৮০তম অধ্যায়
ভীম-দুৰ্য্যোধনযুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর ভগবান ভাস্কর লোহিতবর্ণ ধারণ করিলে রণদুর্ম্মদ মহাবীর দুৰ্য্যোধন ভীমসেনকে নিহত করিবার বাসনায় তাহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন সেই প্রধান শত্রু দুৰ্য্যোধনকে সমাগত দেখিয়া ক্রুদ্ধচিত্তে কহিতে লাগিলেন, “হে গান্ধারীতনয়! আমি বহুদিন অবধি যে সময় প্রতীক্ষা করিয়া আছি, অদ্য সেই সময় সমুপস্থিত হইয়াছে; যদি তুমি রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন না কর, তবে নিশ্চয়ই আজি তোমাকে সংহার করিয়া কুন্তীর দুঃখ, আমাদের বনবাসক্লেশ ও দ্রৌপদীর দুঃসহ যন্ত্রণা প্রশমিত করিব। তুমি পূর্ব্বে দৰ্পসহকারে পাণ্ডবগণের যে অবমাননা করিয়াছিলে, এক্ষণে সেই পাপের ফলভোগের সময় সমুপস্থিত হইয়াছে। তুমি পূর্ব্বে কর্ণ ও শকুনির মতানুসারে পাণ্ডবগণের বলবিক্রম চিন্তা না করিয়া যে যথেচ্ছাচার করিয়াছিলে, বাসুদেব সন্ধি প্রার্থনা করিলে তাঁহার যে অপমান করিয়াছিলে এবং হৃষ্টচিত্তে উলুক-দূতদ্বারা আমাদিগের নিকট যে সংগ্রামাভিলাষ প্রকাশ করিয়াছিলে, সেই অপরাধে আজি তোমাকে সবান্ধবে সংহার করিব; আর তুমি পূর্ব্বে অন্যান্য যেসকল অনিষ্ট করিয়াছ, তাহারও প্রতিবিধান করিব।”
“মহাবীর ভীমসেন এই বলিয়া শরাসন আকর্ষণ এবং মহাশনি ও প্রজ্বলিত হুতাশনতুল্য আজিহ্মগ [ঋজুগামী] ঘোরতর ষট্ত্রিংশৎ বাণ গ্রহণপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনের উপর নিক্ষেপ করিলেন; পরে দুইশরে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া, দুইশরে তাঁহার সারথিকে ও চারিশরে অশ্বগণকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক অন্য শরদ্বয়ে তাঁহার ছত্র ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর নিশিতশরত্ৰয় নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার ধ্বজচ্ছেদন করিয়া তাঁহার সমক্ষে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধনের নানাররত্নভূষিত ধ্বজ ভীমশরে ছিন্ন হইয়া বারিদবিনিঃসৃত [মেঘ হইতে নিৰ্গত] বিদ্যুতের ন্যায় রথ হইতে ভূতলে নিপতিত হইল; সমুদয় ভূপতিগণ সেই সূৰ্য্যসদৃশ প্রজ্বলিত, ছিন্ন, মণিময় নাগধ্বজ [গজচিহ্নিত ধ্বজ] অবলোকন করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন এইরূপে কুরুরাজের ধ্বজচ্ছেদন করিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁহার উপর দশবাণ নিক্ষেপ করিলেন।
জয়দ্রথের দুৰ্য্যোধনসাহায্য
“তখন রথিশ্রেষ্ঠ মহাবলপরাক্রান্ত সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ বহুসংখ্যক বীরসমভিব্যাহারে দুৰ্য্যোধনের পার্ষ্ণিগ্রহণে [পার্শ্বরক্ষায়] প্ৰবৃত্ত হইলেন এবং মহাবীর কৃপাচাৰ্য্য অমর্ষপরায়ণ অমিততেজাঃ দুৰ্য্যোধনকে স্বীয় রথে আরোপিত করিলেন। মহারাজ দুৰ্য্যোধন ভীমসেনের ভীষণশরে সাতিশয় বিদ্ধ ও ব্যথিত হইয়া, রথমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর