লন্ডন থেকে আবার প্যারিসে ফিরে আসাই ঠিক করলুম।
প্যারিসের একটা মস্ত গুণ কী, কোনও কিছু না করলেও, কোনও দ্রষ্টব্য স্থানে না গেলেও এমনি-এমনিই ভালো লাগে। দ্রষ্টব্য জায়গাগুলিতে বড্ড ভিড়।
শরৎকালটাতে যেন সারা পৃথিবীর ভ্রমণকারীরা ধেয়ে আসে ফ্রান্সে। এই সময় ঝকঝকে রোদ ওঠে, নীল আকাশ দেখা যায়, দিনের বেলায় বাতাসে একটুও শীতের ধার থাকে না, আমেরিকান ছেলেমেয়েরা তো শুধু একটা গেঞ্জি গায়ে ঘুরে বেড়ায়। প্যারিসে পার্কের অন্ত নেই, সবক’টি পার্কে এই সব ভিনদেশি ছেলেমেয়েরা ঘাসের ওপর গড়াগড়ি দেয় আর সারাদিন ধরে রোদ শুষে নেয় গায়ে। রিভিয়েরা কিংবা ওই ধরনের বিখ্যাত সমুদ্রতটে নিশ্চয়ই রোদ শোষকদের ভিড় আরও অনেক বেশি, কিন্তু সেসব জায়গায় যাওয়া আমার পকেটের সাধ্যে কুলোবে না।
ইংল্যান্ডে আমার বন্ধু ভাস্কর ওই রকম একটা ছোটখাটো সমুদ্রতীরে নিয়ে গিয়েছিল। জায়গাটার নাম শুবেরিনেস, লন্ডন থেকে গাড়ি-দূরত্ব ঘন্টাদুই-আড়াই। রোদ্দুর বড় ভালোবাসে ইংরেজরা, রোদ ওদেশে দুর্লভ। লন্ডনের থেকে প্যারিসে রোদ বেশি। রোদ কম পায় বলে ইংরেজ মেয়েরা ফরাসিনীদের চেয়ে বেশি ফরসা। আমাদের চোখে অবশ্য এটা ধরা পড়ার কথা নয়, কিন্তু শুনেছি প্যারিসের ফলি বার্জার কিংবা বিখ্যাত নৈশ ক্লাবগুলিতে যেসব স্বল্পবাসা সুন্দরীদের নাচ দেখানো হয়, সেই সব মেয়েদের বেশিরভাগই আনা হয় ইংল্যান্ড থেকে। কারণ, মঞ্চের আলোয় তাদের উরু বেশি ফরসা দেখায়। ব্রিটিশ দ্বীপুঞ্জের চতুর্দিকেই সমুদ্রতীর, কিন্তু ওদের তেমন বিখ্যাত কোনও বিচ নেই। শুবেরিনেসকে তো বিচ না বলে তার অ্যাপোলজি বলা উচিত। আমাদের দীঘার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থা, সমুদ্রকে মনে হয় এঁদো ডোবা, ঢেউ টেউ কিছু দেখা যায় না, সমুদ্র একটা আছে এই পর্যন্ত। সেখানেই বেলাভূমিতে পা ফেলার জায়গা নেই, বালির ওপর নিঃসাড়ভাবে শুয়ে আছে হাজারখানেক নারীপুরুষ, ঠিক যেমন সিনেমায় দেখা যায়। সেখানকার মেয়েদের পোশাক, সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায়, ‘আমার টাই দিয়ে তিনটে মেয়ের জাঙিয়া হয়ে যায়!’
