একাশীতিতম অধ্যায়
যযাতির সহিত দেবযানীর পরিচয়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! কিয়ৎকাল অতীত হইলে বরবর্ণিনী দেবযানী ক্রীড়াভিলাষে পুনর্ব্বার সেই বলে প্রবেশ করিলেন। তিনি হৃষ্টচিত্তে শর্ম্মিষ্ঠা ও সেই সমস্ত সখীগণ সমভিব্যাহারে যথেচ্ছ বনবিহার করিতেছেন; কেহ প্রফুল্ল মনে মধুপান করিতেছে, কেহ সুস্বাদ ফল ভক্ষণ করিতেছে, কেহ বা অন্যান্য ভক্ষদ্রব্য ভোজন করিতেছে, ইত্যবসরে মৃগয়াবিহারী নহুষতনয় যযাতি মৃগের অনুসরণক্রমে একান্ত ক্লান্ত ও পিপাসার্ত্ত হইয়া জলান্বেষণ করিতে করিতে পুনর্ব্বার সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। তিনি দেখিলেন, সর্ব্বালঙ্কারভূষিতা কন্যাগণবেষ্টিতা মধুরহাসিনী এক পরমসুন্দরী কামিনী তথায় উপবেশন করিয়া আছেন এবং পরমসুকুমারী এক রাজকুমারী তাঁহার পদসেবা করিতেছেন।
রাজা ক্রমশঃ তাঁহাদিগের সন্নিহিত হইয়া সমুচিত সমাদর প্রদর্শনপূর্ব্বক দেবযানীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভদ্রে! তোমরা জন্মগ্রহণ করিয়া কোন বংশ অলঙ্কৃত করিয়াছ? তোমার ও তোমার এই পরিচারিকার নাম কি এবং এই সকল সখীগণই বা কে?” দেবযানী কহিলেন, “আমি সবিশেষ নিবেদন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন মহারাজ! আমি দৈত্যগুরু শুক্রের কন্যা, আর আমার এই পরিচারিকা দানবরাজ বৃষপর্ব্বার দুহিতা। ইনি দাসীভাবে সততই আমার অনুগামিনী থাকেন।” ইহা শুনিয়া রাজা কৌতূহলপরতন্ত্র হইয়া পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুন্দরী! ইনি দানবরাজ বৃষপর্ব্বার কন্যা হইয়া কি কারণে তোমার দাসী হইলেন, জানিতে নিতান্ত ঔৎসুক্য হইতেছে। দেবযানী কহিলেন, “দৈবনির্ব্বন্ধ কেহই অতিক্রম করিতে পারে না,সুতরাং রাজকন্যা যে আমার পরিচারিকা হইবে, ইহা বড় আশ্চর্য্য নহে, অতএব সে বিষয়ের আর বিশেষ অনুসন্ধান করিবার আবশ্যকতা নাই। মহাশয়! আপনার আকার ও বেশ দেখিয়া রাজা ও বাগ্বিন্যাসপটুতা দেখিয়া পণ্ডিত বলিয়া বোধ হইতেছে, অতএব বলুন, আপনি কে, কাহার পুৎত্র এবং কোথা হইতে আগমন করিতেছেন?” যযাতি কহিলেন, “আমি শৈশবকালে ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করিয়া সমস্ত বেদ-বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করিয়াছি। আমি রাজা ও রাজকুলে উৎপন্ন বটে; আমার নাম যযাতি।” দেবযানী কহিলেন, “মহারাজ! আপনি কি উদ্দেশ্যে এই অরণ্যে আসিয়াছেন, শুনিতে অভিলাষ করি।” রাজা কহিলেন, “সুন্দরি! আমি মৃগয়ার্থ নগরী হইতে নির্গত হইয়া মৃগের অনুসরণক্রমে বনে বনে ভ্রমণ করিয়া একান্ত পরিশ্রান্ত ও বলবতী পিপাসায় নিতান্ত অভিভূত হইয়া জলপানাভিলাষে এই প্রদেশে উপস্থিত হইয়াছি; কিন্তু এক্ষণে আমার শ্রান্তি দূর ও পিপাসা নিবৃত্তি হইয়াছে, কথাপ্রসঙ্গে গমনকাল অতিক্রান্ত হইতেছে, অতএব অনুমতি কর প্রস্থান করি।” দেবযানী কহিলেন, “মহারাজ! এই দুই সহস্র কন্যা ও পরিচারিকা শর্মিষ্ঠার সহিত আমি আপনার অধীন হইলাম, অদ্যাবধি আপনি আমার সখা ও ভর্ত্তা হইলেন।”
