৮১তম অধ্যায়
যুদ্ধভীত দুৰ্য্যোধনের ভীষ্মসহ গুপ্তমন্ত্রণা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবল পরাক্রান্ত পরস্পর কৃতাপরাধ বীরপুরুষেরা শোণিতলিপ্তকলেবরে স্ব স্ব শিবিরে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। পরে পরস্পর বিধানানুসারে সৎকার করিয়া যুদ্ধ করিবার অভিলাষে পুনরায় কবচ ধারণ করিলেন। শোণিতসিক্তকলেবরে মহারাজ দুৰ্য্যোধন একান্ত চিন্তিত হইয়া বিশ্বস্তমনে পিতামহ ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে পিতামহ! পাণ্ডবপক্ষীয় রথিসকল সত্বর আমাদিগের ধ্বজদণ্ডধারী ভয়ঙ্কর বিপুল বলসমুদয়কে বিদারিত, নিপীড়িত, নিহত এবং বিমোহিত করিয়া মহীয়সী কীর্ত্তি লাভ করিয়াছেন। আমি বজ্রের ন্যায় নিতান্ত দুর্ভেদ্য মকরব্যূহে প্রবেশ করিয়াও ভীমসেনকর্ত্তৃক যমদণ্ডতুল্য ভয়ঙ্কর শরজালে তাড়িত এবং তাহাকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া ভয়ে নিতান্ত বিহ্বল হইয়াছিলাম; এজন্য শান্তিলাভ করিতে সমর্থ হইতেছি না; কিন্তু কেবল আপনার অনুকম্পায় জয়লাভ ও পাণ্ডবদিগকে বিনাশ করিতে অভিলাষ করিতেছি।”
“তখন মহাত্মা ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনকে জাতক্ৰোধ [পূর্ব্ববৈরস্মরণে উদ্দীপ্তরোষ] বিবেচনা করিয়া সহাস্যমুখে কহিলেন, “মহারাজ! আমি পরম যত্নসহকারে সেনামধ্যে প্রবেশ করিয়া তোমাকে বিজয় ও সুখ প্ৰদান করিবার অভিলাষ করি; তোমার কাৰ্য্যসংসাধনাৰ্থ কোন বিষয়েই অধ্যবসায়শূন্য হই না। যে সমস্ত মহাবলপরাক্রান্ত মহারথ বীরপুরুষেরা রণস্থলে পাণ্ডবগণের সাহায্য করিয়া থাকেন, তাঁহারা গতক্লম হইয়া রোষাবিষ উদগার করিতেছেন; তুমি তাঁহাদিগের সহিত শত্রুতা করিয়াছ। এক্ষণে সেই সমস্ত সমধিকবীৰ্য্যসম্পন্ন ব্যক্তিদিগকে সহসা পরাজিত করিতে কেহই সমর্থ হইবে না। অতএব আমি জীবিতনিরপেক্ষ হইয়া সর্ব্বপ্রকারে ইহাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব। হে মহানুভব! পাণ্ডবদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া প্ৰাণপণে তোমার প্রিয়কাৰ্য্য সংসাধন করিব। বিপক্ষের কথা দূরে থাকুক, তোমার নিমিত্ত দেব, দৈত্য ও লোকসমুদয়কে দগ্ধ করিয়া ফেলিব।’
“মহারাজ দুৰ্য্যোধন এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র অতিমাত্র প্রীত হইয়া সমস্ত সৈন্য ও মহীপালগণকে যুদ্ধার্থ নিৰ্গত হইতে আদেশ করিলেন। তখন রথ, অশ্ব, গজ ও পদাতিসঙ্কুল নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্ৰধারী বলসমুদয় পরমকুতূহলে নিৰ্গত হইল এবং রণস্থলে উপস্থিত হইয়া সাতিশয় শোভাপ্রাপ্ত হইতে লাগিল। মাতঙ্গগণ চতুর্দ্দিকে দলবদ্ধ ও প্রণালীক্ৰমে চালিত হইয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। সৈন্যসকল অস্ত্রশস্ত্ৰবিৎ ভূপালগণসমভিব্যাহারে সুশোভিত হইতে লাগিল। বালার্কসঙ্কাশ [প্রভাতরৌদ্রের আভাষ লোহিত]; ধূলিজাল নিয়মানুসারে পরিচালিত রথ, অশ্ব, গজ ও পদাতিসমূহদ্বারা উদ্ধৃত হইয়া সূৰ্য্যকিরণ সমাচ্ছন্ন করিল। যেমন নীরদমধ্যগত ও বায়ুপ্রেরিত বিদ্যুৎ নভোমণ্ডলে শোভা পাইয়া থাকে, তদ্রূপ নানাবর্ণসম্পন্ন রথ, হস্তী ও পদাতিসকল ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিয়া শোভাপ্রাপ্ত হইল। যেমন সত্যযুগে মন্থনকালে সমুদ্রের অতি গভীর শব্দ সমুত্থিত হইয়াছিল, মহীপালগণের শরাসন আকর্ষণসময়ে তদ্রূপ ঘোরতর ধ্বনি প্রাদুর্ভূত হইতে লাগিল। হে মহারাজ! তখন রাজা দুৰ্য্যোধনের শত্রুসৈন্যসংহারকারী, নানাবর্ণসম্পন্ন, অত্যুগ্রনিনাদসংযুক্ত সৈন্যগণ প্ৰলয়কালীন মেঘের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল।”