কার্য্যসিদ্ধি জানি তবে সারথি মাতলি।
বায়ুবেগে রথ চালাইল মহাবলী।।
নানা কাব্য কথায় হরিষ দুই জন।
মুহূর্ত্তেকে গেল তবে ইন্দ্রের ভুবন।।
অর্জ্জুনের আগমনে ইন্দ্রের আনন্দ।
সঙ্গেতে করিয়া যত দেবতার বৃন্দ।।
আগুসরি নিজে ইন্দ্র যান কত পথ।
হেনকালে উত্তরিল অর্জ্জুনের রথ।।
নিকটে দেখিয়া পার্থ শচীর ঈশ্বরে।
রথ হৈতে ভূমিতলে নামিয়া সত্বরে।।
প্রণাম করিলা পার্থ ইন্দ্রের চরণে।
সম্ভাষ করেন সবে যত দেবগণে।।
দেব পুনন্দর আদি হরিষে বিভোল।
প্রেমাবেশে কহিলেন পার্থে দিয়া কোল।।
ধন্য ধন্য পুত্র তুমি, ধন্য তব শিক্ষা।
ধন্য তারে, যেই জন তোমা দিল দীক্ষা।।
জানিনু তোমাতে ধন্য ভোজরাজ সুতা।
তোমা হেন পুত্র হেতু আমি ধন্য পিতা।।
তোমা হৈতে নাশ হৈল আমার অরিষ্ট।
এত দিনে পরিপূর্ণ হইল অভীষ্ট।।
এত বলি কুতূহলী দেব পুরন্দর।
দিলেন যুগল তূণ আর দিব্য শর।।
মস্তকে কিরীট দিল কর্ণেতে কুণ্ডল।
দশ নাম নিরূপণ করে আখণ্ডল।।
আছিল অর্জ্জুন নাম দ্বিতীয় ফাল্গুনি।
নক্ষত্রানুসারে নাম রাখিল জননী।।
খাণ্ডব দহিলে যবে আমা সবে জিনি।
সেইকালে জিষ্ণু নাম দিয়াছি আপনি।।
আমা হৈতে কিরীট পাইলে সুশোভন।
এই হেতু কিরীটি কহিবে সর্ব্বজন।।
করিছে রথের শোভা শ্বেত চারি হয়।
লোকে শ্বেতবাহন বলিয়া তোমা কয়।।
দিবেন বীভৎস নাম গোবিন্দ আপনি।
যথায় যাহ তথা আইস যুদ্ধ জিনি।।
এই হেতু তব নাম হইল বিজয়।
বর্ণভেদে সবে যেন কৃষ্ণ নাম কয়।।
উভয় হস্তেতে তব সমান সন্ধান।
সব্যসাচী নাম তেঁই করি অনুমান।।
ধনঞ্জয় নাম পেলে ধনপতি জিনি।
যোগের সাধন এই সর্ব্বলোকে জানি।।
কাম্য করি দশ নাম নরে যদি জপে।
অশুভ বিনাশ হয়, তরে সর্ব্ব পাপে।।
হেনমতে আনন্দে রহিল সর্ব্বজন।
প্রভাতে উঠিয়া তবে সহস্রলোচন।।
মাতলিরে ডাকি আজ্ঞা দিল মহামতি।
সুসজ্জ করিয়া রথ আন শীঘ্রগতি।।
আজ্ঞামাত্র আনিল সারথি বিচক্ষণ।
বিচিত্র সাজন, গতি নর্ত্তক খঞ্জন।।
অমর ঈশ্বর তবে অর্জ্জুনে ডাকিল।
মধুর সম্ভাষ করি কহিতে লাগিল।।
শুন পুত্র বিলম্বেতে নাহি প্রয়োজন।
শীঘ্রগতি ভেট গিয়া ধর্ম্মের নন্দন।।
নানাবিধ বিভূষণে করি পুরষ্কার।
কোলে করি চুম্বিলেন পার্থে বারে বার।।
অর্জ্জুন পড়িল তবে ইন্দ্রের চরণে।
প্রণাম করিয়া দাণ্ডাইল বিধ্যমানে।।
করযোড়ে কহে পার্থ সকরুণ ভাষে।
তোমার আজ্ঞায় যাই ধর্ম্মরাজ পাশে।।
তোমার চরণে মম এই নিবেদন।
আপনি জানহ যত কৈল দুষ্টগণ।।
তা সবারে দিব আমি সমুচিত ফল।
কৃপা করি তুমি পিতা রবে অনুবল।।
ইন্দ্র বলে, যা বলিলে বৎস ধনঞ্জয়।
যথা তুমি তথা আমি, জানিও নিশ্চয়।।
মনের বাসনা পূর্ণ হইবে তোমার।
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম্ম অবতার।।
বসুমতী পতি যোগ্য সেই সে ভাজন।
কালেতে উচিত ফল পাবে দুর্য্যোধন।।
এতেক শুনিয়া পার্থ হরষিত মন।
অমরাবতীতে বাস করে যত জন।।
বিদায় সবার কাছে করিয়া গ্রহণ।
রথে আরোহিয়া যান পুলকিত মন।।
পথেতে কৌতুক নানা কথার আবেশে।
কতক্ষণে উপনীত ভারত প্রদেশে।।
এইমতে যাইতে মাতলি ধনঞ্জয়।
দেখিলেন কত দূরে গিরি হিমালয়।।
পরে যথা ধর্ম্ম, গন্ধমাদন পর্ব্বত।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিল অর্জ্জুনের রথ।।
চিন্তায় ব্যাকুল চিত্ত ধর্ম্ম নৃপবর।
অর্জ্জুনে দেখিয়া হৈল প্রফুল্ল অন্তর।।
ভূমে নামিলেন পার্থ ত্যজি ইন্দ্র রথ।
যুধিষ্ঠির চরণে হৈলেন দণ্ডবৎ।।
অর্জ্জুনে করিয়া বক্ষে ধর্ম্মের নন্দন।
মহা হরষেতে হইলেন নিমগন।।
পূর্ণচন্দ্র শোভা দেখি হর্ষে জলনিধি।
দরিদ্র পাইল যেন মহারত্ন নিধি।।
ধর্ম্ম আনন্দাশ্রুজলে পার্থ করি স্নান।
ভীমের চরণে নতি করেন বিধান।।
আলিঙ্গন করি দুই মাদ্রীর নন্দনে।
দ্রৌপদীরে তুষিলেন মধুর বচনে।।
শুনিয়া লোমশ মুনি ধৌম্য পুরোহিত।
শীঘ্রগতি তথা আসি হন উপনীত।।
সম্ভ্রমে উঠিয়া পার্থ পড়েন চরণে।
প্রশংসিয়া আশীর্ব্বাদ কৈল দুই জনে।।
হেনমতে মহানন্দে বসে সর্ব্ব জন।
কৌতুক বিধানে যত কথোপকথন।।
ভারত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে রচিলেন তাঁর দাস।।