আমাদের তো অত রোদ-প্রীতি নেই আর অত সাহেব-মেমদের সামনে আমরা খালি গাও হতে পারি না, সুতরাং আমি রীতিমতো দরদর করে ঘেমেছিলুম। ওই ঘামেই আবার সাহেবদের আনন্দ। একটা নাকি পারফিউম বেরিয়েছে, যা মাখলে ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। যাই হোক, শুবেরিনেস-এর নমুনা দেখেই বুঝেছিলুম এই রকম সময় বিখ্যাত সমুদ্রতীরগুলিতে কত ভিড়।
শুধু পার্কে নয়, শরৎকালীন প্যারিসের অনেক রাস্তাও এমন ভিড়ে গিসগিস করে যে হাঁটতে গেলে মানুষের গায়ে ধাক্কা লাগে। এমন ভিড় আমার পছন্দ নয়। তার চেয়ে একটু জনবিরল কোনও পথে চুপ করে বসে থাকা অনেক ভালো। রাস্তার ওপরেই অনেক রেস্তোরাঁর চেয়ার টেবিল, সেখানে এক কাপ কফি নিয়ে বসে থাকা যায়, অনেকক্ষণ পার হয়ে গেলে পরিচারকটি যদি কাছে এসে ঘোরাঘুরি করে তখন আর এক কাপ কফির অর্ডার দিলেই হল, কিংবা এক বোতল সাদা ওয়াইনের অর্ডার দিতে পারলে তো আর কোনও কথাই নেই।
বসে-বসে শুধু পথের মানুষ দেখা।
অনেক বেশি সংখ্যায় টুরিস্টদের শুভাগমনে সরকার খুশি হয়, ব্যাবসা-বাণিজ্যের সুবিধা হয় বটে কিন্তু অভিজাত ফরাসি নাগরিকরা নাক সিঁটকোয়। টুরিস্টদের অত্যাচার এড়াবার জন্য তারা এই সময় প্যারিস ছেড়ে চলে যায়। অনেকে বলে, শরৎকালে প্যারিসের রাস্তায় ফরাসিদের দেখতেই পাওয়া যায় না, সবাই বিদেশি। কথাটা অতিরঞ্জিত নিশ্চয়ই, শহরসুদ্ধ সব লোক চলে গেলে অফিস-দোকানপাট চলছে কী করে, তা ছাড়া সবাই বেড়াতে যাবে, এত পয়সা ফরাসিদের নেই।
টুরিস্টদের দেখলেই চেনা যায়। আমি প্রথমে রাস্তার চলন্ত মানুষদের পায়ের বিভিন্ন রকম জুতো দেখি, তারপর পোশাক, তারপর মুখ। বিশেষ-বিশেষ মেয়েকে দেখে একাধিকবার তাদের সর্বাঙ্গে তাকাতেই হয় অবশ্য।
আমাদের ধারণা, টুরিস্ট বুঝি বেশিরভাগই আমেরিকান। তা ঠিক নয়। প্যারিসে সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আসে, এখন টুরিস্টদের মধ্যে জাপানিদের মুখ বেশ চোখে পড়ে। এখন তো জাপানিরাই বড়লোক। তা ছাড়া টুকরো টাকরা কথাবার্তা শুনে চিনতে পারা যায় জার্মান এবং রাশিয়ানদের। এ ছাড়াও অনেককে দেখে বোঝা যায়। তারা আর যে জাতই হোক, আমেরিকান নয়। ভারতীয়ও কিছু আছে, হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে কোনও রঙিন শাড়ির উড়ন্ত আঁচল, প্যারিসের রাস্তায় বাংলা কথা শোনাও আশ্চর্য কিছু নয়। একটি যুগল আমার পাশ দিয়ে বাংলা বলতে বলতে চলে গেল। স্পষ্ট বুঝতে পারলুম তারা চাপা গলায় ঝগড়া করছে। ওরা স্বামী-স্ত্রী নিঃসন্দেহে এবং স্বামীটির জন্য মায়া হল আমার। নিউ ক্যাসেলে কয়লা কিংবা বেরিলিতে বাঁশ নিয়ে যাওয়ার মতন লোকটি প্যারিসে এসেছে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে, এখন তার ঠ্যালা তো সামলাতে হবে।
অল্পবয়েসি টুরিস্টদের মধ্যে অবশ্য অ্যামেরিকানই বেশি। আমেরিকান ছেলেমেয়েরা ছাত্র অবস্থাতেই যত পয়সা রোজগার করতে পারে, সেরকম পয়সা রোজগারের সুযোগ বোধহয় পৃথিবীর আর কোনও দেশের ছাত্রছাত্রীদের নেই। তা ছাড়া দুনিয়া চষে বেড়াবার ঝোঁকও ওদের আছে। সতেরো-আঠেরো বছরের ছেলেমেয়ে যখনতখন দেশ ছেড়ে বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে চলে যায়, এটা আমাদের দেশে বসে কল্পনা করাও শক্ত।
