৭৬তম অধ্যায়
জয়দ্রথবধ প্রতিজ্ঞাবিষয়ে অর্জ্জুনের দৃঢ়তা
অর্জ্জুন কহিলেন, হে মধুসুদন! তুমি দুৰ্য্যোধনের যে ছয় জন রথীকে অধিকতর বলবান্ বলিয়া বোধ করিতেছ, আমার বোধ হয়, তাহাদিগের বীরত্ব আমার বীরত্বের অর্দ্ধ ভাগেরও সমান নহে। তুমি দেখিবে আমি জয়দ্রথবধার্থে সংগ্রামে গমন করিয়া অস্ত্র দ্বারা উল্লিখিত বীরগণের অস্ত্র ছিন্ন ভিন্ন ও সিন্ধু রাজের মস্তক ভূতলে নিপাতিত করিব; দ্রোণাচাৰ্য্য তদ্দর্শনে স্বগণ সমভিব্যাহারে বিলাপ করিবেন। যদি সুররাজ ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, গরুড়, আকাশ, স্বর্গ, পৃথিবী এবং সমুদায় সাধ্য, রুদ্র, বসু, দেবতা, বিশ্বদেব, গন্ধর্ব্ব, পিতৃলোক, সাগর, পৰ্ব্বত, দিক্, দিক্পতি, গ্রাম্য ও আরণ্য, প্রাণী ও অন্যান্য স্থাবর জঙ্গমগণ সিন্ধুরাজের পরিত্রাতা হন, তথাপি কালি তুমি তাঁহাকে আমার শরনিকরে নিহত নিরীক্ষণ করিবে। আমি সত্য দ্বারা শপথ ও আয়ুধস্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে মহাধনুৰ্ধর দ্রোণাচার্য্য সেই পাপাত্মা দুৰ্ম্মতি জয়দ্রথের রক্ষক, অতএব অগ্রে তাঁহাকেই আক্রমণ করিব। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন দ্রোণাচার্যের উপরেই এই সংগ্রামের জয় পরাজয় নির্ভর করিয়াছে; অতএব আমি দ্রোণেরই সেনাগ্রভাগ ভেদ করিয়া সিন্ধুরাজের নিকট গমন করিব। কালি তুমি দেখিবে যে, মহা ধনুর্দ্ধরগণ বজ্ৰ বিদারিত পর্ব্বত শৃঙ্গসমূহের ন্যায় আমার সুতীক্ষ্ণ নারাচ নিয়ে বিদীর্য্যমান হইতেছে এবং মনুষ্য মাতঙ্গ ও তুরঙ্গ সমুদায় নিশিত শরসম্পাতে বিদীর্ণ কলেবর ও নিপতিত হইয়া শোণিত ধারা মোক্ষণ করিতেছে। গাণ্ডীব নিক্ষিপ্ত মনোমারুতগামী শরনিকর সহস্র সহস্র নর, বারণ ও অশ্বের প্রাণ সংহার করিবে। আমি যম, কুবের, বরুণ, ইন্দ্র ও রুদ্র হইতে যে সকল ভীষণ অস্ত্র লাভ করিয়াছি, নরপতিগণ এই যুদ্ধে তৎসমুদায় নয়নগোচর করিবেন। কালি তুমি দেখিবে যে, যাঁহারা সিন্ধুরাজকে রক্ষা করিতেছেন, তাঁহাদিগের অস্ত্র সমুদায় আমার ব্রহ্ম-অস্ত্রে বিনাশিত এবং শরবেগচ্ছেদিত নরপতিগণের মস্তক সমূহে ধরামণ্ডল আচ্ছাদিত হইতেছে। আমি রাক্ষসগণকে পরিতৃপ্ত, শত্রুগণকে দ্রাবিত, সুহৃদগণকে আনন্দিত ও সিন্ধুরাজকে নিহত করিব। অশেষাপরাধী অনাত্মীয়, পাপদেশ সমুৎপন্ন সিন্ধুরাজ আমা কর্ত্তৃক নিহত হইয়া আত্মীয়গণকে শোকাকুল করিবে। কালি পাপাচারপরায়ণ জয়দ্রথকে সমুদায় রাজার সহিত শরনিকরে বিদীর্ণ দেখিতে পাইবে। কালি প্রভাতে আমি এরূপ কাৰ্য্য করিব যে, দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন এই ভূমণ্ডলে আমার সদৃশ ধনুর্দ্ধর আর কেহই নাই বলিয়া নিশ্চয় করিবে। গাণ্ডীব দিব্য ধনু, আমি যোদ্ধা ও তুমি সারথি; তবে আমার অজেয় আর কি আছে? হে ভগবন্! তোমার প্রসাদে যুদ্ধে আমার কিছুই অপ্রাপ্ত নাই; তুমি আমার পরাক্রম নিতান্ত অসহ্য জানিয়াও কেন আমাকে তিরস্কার করিতেছ? চন্দ্রের শোভা ও সমুদ্রের জল যেমন স্থির, আমার প্রতিজ্ঞাও সেই রূপ অচল জানিবে। হে মধুসূদন! আমার এবং আমার অস্ত্র, দৃঢ় ধনু ও বাহু বলের অবমাননা করিও না। আমি এরূপে সংগ্রামে গমন করিব যে
, আমার অবশ্যই জয় লাভ হইবে; আমি কখনও পরাজিত হইব না। আমি যখন প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তখন তুমি মনে স্থির কর যে, জয়দ্রথ বিনাশ প্রাপ্ত হইয়াছে। ব্রাহ্মণে সত্য, সাধুতে নম্রতা, যজ্ঞে শ্রী ও নারায়ণে জয় প্রতি নিয়তই বিরাজমান থাকে।”
ইন্দ্রনন্দন ধনঞ্জয় মহাত্মা হৃষীকেশকে এই কথা বলিয়া আদেশ করিলেন যে, “হে কেশব! যাহাতে রজনী প্রভাত হইবামাত্র আমার রথ সুসজ্জিত হয়, সাতিশয় উদ্যম সহকারে তাহার চেষ্টা করিও।”