৮১তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের অস্ত্রলাভ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! তখন মহাত্মা ধনঞ্জয় কৃতাঞ্জলিপুটে প্রসন্ন মনে উৎফুল্ল নয়নে সমস্ত তেজোনিধান বৃষধ্বজের প্রতি দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক তাঁহার নিকটে বাসুদেব নিবেদিত স্বকৃত নিশাহ নিত্য উপহার অবলোকন করিলেন এবং মনে মনে মহাদেব ও বাসুদেবকে পূজা করিয়া মহেশ্বরকে কহিলেন, হে দেব! আমি দিব্য অস্ত্র লাভ করিতে অভিলাষ করি।
মহাদেব ধনঞ্জয়ের অভিলাষ অবগত হইয়া সস্মিতবদনে তাঁহাকে ও বাসুদেবকে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন, হে পুরুষোত্তমদ্বয়! আমি তোমাদিগের মনের অভিলাষ অবগত হইয়াছি; তোমরা যে কামনায় আগমন করিয়াছ, আমি অবিলম্বে তাহা প্রদান করিতেছি। এই স্থানের অতি সন্নিকটে এক অমৃতময় দিব্য সরোবর আছে, সেই সরসীতে দিব্য ধনু ও শর নিহিত রহিয়াছে, ঐ শর ও শরাসন দ্বারা আমি সংগ্রামে সুরারিগণকে সংহার করিয়াছিলাম। তোমরা সেই ধনুর্ব্বাণ আনয়ন কর।”
তখন নর ও নারায়ণ তথাস্তু বলিয়া মহাদেবের পারিষদগণ সমভিব্যাহারে শত শত বিস্ময়কর দিব্য পদার্থ সমাকুল, পরম পবিত্ৰ, সৰ্বার্থ-সাধক, সূর্য্যমণ্ডল সন্নিত সেই বৃষভধ্বজ নির্দ্দিষ্ট সরোবরে গমন করিলেন। তথায় সলিলের অভ্যন্তরে দুইটি ভুজঙ্গ তাঁহাদিগের নয়নগোচর হইল; একটি নিতান্ত ভীষণ এবং দ্বিতীয়টি সহস্ৰশীর্ষ ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী, উহার সহস্র মুখ হইতে বিপুল অনল শিখা বিনির্গত হইতেছে। তখন বেদজ্ঞ ধনঞ্জয় ও বাসুদেব জল স্পর্শ পূর্ব্বক কৃতাঞ্জলি পুটে পরম যত্ন সহকারে মহাদেবকে স্মরণ ও অসংখ্য প্রণাম এবং শত রুদ্ৰীয় বেদ উচ্চারণ করিয়া সেই নাগদ্বয়কে নমস্কার করিয়া আরাধনা করিতে লাগিলেন।
তখন সেই মহাভুজঙ্গদ্বয় ভগবান্ রুদ্রের মাহাত্মে নাগরূপ পরিত্যাগ পূর্ব্বক শত্রুনাশন শর ও শরাসনের রূপ ধারণ করিল। মহাত্মা বাসুদেব ও ধনঞ্জয় তদ্দর্শনে প্রীত হইয়া সেই প্রভা সম্পন্ন ধনু ও শরাসন গ্রহণ পূর্ব্বক আনয়ন ও মহাদেবকে প্রদান করিলেন। তখন পিঙ্গলাক্ষ ধূমলবর্ণ, তপস্যার আধার এক মহাবল পরাক্রান্ত ব্রহ্মচারী মহাদেবের পার্শ্ব হইতে বিনির্গত হইয়া সেই ধনু গ্রহণ করিলেন এবং দক্ষিণজঙ্ঘা প্রসারণ ও বামপদ সঙ্কোচপূর্ব্বক অবস্থান করিয়া শরসমেত সেই শরাসন আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। অচিন্ত্য বিক্রম ধনঞ্জয় তাঁহার মৌৰ্ব্বী আকর্ষণ, ধনুর্ধারণ ও পাদসংস্থান অবলোকন এবং ভবমুখ নিঃসৃত মন্ত্র শ্রবণ করিয়া গ্রহণ করিলেন। তখন বলবান্ প্রভাবশালী ব্রহ্মচারী সেই সরোবরেই সেই শর ও শরাসন পরিত্যাগ করিলেন। স্মৃতিমান অর্জ্জুন মহাদেবকে প্রসন্ন জানিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন যে, আমি পূর্ব্বে অরণ্যানী মধ্যে মহেশ্বরের নিকট যে বর প্রাপ্ত হইয়াছিলাম সেই বর এবং উহার সন্দর্শন সফল হউক। মহাদেব অর্জ্জুনের অভিপ্রায় অবগত হইয়া প্রীত মনে তাঁহাকে ভীষণ পাশুপত অস্ত্র সমর্পণ পূর্ব্বক ‘প্রতিজ্ঞা হইতে উদ্ধার হও’ বলিয়া বর প্রদান করিলেন। দুর্দ্ধর্ষ ধনঞ্জয় পুনরায় ঈশ্বর হইতে দিব্য পাশুপত অস্ত্র লাভ করিয়া পুলকিত হইয়া আপনাকে কৃতকাৰ্য্য জ্ঞান করিতে লাগিলেন।
অনন্তর অর্জ্জুন ও বাসুদেব উভয়ে হৃষ্ট চিত্তে মহাদেবকে অভিবাদন করিলেন। তৎপরে জম্ভাসুবধার্থী ইন্দ্র ও বিষ্ণু যেমন মহাসুরনিপাতী মহেশ্বরের অনুমতি অনুসারে প্রীত হইয়া গমন করিয়াছিলেন, তাঁহারাও সেই রূপ তাঁহার অনুমতি লইয়া পরমানন্দে স্বীয় শিবিরে উপস্থিত হইলেন।