ছেলেবেলায় আমাদের কাছে সাহেবদের যে ইমেজ ছিল, তা একেবারে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। হ্যাট-কোট-টাই পরলে তবেই না সাহেব! এখন হাজারজনের মধ্যে পাঁচ জন টুপি পরে কিনা সন্দেহ, অফিস-চাকুরে ছাড়া অন্যরা একশো জনের মধ্যে দশ জনও বোধহয় টাই পরে না। আমেরিকান ছেলেরা তো তোয়াক্কাই করে না এসব কিছুর, একটা ব্লু জিন আর যে-কোনও ধরনের একটা গেঞ্জিই তাদের পক্ষে যথেষ্ট। মেয়েরাও ব্লু জিন পরে কিন্তু তাদের ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাকের কোনও ফ্যাশান নেই। আমি অন্তত একশোটি আমেরিকান মেয়ে দেখলুম, তাদের মধ্যে কোনও দুজন এক রকম জামা পরেনি। রূপের জন্য অবশ্য আমেরিকান মেয়েদের তেমন খ্যাতি নেই, সে দেখতে হয় সাধারণ ফরাসি মেয়েদের। অফিস ভাঙার সময় টুরিস্টদের ছাপিয়ে যায় সাধারণ ফরাসিদের ভিড়। তাদের আলাদা করে চেনা যায়, কারণ তাদের চলার গতি দ্রুত, যেন বাড়ি ফেরার খুব তাড়া। ফরাসি মেয়েরা উগ্র সাজপোশাক করে না। নিশ্চয়ই তারা সযত্ন প্রসাধন করে বাড়িতে, কিন্তু সে প্রসাধনকে তারা চাপা দিতেও জানে, তাদের মুখ চোখ দেখে কক্ষনো তা বোঝা যায় না। এ ছাড়াও তাদের মধ্যে কী যেন একটা আলগা লাবণ্য আছে, চোখ টেনে রাখে। রূপ নিয়ে সবাই জন্মায় না, অথচ ফরাসিদের মধ্যে কুরূপা মেয়ে প্রায় চোখেই পড়ে না। তার মানে ওরা অন্য একটা কিছু জানে।
মেয়েদের প্রসঙ্গে অন্য একটা কথা বলতে ইচ্ছে হল।
প্যারিসে মমার্ত আর প্লাস পিগাল-এর মাঝখানে একটা এলাকায় নারী মাংসের বাজার আছে। নারী মাংস যে কতরকমভাবে রান্না করে পরিবেশনের ব্যবস্থা আছে, তার আর ইয়ত্তা নেই। পিপ শো, লাইভ শো, সেক্স শপ, সেক্সসাইটমেন্ট, এরোটিকা হ্যানো আর ত্যানো। এরকম এলাকা লন্ডনে আছে, হামবুর্গে আছে, আরও কোন-কোন দেশে আছে কে জানে। আমস্টারডামে ওই পাড়াটি তো জগৎ সুখ্যাত বা কুখ্যাত। ওরকম একটা শো-ও দেখার ইচ্ছে আমার হয়নি। তা বলে আমি নীতিবাগীশ তো নই, বরং মেয়েদের প্রতি আমার বেশি আসক্তির দুর্নাম আছে। বেশি আসক্তি আছে বলেই মেয়েদের নিয়ে এরকম ঢালাও ব্যাবসার ব্যাপারটায় আমার গা ঘিনঘিন করে। এই ব্যাবসা চালায় পুরুষেরা, পুরুষশাসিত সমাজ এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছে।
মমার্ত থেকে প্লাস পিগাল-এর দিকে রাত্তিরবেলা হেঁটে আসতে-আসতে চোখে পড়ে রাস্তার ধারে-ধারে গালে রং মেখে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে আধো অন্ধকারে। তাদের চোখের ভাষা বুঝতে ভুল হয় না, তারা তাদের শরীর কিছুক্ষণের জন্য বিক্রি করতে চায়। কাছাকাছি পিপ শো বা লাইভ শো-গুলোর কুৎসিত বিজ্ঞাপনের তুলনায় এইসব মেয়েদের দাঁড়িয়ে থাকা আমার একটুও খারাপ মনে হয় না। পেটের দায়ে মানুষ কত কী করে, রিকশা টানে, ধনীদের ঘাড়ে চাপিয়ে পাহাড়ের ওপর তীর্থস্থানে নিয়ে যায়, খনির মধ্যে বিষাক্ত গ্যাসের ভেতরে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেয়, সেই রকম মেয়েরাও শরীর খাঁটিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন জোগাড় করতে পারে। কোন মেয়ে কার সঙ্গে শোবে এবং তার বিনিময়ে সে টাকা নেবে কিংবা গয়না উপহার নেবে কিংবা শুধুই ভালোবাসা চাইবে, সেটা মেয়েরাই ঠিক করবে। কিন্তু মেয়েদের শরীরটা নিয়ে পুরুষেরা রোজগার করবে, এই ব্যাপারটাই আমার সহ্য হয় না।
