৮২তম অধ্যায়
সপ্তম-দিবসীয় যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর মহাবীর ভীষ্ম চিন্তাপরায়ণ রাজা দুর্য্যোদনকে পুনরায় আহ্লাদজনক বাক্য কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন! আমার বোধ হইতেছে যে, আমি, দ্রোণ, শল্য, কৃতবর্ম্মা, সাত্বত, অশ্বত্থামা, বিকৰ্ণ, সৈন্ধবগণসহ সোমদত্ত, অবস্তিদেশীয় বিন্দ-অনুবিন্দ, বাহ্লীকদেশীয় সৈন্যসসহিত মহারাজ বাহ্লীক, ত্ৰিগৰ্তরাজ, দুৰ্জয়, মাগধ, কৌশল্য, বৃহদ্বল, চিত্ৰসেন ও বিবিংশতি—আমরা সকলেই তোমার নিমিত্ত জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক সমরে সমুদ্যুত হইয়া অমরগণকেও পরাজয় করিতে পারি। অধিক কি, ধ্বজপাটমণ্ডিত [পতাকাযুক্ত ধ্বজশোভিত] সহস্ৰ-সহস্র রথ, আরোহিসনাথ দেশজাত অশ্ব, মদমত্ত প্ৰভিন্নগণ্ড [মদস্রাবী—মদস্রাবের পূর্ব্বে গলার একদেশ সহসা ভগ্ন হয়।] গজেন্দ্ৰ, নানাদেশসমূৎপন্ন বিবিধ আয়ুধধারী, মহাবলপরাক্রান্ত রথী, পদাতি ও অন্যান্য বহুসংখ্যক লোক, ইহারাও জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক তোমার নিমিত্ত সংগ্রামে সমুদ্যত হইয়া অমরগণকে জয় করিতে পারে। হে মহারাজ! তোমাকে হিতকর বাক্য বলা আমার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। ইন্দ্ৰাদি দেবগণও বাসুদেবসহায় মহেন্দ্ৰসম-বিক্রম পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন না। তথাপি আমি তোমার বাক্য রক্ষা করিব; হয় পাণ্ডবেরা আমাকে জয় করিবে, না হয় আমি তাহাদিগকে পরাজিত করিব।” এই বলিয়া পিতামহ ভীষ্ম তাঁহাকে অতি তেজস্বিনী বিশল্যকরণী [বেদনানাশক] ওষধি প্ৰদান করিলেন; তদ্দ্বারা দুৰ্য্যোধনের শল্য আপনীত হইল।
কৌরবপক্ষে ব্যূহরচনা
‘অনন্তর ব্যূহবিশারদ [ব্যূহরচনানিপুণ] ভীষ্ম বিমল প্রভাতকাল সমুপস্থিত হইলে অনেক সহস্র রথপরিবারিত [রথপরিবৃত], করি।-পদাতিসম্যাকুলযোদ্ধৃগণ পরিবৃত ঋষ্টি-তোমরধারি-পুরুষরক্ষিত, তুরগগণ-পরিপূর্ণ, অস্ত্রশস্ত্ৰসম্পন্ন মণ্ডলীব্যূহ, রচনা করিলেন। প্রত্যেক হস্তীর প্রতি সাত-সাত রথী, প্রত্যেক রথের প্রতি সাত-সাত অশ্ব, প্রত্যেক রথের প্রতি দশ-দশ ধনুৰ্দ্ধারী, প্রত্যেক ধনুৰ্দ্ধারীর প্রতি সাত-সাত পদাতি নিযুক্ত হইল। বীরবর ভীষ্ম এইরূপে মহাব্যূহরচনা করিয়া রক্ষা করিতে লাগিলেন। দশসহস্ৰ অশ্ব, দশসহস্ৰ হস্তী, দশসহস্ৰ রথ ও চিত্ৰসেনপ্রভৃতি বীরগণ বর্ম্ম ধারণ করিয়া ভীষ্মকে রক্ষা করিতে লাগিলেন; ভীষ্মও তাঁহাদিগের রক্ষাবিধানার্থ নিযুক্ত রহিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভূপালগণ বর্ম্ম ধারণ করিলে রাজা দুৰ্য্যোধন বর্ম্ম ধারণ ও রথারোহণ করিয়া দেবলোকস্থিত দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অনন্তর আপনার পুত্রেরা তুমুলধ্বনি করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। রথের বিপুল ঘর্ঘর-রব ও অনবরত বাদ্যোদ্যম হইতে লাগিল। পরে শক্রগণের একান্ত দুরধিগম্য, নিতান্ত দুর্ভেদ্য, মণ্ডলাকার ভীষ্মবিরচিত ধাৰ্তরাষ্ট্রগণের মহাব্যূহ পরামশোভাসম্পন্ন হইয়া পশ্চিমাভিমুখে গমন করিতে প্রবৃত্ত হইল।
পাণ্ডবপক্ষীয় ব্যূহরচনা
