৭৬তম অধ্যায়
স্বপক্ষসৈন্যনাশে ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষোভ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমাদের সৈন্য বহুসংখ্যক, বহুগুণান্বিত ও উৎকৃষ্ট ব্যূহও যথাশাস্ত্ৰ বিনির্ম্মিত ও অভেদ্য। আমাদিগের সৈন্যগণ প্ৰগল্ভ, আমাদের প্রতি অনুরক্ত, ব্যসন-শূন্য ও দৃঢ়বিক্রম। উহাদের মধ্যে কেহই অতিবৃদ্ধ বা বালক, অতিকৃশ ও অতিপীবর [অতিস্থূল] নহে; সকলেই দৃঢ়গাত্র, বর্ম্মিত, বহুশাস্ত্ৰজ্ঞ, অসিযুদ্ধে ও গদাযুদ্ধে পারদশী; প্রাস, ঋষ্টি, তোমর, পরিঘ, ভিন্দিপাল, শক্তি ও মুষলে সুশিক্ষিত; সমুদয় শস্ত্ৰগ্ৰহণবিদ্যায় সুনিপুণ এবং আরোহণ [হস্তী অশ্বাদিতে উঠা ও তাহা হইতে নামা], সরণ [নিঃসরণ—বাহির হইয়া আসা], বিরল [সৈন্যমধ্যে গা-ঢাকা দেওয়া], প্লুত, সম্যক প্রহার, যান ও ব্যাপযানে [যানের বিপরীত গতি সম্পাদনে] বিশেষ পারগ। আমরা উহাদের নাগ, অশ্ব ও রথগমনে পরীক্ষা করিয়াই বেতন দিয়া নিযুক্ত করিয়াছি; তাহারা গোষ্ঠী [সামাজিক সম্পর্ক], উপকার, সম্বন্ধ, সৌহার্দ্য বা কুলমৰ্য্যাদানিবন্ধন নিযুক্ত হয় নাই। উহারা আৰ্য্যবংশোদ্ভব ও সমৃদ্ধ; উহারা সতত পরিতোষিত ও সৎকৃত হইয়া থাকে। উহারা সকলেই সাতিশয় উপকারী, যশস্বী, মুখ্য কর্ম্মা, সজীব, লোকপালসদৃশ, লোকবিশ্রুত ব্যক্তিগণকর্ত্তৃক পালিত, লোকসম্মত, স্বেচ্ছানুসারে আমাদের সমীপে সমাগত এবং সানুচর সকল ক্ষত্ৰিয়গণকর্ত্তৃক সংরক্ষিত। ঐ পরিপূর্ণ মহোদধিতুল্য প্রভূত সৈন্য রথ, রাজমাতঙ্গসদৃশ মাতঙ্গগণে সংবৃত; গদা, শক্তি, প্রাস প্রভৃতি নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র ও ধাবমান বাহনগণে সমাকুল; বিবিধ ধ্বজ, ভূষণ ও রত্নে সুশোভিত; সাগরসদৃশ গৰ্জমান এবং ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃতবর্ম্মা, কৃপ, দুঃশাসন, জয়দ্ৰথ, ভগদত্ত, বিকৰ্ণ, অশ্বত্থামা, শকুনি, বাহ্লীকপ্রভৃতি মহাত্মা বলবান বীরগণকর্ত্তৃক রক্ষিত।
“হে সঞ্জয়! আমাদের পক্ষীয় সৈন্যগণ ঈদৃশ হইয়াও পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক নিহত হইল, ইহা কেবল জন্মান্তরীণ অদৃষ্টের ফল। কি মহাভাগ পুরাতন ঋষিগণ, কি মানবগণ, কেহই ঈদৃশ উদ্যোগ দর্শন করেন নাই। আমাদের এতাদৃশ বলসমুদয় যে সংগ্রামে অনায়াসে নিহত হইতেছে, কেবল অদৃষ্টই তাহার কারণ। হে সঞ্জয়! এক্ষণে আমার সমুদয় বিষয় বিপরীত বলিয়া বোধ হইতেছে। মহাত্মা বিদুর পূর্ব্বে এই বিপদের কথা বলিয়াছিলেন; দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন তাঁহার বাক্য গ্ৰহণ করে নাই। সেই সর্ব্বজ্ঞ ক্ষত্তা পূর্ব্বে যাহা বুঝিতে পারিয়া আমাদিগকে কহিয়াছিলেন, এক্ষণে তৎসমুদয়ই ঘটিতেছে; অথবা বিধাতা যাহা সৃষ্টি করিয়াছেন, কদাপি তাহার অন্যথা হইবার সম্ভাবনা নাই।”