মমার্ত প্লাস পিগাল-এর ওই রাস্তায় হেঁটে আমার একটা নতুন শিক্ষাও হল। ওই সব লাইভ শো, পিপ শোতে কিন্তু দলে দলে লোভী লোকরা ছুটে যায় না। ক্রমশই ওই সব ব্যবসায়ীরা রেট কমাতে বাধ্য হচ্ছে। এককাপ কফির চেয়ে একবারের রমণ দৃশ্য দেখতে খরচ কম হয়। চার আনা আট আনাতেও পিপ শো দেখা যায়। দালাল আর ফড়েরা বাইরে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকি করে, পারলে রাস্তা থেকে লোক ধরে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ভেতরে অনেক জায়গা তখনও খালি আছে। অথচ, প্যারিসের যেকোনও আর্ট গ্যালারির সামনে প্রতিদিনই লম্বা লাইন।
প্যারিসে এখন ‘লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক’ নামে নতুন ছবিটি দেখানো হচ্ছে, সিনেমা হলের সামনে তার বিশাল হোর্ডিং। সেই হোর্ডিং-এর পুরো বর্ণনা না লেখাই ভালো। কিন্তু সে সিনেমা হলের সামনে একটুও ভিড় নেই, হাউস ফুল হওয়া তো দূরের কথা। কিছু কিছু সিনেমা হলে হার্ড–কোর পর্নোগ্রাফি এখন দেখানো হয় অবাধে। সেখানেও বেশি ভিড় হয় না। লোকে ছুটে যায় না। অথচ, এসব দেশে সত্যিকারের কোনো ভালো থিয়েটার দেখতে গেলে টিকিট কাটতে হয় অন্তত একমাস আগে, তাও সহজে পাওয়া যায় না। কুরুচি জেতে না। শেষ পর্যন্ত শিল্পই জেতে।
প্যারিসের দুটি দোকানে আমার দু-রকম অভিজ্ঞতা হল।
পঁতনফ অঞ্চলে একদিন একটা ঠিকানা খুঁজে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেললুম। তারপর এ-রাস্তা সে-রাস্তার গোলোকধাঁধা। বাড়ি ফেরার কোনও অসুবিধে নেই, মাটির নীচে নেমে গিয়ে যেকোনও মেত্রো ধরলেই হল। কিন্তু সেই ঠিকানায় একবার যেতে হবে, শহরের ম্যাপটাও সঙ্গে আনিনি। পথের লোককে জিগ্যেস করি, কিন্তু ভাষার মস্ত বাধা।
আমি ইংরিজিও জানি না, ফরাসিও জানি না। তবু ব্যাকরণ-ভুলো ইংরিজিতে কোনও রকমে কাজ চালাতে পারি, আর ফরাসিজ্ঞান বলতে কয়েকটি মাত্র শৌখিন বাক্য আর কবিতার লাইন, রাস্তার ঠিকানা প্রসঙ্গে তা বলতে যাওয়াও বিপদ। অনেক চেষ্টা করেও কারুর কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া গেল না। একটা বিস্রোতে ঢুকে সেখানকার পরিচালকটিকে বোঝাবার জন্য ইংরেজি-ফরাসি নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছি, লোকটি কিছুই বুঝছে না, এক সময় সে দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তার উলটোদিকে কিছু দূরের আর একটা দোকান দেখিয়ে দিল। সে দোকানের নাম লেখা ইংরিজিতে, হ্যামবার্গার কর্নার। তা হলে নিশ্চয়ই ওই দোকানে কেউ ইংরিজি জানে।
সে-দোকানে ঢুকতেই একটি তরুণী মেয়ে বলল, ইয়েস, মে আই হেলপ ইউ?
