৮১তম অধ্যায়
জ্ঞাতি বাধ্য করার উপায়—কৃষ্ণনারদসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! জ্ঞাতিবর্গের প্রতি সমাদর প্রকাশ করিলে বন্ধুবান্ধবগণ এবং বন্ধুবান্ধবগণের সমাদর করিলে জ্ঞাতিগণ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে; অতএব ঐ উভয়পক্ষকে কিরূপে বশীভূত করা যাইবে?”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! এক্ষণে আমি বাসুদেব ও নারদসংবাদনামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর; তাহা হইলে তোমার সংশয় দূর হইবে। একদা মহাত্মা বাসুদেব দেবর্ষি নারদকে কহিলেন, নারদ! মূর্খ মিত্র ও চপলচিত্ত পণ্ডিতের নিকট গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করা কর্ত্তব্য নহে। তুমি আমার পরমবন্ধু এবং তোমার বুদ্ধিবলও সুতীক্ষ্ণ। অতএব এক্ষণে আমি তোমার নিকট এক গুহ্য বিষয় প্রকাশ করিতেছি, শ্রবণ কর। জ্ঞাতিদিগকে ঐশ্বর্য্যের অর্ধাংশ প্রদান ও তাহাদের কটুবাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাদিগের দাসের ন্যায় অবস্থান করিতেছি। বহ্নিলভার্থী ব্যক্তি যেমন অরণিকাষ্ঠকে মথিত করিয়া থাকে, তদ্রূপ জ্ঞাতিবর্গের দুৰ্ব্বাক্য নিরন্তর আমার হৃদয় দগ্ধ করিতেছে। বলদেব, বল, গদ, সুকুমার এবং আমার আত্মজ প্রদ্যুম্ন সৌন্দৰ্য্যপ্রভাবে জনসমাজে অদ্বিতীয় বলিয়া পরিগণিত হইয়াছেন। আর অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়েরাও মহাবলপরাক্রান্ত, উৎসাহসম্পন্ন ও অভ্যুদয়শালী। তাঁহারা যাহার সহায়তা না করেন, সে বিনষ্ট হয় এবং যাহার সহায়তা করেন, সে অনায়াসে অসামান্য ঐশ্বৰ্য্য লাভ করিয়া থাকে। ঐ সকল ব্যক্তি আমার পক্ষে থাকিতেও আমি অসহায় হইয়া কালযাপন করিতেছি। আহুক ও অক্রূর আমার পরমসুহৃৎ, কিন্তু ঐ দুইজনের মধ্যে একজনকে স্নেহ করিলে অন্যের ক্রোধাদ্দীপন হয়; সুতরাং আমি কাহারও প্রতি স্নেহ প্রকাশ করি না। আর নিতান্ত সৌহার্দ্দ্যবশতঃ উহাদিগকে পরিত্যাগ করাও অতি সুকঠিন। অতঃপর আমি এই স্থির করিলাম যে, আহুক ও অক্রূর যাহার পক্ষে, তাহার দুঃখের পরিসীমা নাই, আর তাঁহারা যাহার পক্ষে নহেন, তাহা অপেক্ষাও দুঃখী আর কেহই নাই। যাহা হউক, এক্ষণে আমি দূতকারী সহোদরদ্বয়ের মাতার ন্যায় উভয়েরই জয় প্রার্থনা করিতেছি। হে নারদ! আমি ঐ দুই মিত্রকে আয়ত্ত করিবার নিমিত্ত এইরূপ কষ্ট পাইতেছি। অতঃপর আমার জ্ঞাতিবর্গের যাহা হিতকর, তাহা কীৰ্ত্তন কর।
