৭৭তম অধ্যায়
সন্ধির অসম্ভবতা-অর্জ্জুনের যুদ্ধসঙ্কল্প
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে জনার্দন! মহারাজ যুধিষ্ঠির উপযুক্ত কথা কহিয়াছেন; কিন্তু তোমার বাক্যে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা জন্মিতেছে। তুমি নিশ্চয় বুঝিয়াছ যে, ধৃতরাষ্ট্রের লোভ ও আমাদের দৈন্যপ্রযুক্ত কৌরবগণের সহিত আমাদিগের সন্ধি হওয়া অতি দুষ্কর। তুমি কহিলে যে, প্রাক্তন কর্ম্ম ব্যতীত কেবল পুরুষকারদ্বারা ফললাভ হইবার সম্ভাবনা নাই; তন্নিমিত্তই পুরুষের যত্ন অনেকবার নিস্ফল হয়। আরও কহিয়াছ যে, তোমার যুদ্ধ করিতে বিলক্ষণ অভিলাষ আছে; যদি উহা যথার্থ হয়, তবে যুদ্ধেই প্রবৃত্ত হও; কিন্তু তুমি ইচ্ছা করিলে অনায়াসেই শান্তিসংস্থাপন করিতে পার, তোমার অসাধ্য কিছুই নাই। তুমি যুদ্ধ সাতিশয় কষ্টদায়ক বলিয়া স্বীকার করিতেছ; আর উহাতে কৌরব ও পাণ্ডব উভয়েরই বিনাশ হইবার সম্ভাবনা বটে; কিন্তু যাহাদের নিকট কর্ম্মসকল সফল হয় না, তাহাদের পক্ষে সামাদি উপায়ও বিনাশকরা হইয়া উঠে। হে পুরুষোত্তম! কর্ম্ম সম্যকরূপে সম্পাদন করিলে প্রায়ই ফলোদয় হইয়া থাকে। অতএব তুমি এইরূপ কাৰ্য্য করিবে, যাহাতে শক্রগণের নিকট আমাদের শ্ৰেয়োলাভ হইতে পারে।
“হে কৃষ্ণ! প্রজাপতি যেমন সুর ও অসুর—এই উভয় পক্ষের সুহৃৎ, তদ্রূপ তুমিও কৌরব ও পাণ্ডব এই উভয় পক্ষেরই প্রথম মিত্ৰ। অতএব তুমি আমাদের উভয় পক্ষের নিরাময় চিন্তা কর; আমাদের হিতানুষ্ঠান করা তোমার পক্ষে দুষ্কর নহে। হে জনাৰ্দন! তুমি কুরুসভায় গমন করিলেই শান্তিস্থাপন করিতে সমর্থ হইবে। আর যদি কৌরবগণের সহিত সংগ্রাম করিতে হয়, তাহাতেও আমার অসম্মতি নাই। ফলতঃ তুমি আমাদের উপদেষ্টা; উত্তমরূপে বিবেচনা করিয়া তাহাদের সহিত সংগ্রাম বা সন্ধি যাহা করিতে বলিবে, আমি তাহাতেই সম্মত হইব। হে মধুসূদন! যে দুরাত্মা ধর্ম্মানন্দনের উৎকৃষ্ট সম্পত্তি-দর্শনে অধৈৰ্য্য হইয়া দ্যূতক্ৰীড়ারূপ নৃশংস উপায়দ্বারা উহা অপহরণ করিয়াছে, তাহাদের সমূলে উন্মুলন করা কি আমাদের কর্ত্তব্য নহে? দূতক্ৰীড়ায় যুধিষ্ঠিরের কিছুমাত্র অপরাধ নাই; কোন ক্ষত্ৰিয় প্রাণনাশ উপস্থিত হইলে আহূত হইয়াও প্রতিনিবৃত্ত হয়? যাহা হউক, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন যখন আমাদিগকে কপটদ্যূতে পরাজিত করিয়া বনে প্রেরণ করিয়াছে, তখনই সে আমাদের বধ্যের মধ্যে পরিগণিত হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই।
“হে কৃষ্ণ! তুমি যে সন্ধিস্থাপনের চেষ্টা করিতেছ, তাহা অনুচিত নহে, কেননা, সন্ধি বা বিগ্রহ যে উপায়দ্বারা হউক, কাৰ্য্যসিদ্ধি হইলেই শ্রেয়োলাভ হয়। অথবা যদি তুমি কৌরবগণের সহিত সংগ্রাম করাই উপযুক্ত বোধ কর, তবে শীঘ্র তাহার অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও, আর কালবিলম্বের আবশ্যকতা নাই। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন সভামধ্যে দ্রৌপদীকে যেরূপ ক্লেশ প্রদান করিয়াছিল তাহা তোমার অবিদিত নাই। এক্ষণে সে দুরাত্মা যে আমাদের সহিত সন্ধিস্থাপনে সম্মত হইবে, আমি কখনই এরূপ প্রত্যাশা করি না। দেখ, মরুভূমিতে বীজ নিক্ষেপ করিলে কি তাহা অঙ্কুরিত হইয়া থাকে? অতএব যাহাতে আমাদের হিত হয়, এরূপ বিবেচনা করিয়া সত্বর কর্ত্তব্যকর্মের অনুষ্ঠানে যত্নবান হও।”