কানে যেন সুধাবর্ষণ হল। ইংরেজি ভাষাকে আগে কোনও দিন এত ভালো লাগেনি।
খাবারের দোকানে ঢুকে কিছু না কিনে প্রথমেই ঠিকানা জিগ্যেস করা কি উচিত? একটু একটু খিদেও পেয়েছে, আমি তাই প্রথমেই সস্তা দেখে একটা হট ডগের অর্ডার দিলুম। সেটি পাওয়ার পর বললুম, চিলি সস নেই?
মেয়েটি বলল, না, তা তো নেই, তবে তুমি কেচ আপ নেবে, মাস্টার্ড নেবে?
দোকানে আর একটি মাত্র খরিদ্দার এক কোণে বসে আছে, আমি বসলুম কাউন্টারে। তারপর বললুম, আমি একটা ঠিকানা খুঁজছি, তুমি এই রাস্তাটা কোথায় বলতে পারো!
মেয়েটি হেসে ফেলে বলল, আমিও তো প্যারিসে নতুন এসেছি। এদিককার রাস্তা চিনি না। তুমি কি ভারতীয়?
–হ্যাঁ। আর তুমি?
–আমি ব্রিটিশ। তিন মাসের জন্য চাকরি নিয়ে এসেছি, আবার লন্ডনে ফিরে গিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। তুমি ভারতবর্ষের কোন জায়গা থেকে এসেছ?
–কলকাতা। তুমি নাম শুনেছ?
–হ্যাঁ। কেন শুনব না। তার মানে তুমি বেঙ্গলি? আমি আগে লন্ডনে দু-একজন বেঙ্গলি মিট করেছি।
দোকানের মেয়ে সাধারণত কোনও খরিদ্দারের সঙ্গে এত কথা বলে না। কিন্তু মেয়েটি বেশ আলাপি ধরনের। অনেক কথা বলতে চায়। সে কি শুধু ইংরেজিতে কথা বলবার জন্য? ভুলভাল হলেও আমাদের ইংরিজি তো আমেরিকানদের মতন নয়, পুরোনো দাসত্বের সূত্রে তাতে এখনও কিছু ব্রিটিশ ঝোঁক আছে।
কথা বলতে-বলতে হটডগ শেষ করার পর আমি বললুম, কফি?
মেয়েটি আঙুল দিয়ে পাশে দেখিয়ে দিল। অর্থাৎ এখানে কফি বানিয়ে পরিবেশন করা হয় না, পাশে মেশিন আছে সেখান থেকে নিজেকে নিয়ে আসতে হয়। আমি উঠতে যাচ্ছি, মেয়েটি বলল, আচ্ছা, বসো, বসো, আমি এনে দিচ্ছি।
মেশিন থেকে কাপে কফি ঢেলে মেয়েটি আবার আমাকে মিষ্টি হেসে জিগ্যেস করল, তুমি দুধ চিনি খাও তো?
আমি আগেই লিখেছি যে লন্ডনে চেনাশুনো ইংরেজরা ছাড়া অন্য অচেনা ইংরেজরা কেমন যেন আলগা আলগা ব্যবহার করে। পাশে দাঁড়ালে সরে যায়। কথা বললে উত্তর দিতে চায় না। কিন্তু দেশের বাইরে এসেছে বলেই কি এই মেয়েটি আমার সঙ্গে এমন ভালো ব্যবহার করছে? যেন ইংরেজি ভাষার সূত্রে আমার সঙ্গে ওর দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তা আছে। আমি ভারতীয় জেনেও আমাকে কফি বানিয়ে দিল!
