৭৮তম অধ্যায়
নলরাজের স্বরাজ্যে আগমন
বৃহদশ্ব কহিলেন, “হে কৌন্তেয়! নিষধরাজ শ্বশুরালয়ে একমাস বাস করিয়া বিদৰ্ভরাজের নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক পরিমিত পরিজন-সমভিব্যাহারে স্বদেশে যাত্রা করিলেন। তাঁহার সঙ্গে একখানি রথ, ষোড়শ হস্তী, পঞ্চাশৎ অশ্ব ও ছয়শত পদাতি চলিল। নলরাজ সত্বর হইয়া প্ৰচণ্ডবেগে গমন করায় বোধ হইতে লাগিল যেন, মেদিনীমণ্ডল কম্পিত হইতেছে। তিনি অনতিকালমধ্যে রাজধানীতে উত্তীর্ণ হইয়া স্বীয় ভ্রাতা পুষ্করের নিকট হমন করিয়া কহিলেন, ‘পুষ্কর! পুনর্ব্বার দ্যূতক্রীড়া করিতে হইবে। আমি বিপুল ধনোপার্জ্জন করিয়া আনিয়াছি। এই সমস্ত অর্থ, তদ্ব্যতীত অন্য যাহা কিছু সম্পত্তি আছে এবং প্রিয়তমা দময়ন্তীকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া করিবা; অতএব আর বিলম্ব প্রয়োজন নাই, দ্যূতারম্ভ হউক। কিন্তু তোমাকেও রাজ্য পণ রাখিতে হইবে। যদি ইহাতেও জয়লাভ করিতে না পারি, তাহা হইলে পরিশেষে প্রাণ পৰ্যন্তও পণ রাখিয়া ক্ৰীড়া করিব। অন্যের ধনসম্পত্তি ও রাজ্য জয় করিয়া প্ৰতিপণ প্ৰদান করা অবশ্য কর্ত্তব্য; পণ্ডিতেরা উহাকে পরমধর্ম্ম বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। যদ্যপি অক্ষদ্যূত-পরাঙ্মুখ হও, তাহা হইলে রণক্ৰীড়ায় প্রবৃত্ত হইতে হইবে; সেই যুদ্ধে অন্যের সহায়তা থাকিবে না; কেবল আমরা উভয়ে অনন্যসহায় হইয়া, রথারোহণপূর্ব্বক যুদ্ধ করিব, ইহাতে জয়শ্ৰী তোমাকেই আশ্রয় করুন অথবা আমাকেই আশ্রয় করুন, একপক্ষ জয়ী হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রাচীনদিগের এই শাসন আছে যে, যে কোন উপায়দ্বারা বংশপরম্পরাগত রাজ্য অবশ্যই অধিকার করিবে; অতএব তুমি এক্ষণে একতর পক্ষ অবলম্বন কর; হয় পুনর্ব্বার পাশক্রীড়া কর, নতুবা যুদ্ধার্থে প্ৰস্তুত হও ।”
পুনরর্দ্যূতে পুষ্করের পরাজয়
“পুষ্কর নলের বাক্য-শ্রবণানন্তর আপনারই জয়লাভ নিশ্চয় বোধ করিয়া সহাস্যবদনে কহিল, “হে নৈষধ! তুমি ভাগ্যক্রমে বিপুল ধনোপার্জ্জন করিয়া আনিয়াছ; আমি সর্ব্বদাই তোমাকে স্মরণ ও তোমার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করিতেছি। তুমি সস্ত্রীক পণ্য হইয়াছ; ইহা আমার পরম ভাগ্য। অদ্য আমার চিরপ্রার্থিত মনোরথ সফল হইল এবং সৌভাগ্যফলে দময়ন্তীরও দূরদৃষ্ট ক্ষয় হইল। তোমার সমস্ত ধনসম্পত্তি জয় করিলেই দময়ন্তী আপনি আসিয়া আমাকে ভজনা করিবে; অথবা দ্যূতক্রীড়ায় সেই বরবর্ণিনীকে জয় করিয়া চরিতার্থ হইব, তাহাতে সন্দেহ নাই। কারণ, সেই আলোকসামান্য লাবণ্যবতী নিরন্তর আমার হৃদয়ে বাস করিতেছেন। যেমন অন্সরা-সকল দেবরাজ ইন্দ্রের সেবা করিয়া থাকে, সেইরূপ জয়লব্ধা দময়ন্তী আমার পরিচর্য্যা করিবেন। অতএব আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই, শীঘ্ৰ দ্যূতারম্ভ হউক।”
