অষ্টসপ্ততিতম অধ্যায়
দেবযানী-শর্ম্মিষ্ঠার বিবাদ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! কচ কৃতবিদ্য হইয়া দেবলোকে প্রত্যাগমন করিলে দেবগণ অতীব হৃষ্টচিত্তে তাঁহার নিকট সঞ্জীবনীবিদ্যা অধ্যয়ন করিয়া চরিতার্থ হইলেন। অনন্তর তাঁহারা সকলে ইন্দ্রসন্নিধানে গমন করিয়া নিবেদন করিলেন, “হে পুরন্দর! তোমার বিক্রমপ্রকাশের উপযুক্ত অবসর উপস্থিত হইয়াছে, এক্ষণে শত্রুকুল-সংহারের নিমিত্ত প্রস্তুত হও।” ইন্দ্র দেবগণ কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত ও উত্তেজিত হইয়া তৎক্ষণাৎ যাত্রা করিলেন। কিয়দ্দূর গমন করিয়া চৈত্ররথোপম পরম-রমণীয় এক কাননে কতকগুলি স্ত্রীলোক দেখিতে পাইলেন। তাহারা স্ব স্ব পরিধেয়বস্ত্র সরোবরতীরে রাখিয়া জলবিহার করিতেছিল। দেবরাজ এই অবসরে বায়ুরূপ ধারণ করিয়া কন্যাদিগের বস্ত্র সকল একত্র মিশ্রিত করিয়া দিলেন। তৎপরে কন্যাগণ সকলে জল হইতে উত্থিত হইয়া, যিনি যে বস্ত্র সম্মুখে পাইলেন, তাহাই পরিধান করিলেন। তন্মধ্যে বৃষপর্ব্বদুহিতা শর্ম্মিষ্ঠা না জানিতে পারিয়া দেবযানীর বস্ত্র গ্রহণ করিলেন। তদুপলক্ষে তাঁহাদের উভয়ের বিরোধ উপস্থিত হইল। দেবযানী কহিলেন, “রে অসুরকন্যা! তুই আমার শিষ্যা হইয়া কোন্ সাহসে আমার বস্ত্র পরিধান করিতেছিস? এই অত্যাচারে তোর শ্রেয়োলাভ হইবে না।” শর্ম্মিষ্ঠা কহিলেন, “দেখ দেবযানী! আমার পিতা যখন শয়ান বা উপবিষ্ট থাকেন, তোমার পিতা নিম্নাসনে উপবেশন করিয়া অতি বিনীতভাবে স্তুতিপাঠকের ন্যায় তাঁহাকে নিয়ত স্তব করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি স্তব-প্রতিগ্রহ ও যাচ্ঞা দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করে, তুমি তাহারই কন্যা। আর সকলে যাহার আরাধনা করিয়া থাকে, যিনি প্রার্থনাধিক অর্থদান করিয়া যাচকের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন, আমি তাঁহার কন্যা। তুমি যত পার, ক্ষোভ কর, হিংসা কর, দ্বেষ কর বা শাপ দাও, আমি তোমাকে কখনই সমকক্ষ বলিয়া গণনা করিব না।”
দেবযানীকে কূপে নিক্ষেপ
শর্ম্মিষ্ঠার এইরূপ অতি কঠোর বাক্য শ্রবণ করিয়া দেবযানী ক্রোধে অধীর হইয়া বলপূর্ব্বক আপনার পরিধেয়-বসন আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে শর্ম্মিষ্ঠা কোপাক্রান্ত ও কম্পিত কলেবর হইয়া দেবযানীকে সন্নিহিত এক কূপে নিক্ষেপ করিলেন। দেবযানী কূপে পতিত হইয়া নিশ্চয় প্রাণ পরিত্যাগ করিয়াছে, এই স্থির করিয়া শর্ম্মিষ্ঠা স্বভবনে গমন করিলেন। মৃগয়াবিহারী নহুষাত্মজ যযাতি রাজা অশ্বারোহণে সেই অরণ্যে ভ্রমণ করিতেছিলেন। তিনি মৃগের অনুসরণক্রমে পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ হইয়া জল অন্বেষণ করিতে করিতে সেই কূপের সন্নিহিত হইলেন। রাজা জল-প্রার্থনায় কূপমধ্যে দৃষ্টিপাত করিবামাত্র অগ্নিশিখার ন্যায় এক কামিনীকে নয়নগোচর করিয়া অতীব বিস্ময়রসে নিমগ্ন হইলেন। তিনি সেই রমণীকে অতি করুণস্বরে বিলাপ ও পরিতাপ করিতে দেখিয়া মধুর সান্ত্বনা-বাক্যে