জয়দ্ৰথ ভীমসেনকে নিধন করিবার বাসনায় অনেক সহস্ররথদ্বারা তাঁহার চতুর্দ্দিক অবরোধ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ধৃষ্টকেতু, অভিমন্যু এবং কৈকেয় ও দ্রৌপদীতনয়গণ ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের সহিত সংগ্ৰাম করিতে লাগিলেন। মহাবল অভিমন্যু বজ্রসদৃশ সাক্ষাৎ কালতুল্য সন্নতপর্ব্ব বিচিত্ৰ পাঁচ-পাঁচ বাণে প্রত্যেক ধার্ত্তরাষ্ট্রকে বিদ্ধ করিলেন। তাঁহার অভিমন্যুর শরাঘাতে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া মেঘের মেরুগিরির উপর বারিবর্ষণের ন্যায় তাঁহার উপর বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। রণদুর্ম্মদ, শিক্ষিতাস্ত্ৰ, মহাবীর অর্জ্জুনতনয় ধাৰ্তরাষ্ট্রগণের শরে বিদ্ধ হইয়া, দেবাসুরযুদ্ধে বীজপাণি বাসব যেমন মহাসুরগণকে কম্পিত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ কৌরবসেনাসমুদয়কে বিকম্পিত করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ মহাবীর বিকর্ণের রথ লক্ষ্য করিয়া ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ ভল্ল নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার ধ্বজ, সারথি ও অশ্বসমুদয়কে নিপতিত করিয়া তাঁহার উপর শাণিত অকুন্ঠিতাগ্র [অক্ষুণ্নাগ্ৰ—যাহার অগ্রভাগ ক্ষয় হয় নাই] অজিহ্মগতি শরনিকর নিক্ষেপ করিলেন। সেই কঙ্কপত্ৰযুক্ত সায়কনিচয় নিশ্বসন্ত [গর্জ্জমান—ক্ৰোধে দীর্ঘ দীর্ঘ নিশ্বাসত্যাগ] ভুজঙ্গের ন্যায় বিকর্ণের দেহ ভেদাপূর্ব্বক রুধিরাক্ত হইয়া ভূতলে নিপতিত হওয়াতে বোধ হইতে লাগিল, যেন উহারা রক্তবমন করিতেছে।
বিকর্ণাদির সহিত অভিমন্যুর যুদ্ধ
“তখন বিকর্ণের অন্যান্য সহোদরগণ তাঁহাকে শরনির্ভিন্নগাত্ৰ [বাণাঘাতে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ] দেখিয়া সত্বর অভিমন্যুপ্রভৃতি বীরগণের সম্মুখে সমুপস্থিত হইলে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। উভয়পক্ষীয় বীরগণ পরস্পরের প্রতি শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবীর দুর্ম্মুখ পাঁচবাণে শ্রুতকর্ম্মাকে বিদ্ধ করিয়া একবাণে তাঁহার ধ্বজচ্ছেদন, সাতবাণে সারথিকে নিধন ও ছয়বাণে সুবর্ণজালসমাচ্ছাদিত বায়ুবেগগামী অশ্বগণকে সংহার করিলেন। মহারথ শ্রুতকর্ম্মা সেই হতাশ্বরথে অবস্থান করিয়া ক্রোধভরে দুর্ম্মুখের উপর জ্বলিত মহোল্কার ন্যায় একশক্তি নিক্ষেপ করিলেন, শক্তি যশস্বী দুর্ম্মুখের বর্ম্মভেদ ও গাত্ৰ বিদারণপূর্ব্বক ভূতলে প্রবিষ্ট হইল। তখন মহাবীর সুতসোমও শ্রুতকীর্ত্তিকে বিরথ দেখিয়া সর্ব্বসৈন্যগণসমক্ষে তাঁহাকে স্বরথে আরোপিত করিলেন।
ধৃতরাষ্ট্রতনয়য দুষ্কর্ণের পতন