“মহারাজ যুধিষ্ঠির সেই পরম দারুণ মণ্ডলব্যূহ নিরীক্ষণ করিয়া বজব্যূহ রচনা করিলেন। তখন রথী ও নিষাদিসকল [গজারোহী সৈন্য] স্ব স্ব স্থানে অবস্থিত হইয়া সিংহনাদ করিতে লাগিল। উভয়পক্ষীয় বীর সকল নানাপ্রকার অস্ত্ৰধারণপূর্ব্বক সৈন্যগণসমভিব্যাহারে সমরাভিলাষী ও ব্যূহভেদার্থী হইয়া নিৰ্গত হইলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য মৎস্যের প্রতি, অশ্বত্থামা শিখণ্ডীর প্রতি, রাজা দুৰ্য্যোধন দ্রুপদের প্রতি, নকুল ও সহদেব মদ্ররাজ শল্যের প্রতি, অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ ইরাবানের প্রতি ধাবমান হইলেন। আর অন্যান্য সমস্ত ভূপাল অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন যত্নসহকারে হার্দ্দিক্রকে আক্রমণ করিলেন। অভিমন্যু চিত্ৰসেন, বিকৰ্ণ ও দুর্ম্মর্ষণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। যেমন মত্তমাতঙ্গ অন্য মাতঙ্গের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ রাক্ষস ঘটোৎকচ মহাবেগে প্ৰাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্তের প্রতি ধাবমান হইলেন
সঙ্কুলযুদ্ধে কৌরবপরাজয়
“অনন্তর রাক্ষস অলম্বুয নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সসৈন্য যুদ্ধদুর্ম্মদ সাত্যকির প্রতি ধাবমান হইল। ভূরিশ্রবা যত্নবান হইয়া ধৃষ্টকেতুর সহিত, ধর্ম্মানন্দন রাজা যুধিষ্ঠির শ্রুতায়ুর সহিত এবং চেকিতান কৃপের সাহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। অবশিষ্ট বীর সকল যত্নসহকারে ভীমসেনের প্রতি গমন করিলে সহস্ৰ-সহস্র ভূপাল শক্তি, তোমর, নারাচ, গদা ও পরিঘহস্তে অর্জ্জুনকে বেষ্টন করিলেন। তখন মহাবীর অর্র্জুন অতিশয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কৃষ্ণকে কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! ঐ দেখ মহাত্মা ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনের ব্যূহ রচনা করিয়াছেন। ঐ দেখ, সমরাভিলাষী অসংখ্য মহাবীর; ঐ দেখ, ত্ৰিগর্ত্তরাজ ভ্ৰাতৃবর্গের সহিত অবস্থান করিতেছেন। এক্ষণে যাহারা আমার সহিত যুদ্ধ করিবার অভিলাষ করিতেছে, আজি তাহাদিগকে তোমার সমক্ষে সংহার করিব।” এই বলিয়া বীরবর অর্জ্জুন শরাসন আস্ফালনপূর্ব্বক ভূপালগণের প্রতি অনবরত শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। জলদজাল যেমন বর্ষাকালে জলধারাদ্বারা তাড়াগাদি পরিপূর্ণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ সেই সমস্ত ভূপালগণ শরবৃষ্টিদ্বারা অর্জ্জুনকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন আপনার সৈন্যগণ কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে শরাচ্ছন্ন দেখিয়া সাতিশয় কোলাহল করিতে লাগিল। দেব, দেবর্ষি, গন্ধর্ব্ব ও উরগগণ সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন।
“অনন্তর অর্জ্জুন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ঐন্দ্র-অস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন। আমরা তাঁহার অদ্ভুত পরাক্রম অবলোকন করিতে লাগিলাম। তিনি অস্ত্ৰজালদ্বারা শক্ৰপ্ৰযুক্ত অস্ত্র নিরাকৃত করিয়া সহস্র ভূপাল, হস্তী ও অন্যান্য লোকদিগকে দুই-তিনশরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন, সকলেই তাঁহার শরজাালে ভিন্নকলেবর হইয়া ভীষ্মসন্নিধানে গমন করিল। তিনি তাহাদিগকে অগাধ বিপদসাগরে নিমগ্ন নিরীক্ষণ করিয়া রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্ৰবৃত্ত হইলেন। অনন্তর পাণ্ডবেরা আপনার বলমধ্যে নিপতিত হইলে তাহারা অনিলক্ষুভিত [বায়ুচালিত] মহার্ণবের ন্যায় ছিন্নভিন্ন হইয়া উঠিল।”