“নলরাজ অসম্বদ্ধ-প্ৰলাপী পুষ্করের এতাদৃশ বাক্যশ্রবণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া শাণিত খড়গদ্বারা তাহার মস্তকচ্ছেদন করিবার মানস করিলেন; পরে ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক রোষকষায়িতলোচনে কহিলেন, “অরে পুষ্কর! তুই এখন বারবার পণের কথা কহিতেছিস, কিন্তু পরে পরাজিত হইলে তোর মুখে আর এ কথা থাকিবে না।”
নলকর্ত্তৃক দ্যূতজিত সম্পদ পুষ্করকে প্রত্যার্পণ
“অনন্তর উভয়ের দ্যূতারম্ভ হইল; নিষধরাজ এক পণে পুষ্করের যথাসর্ব্বস্ব জয় করিয়া লইলেন। সে প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পণ রাখিল, নলরাজ তাহাও জয় করিয়া সহাস্যমুখে কহিতে লাগিলেন, ‘রে নৃপাপসদ! এতদিনে আমার সমগ্র রাজ্য নিষ্কণ্টক হইল এবং তোমারও সেই দুরাশা সমুন্মুলিত হইল। এক্ষণে তোমার দময়ন্তীর, প্রতি দৃষ্টিপাত করিবারও ক্ষমতা রহিল না; প্রত্যুত তোমাকে সপরিবারে তাহার দাসত্ব করিতে হইবে। রে মূঢ়! তুমি জান না যে, কেবল কলির প্রভাবে পূর্ব্বে আমাকে পরাস্ত করিয়াছিলে; তাহাতে তোমার কিছুমাত্র পৌরুষ নাই। যাহা হউক, আমি পরাপরাধে তোমার প্রতি দোষারোপ করিতে ইচ্ছা করি না। আমি মনে করিলে এই দণ্ডেই তোমার প্রাণদণ্ড করিতে পারি, কিন্তু তাহার আবশ্যকতা নাই। আমি তোমাকে জীবনভিক্ষা দিতেছি; তুমি স্বচ্ছন্দে জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ কর। তোমার যে সমস্ত ধনসম্পত্তি জয় করিয়াছি, তাহাও প্ৰদান করিলাম। তোমার প্রতি আমার সেইরূপ প্রীতিই আছে, সন্দেহ নাই। হে পুষ্কর! তুমি আমার কনিষ্ঠভ্রাতা, ভ্রাতৃসৌহার্দ্য কখনও বিচ্ছিন্ন হইবার নহে; অতএব আশীর্ব্বাদ করি, তুমি শত বৎসর জীবিত থাকিয়া পরমসুখে কালব্যাপন কর।”
পুষ্করের নিজ নগরে প্রত্যাগমন
“সত্যবিক্রম নিষধরাজ ভ্রাতাকে পুনঃ পুনঃ আলিঙ্গন ও সান্ত্বনা করিয়া স্বপুরে প্রেরণ করিলেন। পুষ্কর বিনীতভাবে ভ্ৰাতৃচরণে অভিবাদনপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, ‘রাজন! আপনি কৃপা করিয়া আমাকে ধন, প্রাণ ও আশ্রয় প্রদান করিয়াছেন; আপনার চিরস্বরণীয় কীর্ত্তি কখনই বিলুপ্ত হইবে না; এক্ষণে প্রার্থনা করি, আপনি অনন্তকাল সুখস্বচ্ছন্দে জীবিত থাকিয়া রাজ্যভোগ করুন।”
“পুষ্কর মহাসমাদরে ভ্রাতৃসন্নিধানে একমাস বাস করিয়া বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক আত্মীয়-স্বজন, ভূত্যামাত্য ও মহতী সেনাসমভিব্যাহারে হৃষ্টচিত্তে স্বীয় নগরে গমন করিলেন। তাঁহার প্ৰস্থানানন্তর নিষধাধিপতি সুশোভিত নিজ নগরীতে প্রবিষ্ট হইয়া পুরবাসীদিগকে নানাপ্রকারে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। বহুদিবসের পর রাজাকে নয়নগোচর করিয়া তত্ৰত্য জনগণের আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। অমাত্যপ্রমুখ পৌর ও জনপদেরা ভূপতিসমীপে উপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, ‘মহারাজ! অদ্য আপনাকে পাইয়া আমরা পরমসুখী হইলাম। অমরগণ যেমন দেবরাজের উপাসনা করেন, তদ্রূপ আপনার উপাসনা করিবার নিমিত্ত আমরা পুনর্ব্বার সমুপস্থিত হইয়াছি।’ ”