যযাতির দেবযানী-পাণিগ্রহণ
রাজা সহসা এই অসম্ভাবিত আত্মসমর্পণ ব্যাপার অবলোকন করিয়া বিস্ময়োৎফুল্ল-লোচনে ও বিনয়বচনে দেবযানীকে কহিলেন, “হে শুক্রতনয়ে! ইহা তোমার শ্রেয়ঃকল্প নহে; দেখ, তুমি ব্রাহ্মণকন্যা, আমি ক্ষৎত্রিয়জাতি, আমি কোনরূপেই তোমার উপযুক্ত পাত্র নহি, আর তোমার পিতা শুক্রাচার্য্য কদাচ এ বিষয়ে সম্মতি প্রদান করিবেন না।” দেবযানী কহিলেন, “মহারাজ! ব্রাহ্মণেরা সর্ব্বদাই ক্ষৎত্রিয়ের সহিত সংসৃষ্ট হইয়া থাকেন এবং ক্ষৎত্রিয়েরাও কোন কোন সময়ে ব্রাহ্মণের সহিত সংসৃষ্ট হইয়া থাকেন, সুতরাং এই উভয়ের যেরূপ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, তাহাতে আমাকে ভার্য্যারূপে অঙ্গীকার করা আপনার পক্ষে নিতান্ত দোষাবহ নহে; বিশেষতঃ আপনি স্বয়ং ঋষি ও ঋষিপুৎত্র; অতএব এ বিষয়ে কোন সংশয় না করিয়া আমার পাণিগ্রহণ করুন।” যযাতি কহিলেন, “হে সুন্দরি! চারি বর্ণই একের অঙ্গ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, সত্য বটে, কিন্তু সকল বর্ণের ধর্ম্ম ও আচার-ব্যবহার-বিষয়ে বিস্তর বৈলক্ষণ্য লক্ষিত হইয়া থাকে। তন্মধ্যে ব্রাহ্মণের ধর্ম্মপ্রণালী ও আচার-পরম্পরা সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট, সুতরাং ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট, অতএব আমি হীনবর্ণ হইয়া কিরূপে শ্রেষ্ঠবর্ণের কন্যা গ্রহণ করিব?” তখন দেবযানী কহিলেন, “মহারাজ! পাণিগ্রহণ করিলেই বিবাহক্রিয়া নির্ব্বাহ হইয়া থাকে, এ প্রথা পূর্ব্বাপর প্রচলিত আছে, অতএব বিবেচনা করিয়া দেখুন, যৎকালে আমি অন্ধকূপে পতিত হইয়াছিলাম, তখন আপনিই আমার পাণিগ্রহণ করিয়া উদ্ধার করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত আপনাকে পতিত্বে বরণ করিতে এত আগ্রহাতিশয় প্রকাশ করিতেছি। সূক্ষ্ণ বিবেচনা করিয়া দেখিলে তদবধিই আপনি আমার পতি হইয়াছেন, অতঃপর আর কেহই আমার পাণিস্পর্শ করিবে না।” তখন যযাতি কহিলেন, “হে দেবযানী! মহাবিষ, আশীবিষ ও সুতীক্ষ্ণ শর অপেক্ষাও কোপাক্রান্ত ব্রাহ্মণ সাতিশয় দুর্দ্ধর্ষ, এই কথা সকলেই স্বীকার করিয়া থাকেন।” দেবযানী কহিলেন, “মহারাজ! কি কারণে এরূপ কহিতেছেন, স্থির করিতে পারিতেছি না।” রাজা প্রত্যুত্তর