কমনওয়েলথ রিলেশানস অফিসের তত্ববধানে ব্রিটিশ সরকারের অতিথি হয়ে ছিলাম লন্ডনে। একজন অমায়িক প্রদর্শক এবং সরকারি মোটরগাড়ি করে খুব ঘোরাঘুরি করছি। ব্রিটিশের অধীনে কলকাতা শহরে যখন ছিলাম, তখন কম ভাড়ার জন্য ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চড়েছি, কখনও পুরো ভাড়া বাঁচাবার জন্য হাওড়ার বাসে উঠে গেঁয়ো সেজে জিগ্যেস করেছি, এ বাস কি কালীঘাট যাবে? আর এখানে, ভূতপূর্ব রাজার গাড়িতে চেপে চলেছি তাঁরই দেশের ওপর দিয়ে। কিন্তু অভিভূত হয়ে যাইনি, গাড়ি আসতে পাঁচ মিনিট দেরি হলে ভুরু কুঁচকেছি, হোটেলের খাবার যথেষ্ট ভালো না হলে খুঁতখুঁত করেছি। কিন্তু আমার প্রদর্শক-সঙ্গী যখন খুশি মুখে বললেন, কাল আমরা ফেবার কোম্পানিতে যাব–তোমার সঙ্গে টি. এস. এলিয়টের দেখা হবে–তখন আমি আঁতকে উঠেছি! ত্রাস মিশ্রিত গলায় বলেছি, সে কী?
সঙ্গী বললেন, হ্যাঁ সত্যি, কাল এলিয়টের কাছে যাওয়া হবে!
-কেন?
–বাঃ, আমাদের প্রোগ্রাম সেইভাবে ঠিক করা। অতিথিদের যাঁর যেদিকে ঝোঁক, তাঁর সঙ্গে সেই ধরনের বিখ্যাত লোকদের দেখা করিয়া দেওয়া হয়। তুমি এলিয়ট, স্পেনডার, টি এল, এস এর সম্পাদক আরথার কুক–এদের সঙ্গে দেখা করবে!
–এ তো মহা মুশকিল দেখছি!
সঙ্গী এবার বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন, এলিয়টের সঙ্গে দেখা করতে তোমার ইচ্ছে হয় না? এ এক কত বড় সুযোগ! তুমি নিশ্চয়ই এলিয়টের
–হ্যাঁ পড়েছি। তুমি যদি চাও, আমি গড়গড় করে পাতার পর পাতা আবৃত্তি করে যেতে পারি। কিন্তু, তার সঙ্গে দেখা করার কী সম্পর্ক? আমি কি ওঁর সামনে গিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকব, না বলব, আপনি সত্যিই খুব ভালো লেখেন! ওঁর সামনে আমি সামান্য মানুষ–শুধু শুধু সময় নষ্ট করব কেন?
আমার সঙ্গী পিঠ চাপড়াবার ভঙ্গিতে বললেন, নিজেকে অত ছোট ভাবতে নেই। যতবড় প্রতিভাবানই হোন, উনিও একজন মানুষ। মানুষের সঙ্গে মানুষ দেখা করতে যাবে–এ তো স্বাভাবিক। খুব বেশি বিনয় আবার হীনতাবোধ এনে দেয়।
আমি এবার একটু দুষ্টুমির হাসি ছাড়লুম। তারপর বললুম, শুধু তোমাকেই গোপনে বলছি, বিনয় মানুষকে অহংকারীও করে! আমি যে যেতে চাইছি না–সেটা আমার অহংকার থেকেই। আমি বীরপূজক নই। আমি ওঁর কাছে যেতে চাই না–কারণ, আমি ওঁর জীবনী, লেখা, আদর্শ সম্বন্ধে অনেক কিছু জানি। কিন্তু উনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এরকম একতরফা কথাবার্তা আমার ক্লান্তিকর লাগে যাঁর সম্পর্কে আমি পরম শ্রদ্ধাশীল, তাঁর সঙ্গও একটু বাদে আমার বিরক্তিকর লাগে।
সেটা ১৯৬৪-র আগস্ট মাস। ঈষদুষ্ণ সকাল দশটায় ফেবার অ্যান্ড ফেবার কোম্পানির সামনে নামলুম। আমার অনিচ্ছুক মুখে ভদ্রতার হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করছি। দোতলায় নিরিবিলি অফিস, পুরোনো ধরনের বাড়ি–মনটিথ নামে একজন দীর্ঘদেহী প্রৌঢ়, যিনি ওই কোম্পানির অপর অংশীদার, আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, প্রথমেই একটা দুঃখের কথা বলি, মিঃ এলিয়ট আজ আসতে পারবেন না বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ওঁর শরীরটা একটু খারাপ!
