর করিতেছে। এক্ষণে আমার এই প্রার্থনা যে, আমার মন যেন তোমার প্রতি প্রসন্ন থাকে এবং তোমার প্রসাদে অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞা যেন সফল হয়। হে বার্ষ্ণেয়! আজি তুমি তরণীস্বরূপ হইয়া আমাদিগকে দুঃখ ও ক্রোধরূপ মহার্ণব হইতে উদ্ধার কর। সারথি যত্ন করিলে যুদ্ধে যেরূপ কাৰ্য্য করিতে পারে, রিপুবধোদ্যত রথী কদাচ সেরূপ করিতে পারেন না। অতএব হে শঙ্খচক্র গদাধর! এই অতলস্পর্শ কুরুসাগরে নিমগ্ন তরণীহীন পাণ্ডবগণকে উদ্ধার কর। তুমি আপৎকালে বৃষ্ণিগণকে যেরূপ পরিত্রাণ করিয়া থাক, সেইরূপ আমাদিগকেও এক্ষণে পরিত্রাণ কর। হে দেবদেবেশ! হে সনাতন! হে ক্ষেমঙ্কর! হে বিষ্ণু! হে জিষ্ণু! হে হরি! হে কৃষ্ণ! হে বৈকুণ্ঠ। হে পুরুষোত্তম! তোমাকে নমস্কার। নারদ তোমাকে পুরাতন ঋষি, বরদ, শার্ঙ্গী ও শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। তুমি তাঁহার বাক্য সার্থক কর।”
ধর্ম্মরাজ সভামধ্যে এই কথা কহিলে বাগ্মী বাসুদেব মেঘ গম্ভীর শব্দে প্রত্যুত্তর করিলেন, হে রাজন্! নরশ্রেষ্ঠ মহাবল-পরাক্রান্ত ধনঞ্জয় যে প্রকার ধনুর্দ্ধর, বীর্য্যবান্, অস্ত্রসম্পন্ন, রণবিখ্যাত, অমর্ষী ও তেজস্বী, অমর লোকেও কেহ সেরূপ নাই। সেই তরুণবয়স্ক বৃষস্কন্ধ দীর্ঘবাহু সিংহগতি মহাবীর ধনঞ্জয় আপনার শত্রুগণকে সংহার করিবেন। আমিও অর্জ্জুনের ন্যায় দুর্য্যোধনের সৈন্যগণকে বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইব। আজি মহাবল অর্জ্জুন সেই পাপকর্ম্মা ক্ষুদ্রস্বভাব সৌভদ্রঘাতী জয়দ্রথকে সুতীক্ষ্ণ শরনিকর দ্বারা ধরাতল হইতে অপসারিত করিবেন। গৃধ্র, শ্যেন ও প্রচণ্ড গোমায়ু প্রভৃতি নরমাংসলোলুপ হিংস্র জন্তুগণ তাহার মাংস ভক্ষণ করিবে। অধিক কি বলিব, যদি ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণও জয়দ্রথকে রক্ষা করেন, তথাপি আজি সঙ্কুল যুদ্ধে তাঁহাকে প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক যমরাজের রাজধানী গমন করিতে হইবে। হে ধর্ম্মরাজ! আজি ধনঞ্জয় নিশ্চয়ই সিন্ধুরাজকে সংহার করিয়া আপনার নিকট আগমন করিবেন, আপনি বিশোক, বিজ্বরও ঐশ্বৰ্য্যশালী হউন’।”