করিলেন, “দেখ সর্পাঘাতে ও শস্ত্রপাতে একের প্রাণ বিনষ্ট হইতে পারে, কিন্তু ব্রাহ্মণ কুপিত হইলে গ্রাম, নগর, বন ও উপবন প্রভৃতি সকলই ভস্মসাৎ করেন, সুতরাং আমার মতে ব্রাহ্মণ নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ। অতএব হে দেবযানী! তোমার পিতা সম্প্রদান না করিলে আমি তোমার পাণিগ্রহণ করিতে পারি না।” তখন দেবযানী কহিলেন, “মহারাজ! আমি আপনাকে স্বয়ং বরণ করিয়াছি, এ কথা শুনিয়া পিতা আসিয়া অবশ্যই আপনার হস্তে আমাকে সম্প্রদান করিবেন। অযাচিতা বা পিতৃদত্ত কন্যা গ্রহণ করিলে পাণিগ্রহীতার কোন বিপদের সম্ভাবনা নাই।” এই বলিয়া দেবযানী স্বীয় পরিচারিকা ঘূর্ণিকা দ্বারা পিতৃসন্নিধানে আপন অভিপ্রায় নিবেদন করিয়া পাঠাইলেন। মহর্ষি শুক্র ধাত্রী মুখে আদ্যোপান্ত সমস্ত অবগত হইয়া রাজদর্শনার্থ সেই কাননে উপনীত হইলেন। রাজা যযাতি শুক্রাচার্য্যকে তথায় আগত দেখিয়া অভিবাদনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান রহিলেন। এই অবসরে দেবযানী পিতাকে কহিলেন, “হে তাত! ইনি নহুষতনয় রাজা যযাতি। আমি অন্ধকূপে পতিত হইলে এই মহাত্মা আমার পাণিগ্রহণ করিয়া উদ্ধার করিয়াছিলেন; সুতরাং ইনি তাহাতেই আমার পাণিগ্রহীতা হইয়াছেন, অতএব আপনি এই সৎপাত্রে আমাকে সম্প্রদান করুন; আমি আর অন্য ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ করিব না।” তখন শুক্রাচার্য্য রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে নহুষনন্দন! আমার কন্যা তোমাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছে, অতএব আমি প্রসন্ন-মনে সম্প্রদান করিতেছি, তুমি ইহাকে মহিষীরূপে গ্রহণ কর।” যযাতি কহিলেন,”ভগবান্! ক্ষৎত্রিয় হইয়া ব্রাহ্মণনন্দিনীর পাণিগ্রহণ করিলে বর্ণসঙ্করজনিত দোষে পরিলিপ্ত হইতে হয়, এই ভয়ে আমি আপনার কন্যাকে বিবাহ করিতে সম্মত নহি।” শুক্র কহিলেন, “মহারাজ! তুমি অভিলাষনুরূপ বর প্রার্থনা কর, আমি তোমাকে অধর্ম্ম হইতে মোচন করিব, এ বিষয়ে তোমার কোন আশঙ্কা নাই, সত্যই আমি তোমার পাপাপনোদন করিব, তুমি বিধানানুসারে দেবযানীর পাণিগ্রহণ কর, প্রার্থনা করি, তোমাদের উভয়ের অতিমাত্র সদ্ভাব হউক; কিন্তু এই অসুররাজকুমারী শর্ম্মিষ্ঠা তোমার পূজনীয়া হইবেন; তুমি কদাচ ইঁহাকে পরিণয় করিও না।”
রাজা যযাতি এইরূপ আদিষ্ট হইয়া হৃষ্টমনে শুক্রকে প্রদক্ষিণ পূর্ব্বক বিধানানুসারে দেবযানীর পাণিগ্রহণ করিলেন। অনন্তর তিনি মহর্ষি শুক্র ও দানবগণ কর্ত্তৃক সমাদৃত ও সৎকৃত হইয়া সেই দুই সহস্র কন্যার সহিত শর্ম্মিষ্ঠা ও দেবযানীকে সমভিব্যাহারে লইয়া নিজ রাজধানীতে প্রত্যাগমন করিলেন।