ওরা কেউ লক্ষ করল না–আমার বুক থেকে একটা বিরাট স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল। যাক, বাঁচা গেল।
কিছুক্ষণ মামুলি ধরাবাঁধা কথা হল। ইংলন্ডের তরুণ কবিদের কবিতা কী-রকম বিক্রি হয়। ফেবার অ্যান্ড ফেবার থেকে কয়েকজন তরুণের বই লেখা প্রকাশ করা হয়েছে তাদের জনপ্রিয়তা–বাংলাদেশের কবিরা প্রকাশ পায় কি না–ইত্যাদি। কথায়-কথায় তিনি জিগ্যেস করলেন, বাংলাদেশে এলিয়টের লেখা কেউ পড়ে কি না।
আমি বললুম, বিক্রি দেখে বুঝতে পারেন না? কলকাতায় কত বই বিক্রি হয়, নিশ্চয়ই জানেন।
–হ্যাঁ। কিন্তু আমার ধারণা, কলকাতায় কিছু ইংরেজি-ভাষী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান আছে, তারাই…
–হা ভগবান! যাক, এ বিষয়ে আর কিছু না বলাই ভালো। তবে একবার সিনেমা হলে আমি একটি সুবেশ, ইংরেজি-ভাষী অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতি দেখেছিলাম, যাঁরা হ্যামলেটের গল্পও জানেন না!
মিঃ মনটিথ এবার বললেন, চলুন, এলিয়ট যে-ঘরে বসে কাজ করেন, সেই ঘরটা আপনাকে দেখিয়ে আনি।
আমি আমতা-আমতা করে বললুম, না দেখলেও চলে অবশ্য!
–না, না কোনও অসুবিধে নেই।
একজন বিখ্যাত পুরুষ কোন চেয়ারে বসেন, কোন কলমে লেখেন, কোথায় থুতু ফেলেন, এসব দেখায় আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ হয় না কখনও। কিন্তু ওঁরা ভাবছেন, আমি বুঝি দেখলে ধন্য হয়ে যাব।
–ঘরের এই যে দরজাটা দেখছেন, এটা ওঁর ঠাকুরদার বাড়ি থেকে এনে বসিয়েছেন। উনি একটু ঝুঁকে বসে কাজ করতে ভালোবাসেন, তাই দিনের বেলাতেও আলো। ওই আরাম কেদারায় মাঝেমাঝে বসে বিশ্রাম করেন। ওঁর আজকের ডাকের চিঠিপত্র–উনি নিজের হাতে খাম খুলতে ভালোবাসেন।
এখানে আমি একটা মজার জিনিস দেখতে পেলাম। সেদিনের ডাকের ওপরেই একটা বাংলা বই। একটি চটি কবিতার বই। আমি সেটা খুলে নিয়ে উলটে দেখলাম! উদাসী বাঁশি–প্রাণকৃষ্ণ সাঁতরা। এই ধরনেরই লেখকের নাম ও বইয়ের নাম। আমি আগে কখনও শুনিনি সেই নাম। বাঁকুড়ার এক গ্রাম থেকে একজন শিক্ষক কিছু সরল পদ্য লিখে ছাপিয়েছেন–প্রথম পাতায় ভিক্টোরিয়ান ইংরেজিতে আধপাতা হাতে লেখা এলিয়টের প্রতি উৎসর্গ। সেই উৎসর্গবাণীর মর্মার্থ, আপনি এলিয়ট, আমার গুরু। আমি দূর থেকে একলব্যের মতো আপনার শিষ্য। আমি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় লিখি, আপনার কাজ থেকে ভাবের উৎস পাই। ইত্যাদি।
আমি মিঃ মনটিথকে বইটার ব্যাপারে বুঝিয়ে দিয়ে বললুম, আপনি বলেছিলেন বাংলাদেশে এলিয়ট পড়ে কি না? এই দেখুনি, এক গণ্ডগ্রাম থেকে এসেছে। তারপরই আবার যোগ করলুম, আচ্ছা, এলিয়ট এ বইটা নিয়ে কী করবেন? নিরুপায় হয়ে বাজে কাগজের ঝুড়িতেই ফেলবেন আশা করি।
পরদিন হোটেলে সকালবেলা টেলিফোন। উৎফুল্ল গলায় মিঃ মনটিথ বলছেন, আপনার জন্য সুখবর আছে। এলিয়ট আজ অফিসে এসেছেন। আপনার কথা বলে আমি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রেখেছি। আজ তিনটের সময় আসুন!