“নারদ কহিলেন, “বাসুদেব! আপদ দুই প্রকার– বাহ্য ও আন্তরিক। মনুষ্য আপনার বা অন্যের দোষেই ঐ দুইপ্রকার আপদে আক্রান্ত হইয়া থাকে। এক্ষণে তোমার কর্ম্মদোষেই অক্রূর ও আহুক হইতে এই আন্তরিক আপদ সমুৎপন্ন হইয়াছে। বলদেব প্রভৃতি মহাবীরগণ অক্রূরের জ্ঞাতি। উহারা অর্থপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় স্বেচ্ছাক্রমে অথবা অন্যের তিরস্কারবশতঃ তোমার বিপক্ষ হইয়া উঠিয়াছেন। বিশেষতঃ তুমি স্বয়ং ঐশ্বৰ্য্যলাভ করিয়াছিলে, তাহা অন্যকে বিভাগ করিয়া দিয়া আপনিই আপনার বিপদের কারণ হইয়াছ। এক্ষণে উদ্বান্ত [বমি করিয়া তুলিয়া ফেলা] অন্নের ন্যায় সেই ঐশ্বৰ্য্য গ্রহণ করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। তুমিও বভূ ও উগ্রসেনকে যে রাজ্য প্রদান করিয়াছ, এক্ষণে জ্ঞাতিভেদভয়ে কোনক্রমেই তাহা লইতে পারিবে না। যদিও বহুকষ্টে অতিদুষ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক কথঞ্চিৎ উহা গ্রহণ কর, তাহা হইলে হয় বিপুল ধনক্ষয়, না হয় অসংখ্য লোকের প্রাণবিয়োগ হইবে। অতএব এক্ষণে অলৌহনির্ম্মিত হৃদয়বিদারক মৃদু অস্ত্র পরিগ্রহ করিয়া জ্ঞাতিদিগের মূকতা সম্পাদন কর।
“বাসুদেব কহিলেন, ‘দেবর্ষে! যে অস্ত্র পরিগ্রহ করিয়া জ্ঞাতিদিগের মূকতা-সম্পাদন করিতে হইবে, আমি তাহা অবগত নহি। তুমি আমার নিকট উহা প্রকাশ কর।
‘নারদ কহিলেন, ‘কেশব! ক্ষমা, সরলতা ও মৃদুতা প্রদর্শন, যথাশক্তি অন্নদান এবং উপযুক্ত ব্যক্তির পূজা করাকেই অলৌহনির্ম্মিত অস্ত্র কহে। জ্ঞাতিগণ কটুবাক্য-প্রয়োগে উদ্যত হইলে তুমি স্বীয় বাক্যদ্বারা তাঁহাদিগের ক্রূরতা ও অসদভিসন্ধিসমূহের শান্তিবিধান করিবে। প্রশান্তচিত্ত, সহায়সম্পন্ন মহাপুরুষ ভিন্ন কেহই কখন গুরুতর ভারবহনে সমর্থ হয় না; অতএব তুমি ঐ সকল গুণ অবলম্বনপূৰ্ব্বক উহা বহন কর। মহাবলপরাক্রান্ত বলীবর্দ্দই দুর্গম প্রদেশে দুৰ্ব্বহ ভার বহন করিতে পারে। ভেদ উপস্থিত হইলে এককালে সকলেই বিনষ্ট হয়। এক্ষণে তুমি যদুবংশীয়দিগের অধিপতি; অতএব তুমি উপস্থিত থাকিতে যাহাতে তোমার জ্ঞাতিবর্গ ভেদনিবন্ধন উৎসন্ন না হয়, তাহার উপায় কর। বুদ্ধি, ক্ষমা, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ ও ধনাশা পরিত্যাগ প্রভৃতি গুণসব না থাকিলে কেহই কখন যশস্বী হইতে পারে না। সর্ব্বদা স্বপক্ষের উন্নতিসাধন করিলে ধৰ্ম্ম, কীৰ্ত্তি ও সুদীর্ঘ পরমায়ু লাভ হইয়া থাকে। অতএব যাহাতে জ্ঞাতিবর্গের বিনাশ না হয়, তুমি তাহার উপায়বিধান কর। নীতিবিধান ও যুদ্ধযাত্রার বিষয় তুমি বিলক্ষণ অবগত আছ। যাদব, কুকুর, ভোজ, অন্ধক, বৃষ্ণি ও অন্যান্য নরপতিগণ তোমারই একান্ত অনুরক্ত; ঋষিগণও সতত তোমার উন্নতি প্রার্থনা করিয়া থাকেন। তুমি সকল জীবের ঈশ্বর। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান কিছুই তোমার অবিদিত নাই। যাদবগণ তোমাকে আশ্রয় করিয়া পরম সুখসম্ভোগ করিতেছে।’ ”