জিজ্ঞাসিলেন, “ভদ্রে! তুমি কে? কাহার কন্যা? কেনই বা এত শোকাকুলা হইয়াছ? আর কিরূপেই বা এই অন্ধকূপে পতিত হইয়াছ?” দেবযানী কহিলেন, “দানবেরা দেবগণ কর্ত্তৃক যুদ্ধে নিহত হইলে যিনি সঞ্জীবনী-বিদ্যাবলে তাহাদিগকে পুনর্জ্জীবিত করেন, আমি সেই শুক্রাচার্য্যের কন্যা। আমি যে এই বনমধ্যে একাকিনী অন্ধকূপে পতিত আছি, তাহা তিনি জানিতে পারেন নাই। হে মহারাজ? আপনি মহাবংশ-প্রসূত, অসামান্য যশস্বী ও শান্তপ্রকৃতি; অতত্রব আপনি আমার দক্ষিণহস্ত ধরিয়া আমাকে এই কূপ হইতে উদ্ধার করুন।” রাজা যযাতি তাঁহার পরিচয় পাইয়া ব্রাহ্মণী-বোধে দক্ষিণ-হস্ত ধারণপূর্ব্বক কূপ হইতে উদ্ধৃত করিলেন এবং সাদর সম্ভাষণপূর্ব্বক তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া স্বনগরে প্রত্যাগমন করিলেন।
নহুষতনয় রাজা যযাতি নিজ রাজধানীতে প্রস্থান করিলে ঘূর্ণিকা-নাম্নী এক দাসী সহসা দেবযানী-সমীপে উপস্থিত হইল। দেবযানী বাষ্পাকুললোচনে তাহাকে কহিলেন, “ঘূর্ণিকে! তুমি সত্বর আমার পিতার নিকট যাইয়া বল, শর্ম্মিষ্ঠা আমার এই দুর্দ্দশা করিয়াছে, আর আমি বৃষপর্ব্বরাজের নগরে প্রবেশ করিব না।” তাঁহার আদেশপ্রাপ্তিমাত্রে ঘূর্ণিকা দ্রুতপদসঞ্চারে অসুরমন্দিরে প্রবিষ্ট হইয়া সম্ভ্রমাবিষ্টচিত্তে শুক্রসন্নিধানে উপস্থিত হইয়া দেবযানী-বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত সমস্ত নিবেদন করিল। মহর্ষি শুক্র শ্রুতিমাত্রেই উত্থিত হইয়া বনমধ্যে কন্যার অন্বেষণে গমন করিলেন এবং অবিলম্বেই তথায় উপনীত হইয়া দেবযানীকে দৃষ্টিগোচর করিয়া বাৎসল্যভাবে আলিঙ্গনপূর্ব্বক গদ্গদবচনে কহিলেন, “বৎসে দেবযানী! আপনার সুকৃতি ও দরষ্কৃতি অনুসারে সকলে সুখদুঃখ ভোগ করিয়া থাকে; বোধ হয়, তুমি কোন পাপকর্ম্ম করিয়া থাকিবে, তাহারই ফলভোগ করিতে হইয়াছে।” দেবযানী কহিলেন, “তাত! পাপের ভোগ হউক বা না হউক, এক্ষণে বৃষপর্ব্বতনয়া শর্ম্মিষ্ঠা আমাকে যেরূপ করিয়াছে, তাহা শ্রবণ করুন।” এই বলিয়া পিতার নিকট সমস্ত পরিচয় দিলেন; পরিশেষে কহিলেন, “শর্ম্মিষ্ঠা যে প্রকার কহিয়াছে, আমি যদি যথার্থই সেইরূপ হই, তবে তাহার নিকট আপনার দোষ স্বীকার করা ও ক্ষমা প্রার্থনা করা কর্ত্তব্য, নতুবা তাহার অহঙ্কারের প্রতীকার করিতে হইবে।” শুক্র কহিলেন, “বৎসে! তুমি ত’ স্তাবক বা প্রতিগ্রহোপজীবীর [দানগ্রহণ দ্বারা জীবনধারণকারীর] কন্যা নহ। তোমার পিতা কাহারও চাটুকার নহেন, বরং অন্যে তাঁহার স্তব করিয়া থাকে। বৃষপর্ব্বা, ইন্দ্র এবং নহুষতনয় রাজা যযাতি ইঁহারা সকলেই জানেন যে, অচিন্ত্য নির্দ্বন্দ্ব পরব্রহ্মই আমার বল। স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা তুষ্ট হইয়া আপনি কহিয়াছেন, পৃথিবীতে বা স্বর্গে যে কিছু বস্তু আছে, আমিই তাহার ঈশ্বর। আমি তোমাকে সত্য কহিতেছি, প্রজাদিগের প্রিয়কার্য্যসম্পাদনের নিমিত্ত আমিই বারিবর্ষণ ও ওষধি-সকল পুষ্ট করিয়া থাকি।” মহানুভব শুক্র বিষাদমগ্না ক্রোধাকুলা দেবযানীকে এইরূপ মধুরবাক্যে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।