টেলিফোনের এপাশে আমার মুখ বিকৃত হয়ে গেল! এ আবার কী নতুন ঝঞ্ঝাট। কাল ভেবেছিলুম, খুব বেঁচে গেছি। আজ আবার–।
কিন্তু প্রত্যাখ্যান করা হবে চরম রূঢ়তা। ঢোক গিলে রাজি হতেই হল।
আমি ওঁর হাত ছুঁয়ে টেবিলের এপাশে বসেছি। ভিতরে ভিতরে দুর্বল লাগছে। সাধারণ চেহারার শান্ত মানুষটি, কিন্তু ওঁর পিছনের যে বিশাল জ্যোতির কথা আমি জানি–সেজন্যই দুর্বল হয়ে পড়েছি। ঠান্ডা লেগেছে বলে একটু শুকনো মুখ ও ধরা গলা। গম্ভীর মুখ নয়, কথা বলার সময় ঈষৎ হাসি-মাখা থাকে, নম্র কণ্ঠস্বর। এক সময় ব্যাংকের কেরানি ছিলেন, বন্ধুবান্ধবরা ওঁর কবিতার বই ছাপাবার জন্য চাঁদা তুলেছিল–এই সব মনে করে ওঁকে আমারই ম তো সাধারণ মানুষ ভাবার চেষ্টা করে নিজের দুর্বলতা কাটাবার চেষ্টা করছিলাম। ওঁকে আমার একটি মাত্র প্রশ্নই করার ছিল, ওঁর নতুনতম কাব্য সংগ্রহে কিছু ফরাসি কবিতা ঢুকিয়েছেন কেন? ফরাসিদের মুখে শুনেছি, ওগুলো তেমন ভালো হয়নি। কিন্তু জিগ্যেস করতে পারিনি (ভয়েই হয়তো)। উনিই যা-কিছু প্রশ্ন করলেন। প্রথমটায় আমি কবে এসেছি, কবে যাব ইত্যাদি। তারপর মৃদু হেসে, কলকাতার তরুণরা এখনও আমার লেখা পড়ে, না আমি পুরোনো হয়ে গেছি?
এ প্রশ্নের ঠিক প্রত্যক্ষ উত্তর আমি খুঁজে পেলুম না। বললুম, এখনও আপনার কবিতার নিয়মিত অনুবাদ হয় বাংলায়। কয়েক বছর আগে একটা পুরো অনুবাদ-বই বেরিয়েছে, আপনি জানেন বোধ হয়।
বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। কি যেন অনুবাদকের নাম? আমি বিষ্ণু দে-র কথা বললুম। উনি বললেন, আচ্ছা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু শিব–এদের নামে এখনও কি অনেকের নাম রাখা হয়?
–শিবের নানান নাম খুব জনপ্রিয়। আমাদের বাবা-কাকাদের আমল পর্যন্ত শিব-বিষ্ণু-র নামে অনেকের নাম রাখা হত। এখন কমে গেছে। আর ব্রহ্মা ঠিক গৃহদেবতা হিসেবে পূজিত হন না বলেই বোধহয়, তাঁর নামে নাম রাখা হয় না। আমি অন্তত বাংলাদেশেব্ৰহ্মা নামের কোনও লোক দেখিনি।
তারপর তিনি অনুবাদ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করলেন। এখনকার বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে দু-একটা কথা জানতে চাইলেন। ঘরে বেশ রোদ এসেছে, মাঝে মাঝে ওঁর চশমায় লেগে ঝলসাচ্ছে সেই রোদ। আমার অস্বস্তিবোধ যায়নি। যদিও কথা বলে যাচ্ছেন কিন্তু আমার ঠিক কখন উঠে পড়া উচিত বুঝতে পারছি না। হাজার হোক, ইংরেজ–কখনও বুঝতে দেবে না আমার ওঠার সময়। ওই রকমই হয়তো কথা বলে যাবেন। অথচ, হঠাৎ কথার মাঝখানে উঠে পড়াও যায় না।
জানলার দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, পৃথিবীর কত দেশে কত নতুন রকমে হয়তো লেখা হচ্ছে। ইংরেজি-ফরাসির মধ্য দিয়ে না এলে আমরা জানতে পারি না। ভারতীয় সাহিত্য বলতে আমরা এখনও সংস্কৃত বা রবীন্দ্রনাথের কথাই জানি। কিন্তু আধুনিক বাংলায় হয়তো এমন লেখা হচ্ছে যা আমাদের সচকিত করে দিতে পারে। কিন্তু, অনুবাদ না হলে–। সুইডেনের সাহিত্য সম্পর্কেও আমাদের জ্ঞান কম, কিন্তু দাগ হ্যামার-সোলডের লেখা পড়ে আমি অভিভূত হয়ে গেছি! অডেনকে বলেছি অনুবাদ করতে শিগগিরই বোধহয় ছাপা হবে।
আমি এই সময় দাঁড়িয়ে উঠে বললুম, আচ্ছা, এবার আমি যাই।–আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলুম, এ কথাও বলব ভেবেছিলাম, কিন্তু মনে মনেই রয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, আমার গলার আওয়াজ ওঁর সামনে বড় কর্কশ শোনাচ্ছে। উনি আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
সেদিন কল্পনাও করতে পারিনি, আর মাত্র পাঁচ মাস বাদেই এলিয়টের মৃত্যু হবে।