“মহাবীর শ্রুতকীর্ত্তি যশস্বী জয়ৎসেনকে নিধন করিবার মানসে তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। মহাবীর জয়ৎসেন শ্রুতকীর্ত্তির শরনিক্ষেপসমযে তীক্ষ্নক্ষুরপ্রদ্বারা তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন তেজস্বী শতানীক স্বীয় সোদরকে শরাসনবিহীন দেখিয়া সিংহের ন্যায় গর্জ্জন করিয়া সংগ্রামে সমুপস্থিত হইলেন এবং শরাসন বিস্ফারণপূর্ব্বক দশবাণে জয়ৎসেনকে বিদ্ধ করিয়া মদ্যশ্ৰাবী মাতঙ্গের ন্যায় ধ্বনি করিতে লাগিলেন। ঐ মহাবীর পুনরায় এক সর্ব্ববরণভেদী সায়ক গ্রহণ করিয়া জয়ৎসেনের হৃদয় বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে নকুলতনয় শতানীক জয়ৎসেনকে দৃঢ় প্রহার করিলে দুষ্কৰ্ণ ক্রোধাভরে জয়ৎসেনের সমক্ষে নকুলনন্দনের সশর শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর শতানীক অন্য দৃঢ়শরাসন ও শরনিকর গ্রহণপূর্ব্বক ‘থাক থাক’ বলিয়া দুষ্কর্ণকে তাঁহার ভ্রাতার সমক্ষে তর্জ্জন করিয়া প্রজ্বলিত পন্নগসদৃশ নিশিতসায়কসমুদয় নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। ঐ মহাবীর একবাণে জয়ৎসেনের ধনু ও দুইবাণে তাঁহার সারথিকে ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে নিশিতশরনিকরে বিদ্ধ ও তীক্ষ্ন দ্বাদশশরে তাঁহার সমুদয় অশ্ব নিহত করিয়া ক্রোধভরে শাণিতভল্লদ্বারা তাঁহার হৃদয় বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দুষ্কৰ্ণ শতানীকের ভল্লে দৃঢ়তর সমাহত হইয়া প্ৰাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক বজ্রাহত পাদপের ন্যায় ধরাতালে নিপতিত হইলেন।
শতানীকের সহিত দুর্ম্মুখাদির দারুণ যুদ্ধ
“হে মহারাজ! দুমুখ, দুৰ্জয়, দুর্ম্মর্ষণ, শত্রুঞ্জয় ও শক্রসহ, আপনার এই মহারথ পাঁচপুত্ৰ দুষ্কর্ণকে নিহত দেখিয়া শতানীককে সংহার করিবার বাসনায় শরনিকর নিক্ষেপ কবিয়া তাঁহার সমীপে আগমন করিতে লাগিলেন। তখন কেকয়দেশীয় পঞ্চভ্রাতা সেই পঞ্চমহারথের প্রতি ধাবমান হইলেন; তদ্দর্শনে তাঁহারা ক্রুদ্ধ হইয়া বিচিত্র কবচ ও শরাসন ধারণ এবং বিচিত্ৰ ভূষণে ভূষিত হয়সমুদয়যোজিত, নানাবর্ণ ধ্বজপতাকায় শোভিত রথে আরোহণপূর্ব্বক মহাগজসমূদয়ের মহাগজ আক্রমণের ন্যায় কেকয়দেশীয় পঞ্চভ্রাতাকে আক্রমণ করিয়া সিংহের বনপ্রবেশের ন্যায় শত্রুসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। এইরূপে উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণের ঘোরতর যমরাষ্ট্রবিবৰ্দ্ধন [অধিক মৃত্যুসমন্বিত—অনেক লোক মরিলে যমরাজের প্রজাবৃদ্ধি হওয়ায় যমপুরী ভরিয়া যায়] সংগ্রাম সমুপস্থিত হইলে বীরগণ পরস্পর প্রহার করিতে লাগিলেন এবং রথে রথে ও গজে গজে দারুণ সংঘর্ষ হইয়া উঠিল। এমন সময় ভগবান ভাস্কর অস্তাচলচুড়াবলম্বী হইলেন। রথী ও অশ্বারোহীগণ ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল। তখন মহাবীর শান্তনুতনয় ভীষ্ম ক্রোধান্বিত হইয়া সণ্নতপর্ব্ব শরনিকরে কেকয় ও পাঞ্চালসৈন্যগণকে সংহারপূর্ব্বক স্বীয় সেনাগণের অবহার করিয়া শিবিরে গমন করিলেন। এদিকে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরও ধৃষ্টম্যুম্ন ও বৃকোদরকে দেখিয়া তাঁহাাদের মস্তকাঘ্রাণপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে শিবিরে গমন করিলেন।”