ঠিকানা জানা হল না বটে কিন্তু একটি অপরিচিতা ইংরেজ মেয়ের হাসি তো উপহার পাওয়া গেল।
দ্বিতীয় দোকানটি মমার্তে। বিদ্যুৎ-গাড়িতে চেপে উঠে এসেছি টিলার ওপরে। ধপধপে সাদা গির্জাটির পেছনেই জ্বলজ্বল করছে পূর্ণিমার চাঁদ। ঠিক যেন আকাশে আঁকা। কিন্তু সে সৌন্দর্য রসিয়ে উপভোগ করার উপায় নেই, এত ভিড় চারদিকে। এক সময়ে এখানে বড়-বড় শিল্পীরা আসতেন, এখন নকল শিল্পীতে ভরে গেছে জায়গাটা। একটুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে মনে হল, এবার ফিরে যাওয়াই ভালো।
কাল সকালে প্যারিস ছেড়ে চলে যাব, কিন্তু এখান থেকে কোনও জিনিস তো কেনা হল না। একটা ছোটখাটো কিছু স্মৃতিচিহ্ন। ঢুকে পড়লুম একটা সুভেনিরের দোকানে। সব জিনিসের আগুন দাম, টুরিস্টদের গলা কাটবার জন্যই এগুলো তৈরি। এ তো আমার পোষাবে না। দোকানে ঢুকে কিছু না কিনলে খারাপ দেখায়, তাই একটা ডটপেন পছন্দ করলুম।
কাউন্টারে দাম দিতে গেছি, মেয়েটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ফরাসিতে অনেক কিছু বলে গেল। তার মধ্যে শুধু হিন্দুশব্দটি বুঝতে পারলুম। মাথা নেড়ে বললুম, হ্যাঁ।
মেয়েটি তার ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা হার বার করে দেখাল আমাকে। সেটা একটা ছোট ছোট রুদ্রাক্ষের মালা।
তারপর সে খুবই ভাঙা ইংরিজিতে, ফরাসি উচ্চারণে বলল, আমি তোমার দেশে যাচ্ছি।
আমি জিগ্যেস করলুম, কোথায়?
সে আবার বলল, তোমাদের দেশে।
আমি বললুম, তা তো বুঝলুম, কিন্তু আমাদের দেশ তো অনেক বড়, তুমি ঠিক কোন জায়গাটায় যাচ্ছ?
সে আমারই ডটপেনটা নিয়ে একটা কাগজে বানান করে লিখল। ভুল বানান সত্বেও বোঝা গেল সেটা হরিদ্বার। তারপর আবার সে কী একটা নাম বলতে গিয়ে উচ্চারণ করতে না পেরে কাগজে লিখল। এবার লিখেছে মুক্তানন্দস্বামী। তার গুরু।
মেয়েদের বয়েস আন্দাজ করার মতন শক্তি আমার নেই। তবু মনে হয়, পঁচিশ থেকে বত্রিশের মধ্যে ফেলা যায় তাকে। ওই বয়েসের একটা ফরাসি মেয়ে এমন চালু দোকানের মায়া ছেড়ে কেন কোনও এক মুক্তানন্দস্বামীর শিষ্যত্ব নেবে, আর কেনই বা হরিদ্বারের মতন মাছ মাংস বিহীন জায়গায় গিয়ে থাকবে? কিন্তু মেয়েটিকে এই প্রশ্ন করেও কোনও লাভ নেই, তার ইংরেজি জ্ঞান এতই কম। দুটো একটা ইংরেজি শব্দের সঙ্গে বাকিটা সব ফরাসি মিলিয়ে সে আমাকে অনেক কিছু জিগ্যেস করছে, মনে হয় ওই মুক্তানন্দস্বামী বিষয়ে সে আমার কাছ থেকে শুনতে চায়। কিন্তু আমি তো ওই স্বামীজির নাম আগে শুনিনি, হরিদ্বার বিষয়েও আমার বিশেষ আগ্রহ নেই।
মেয়েটি আমার কাছে যা জানতে চায়, সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। মেয়েটির কাছ থেকে আমি যা জানতে চাই, তা-ও ও আমায় বোঝাতে পারবে না। সুতরাং আমি হাসি-হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলুম ওর মুখের দিকে।