ইন্দ্র বাক্য ম করি মাতলি সারথি।
দৈত্যের দেশেতে তবে যায় দ্রুতগতি।।
যাইতে দৈত্যের পুরী দেখি বামভাগে।
শীঘ্রগতি রথ তবে চালাইল বেগে।।
কালকেয় নিবাতকবচ যেই দেশে।
মাতলি চালায় রথ চক্ষুর নিমিষে।।
জিনিয়া অমরাবতী পুরীর নির্ম্মাণ।
বিস্ময় মানিয়া পার্থ করে অনুমান।।
দেবের বসতি নহে মম অগোচর।
ভুবন তিনের সার কাহার নগর।।
মাতলিবে জিজ্ঞাসেন বীর ধনঞ্জয়।
কহ সত্য, জান যদি কাহার আলয়।।
সর্ব্বলোক সুখী আছে, নানা পরিচ্ছদ।
ইন্দ্রের অধিক দেখি প্রজার সম্পদ।।
মাতলি কহেন, পার্থ কর অবধান।
নিবাতকবচ নামে, দৈত্যের প্রধান।।
দেবের অবধ্য হয় তপস্যার বলে।
সমান নাহিক স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতলে।।
ইন্দ্রের বিপক্ষ বড়, এই দৈত্যগণ।
ইন্দ্রের সমান তেজ সৈন্য পরাক্রম।।
মহাবলবন্ত সব নিবাতের দেশে।
ইন্দ্রত্ব লইতে পারে চক্ষুর নিমিষে।।
এই দুষ্ট দেবেন্দ্রের মহাশত্রু হয়।
নিদ্রা নাহি শচীনাথে এই দৈত্য ভয়।।
তোমার এ বধ্য বটে জানিয়া বিশেষে।
আনিনু তোমারে পার্থ শুন এই দেশে।।
মাতলি কহিল যদি এতেক ভারতী।
কহিতে আরম্ভ করে পার্থ মহামতি।।
পিতার পরম শত্রু এই দুরাচার।
কি হেতু বিলম্ব আর করিতে সংহার।।
নিশ্চয় পূরাব আজি পিতৃ-মনোরথ।
নির্ভয় হইয়া চালাইয়া দেহ রথ।।
মাতলি কহিল, রথ চালাইতে নারি।
রথী মাত্র একা তুমি, এ কারণে ডরি।।
লক্ষ লক্ষ সেনা আছে, বহু যোদ্ধৃবর।
একা তুমি কি প্রকারে করিবে সমর।।
চল শীঘ্র জানাইব অমরের নাথে।
অনুমতি দিলে কত সৈন্য লয়ে সাথে।।
পশ্চাৎ করিব যুদ্ধ আসিয়া হেথায়।
যে আজ্ঞা তোমার হয়, মনে যেই লয়।।
এতেক কহিল যদি সারথি মাতলি।
ক্রোধভরে গর্জ্জি উঠি কহে মহাবলী।।
একা মোরে দেখি বুঝি ঘৃণা কর মনে।
বিরোধ করিবে কেবা বল মম সনে।।
সুরাসুর একত্রেতে আসি যদি বাদে।
চক্ষুর নিমিষে নিবারিব অপ্রমাদে।।
এখনি মারিব যত অমরের বৈরী।
না মারিলে বৃথা আমি পার্থ নাম ধরি।।
ধনু টঙ্কারিয়া শঙ্খ বাজান সঘনে।
রোষে গুণ দেন পার্থ নিজ ধনুর্ব্বাণে।।
মহাক্রোধ সিংহনাদ করে মহাবল।
দেখি কম্পমান হৈল ত্রৈলোক্য মণ্ডল।।
শত বজ্রাঘাত জিনি বিপরীত শব্দ।
শুনিয়া দৈত্যের পতি হৈল মহাস্তব্ধ।।
কালকেয় নিবাতকবচ বীর আদি।
ক্রোধভরে ধায় যত অমর বিবাদী।।
সসজ্জ হইয়া যত অস্ত্র লয়ে হাতে।
আরোহণ করি সবে অশ্ব গজ রথে।।
বিবিধ বাদ্যের শব্দ সৈন্য কোলাহলে।
ভেটিল আসিয়া সবে পার্থ মহাবলে।।
মাতলি সারথি রথে, ইন্দ্রতুল্য রূপ।
দেখিয়া জানিল সবে অমরের ভূপ।।
চতুর্দ্দিকে বেড়ি সবে করে অস্ত্রবৃষ্টি।
প্রলয় কালেতে যেন মজাইতে সৃষ্টি।।
না হয় নিমেষ পূর্ণ ছাড়িতে নিশ্বাস।
শরজাল করিয়া পূরিল দিশপাশ।।
দিবা দ্বিপ্রহরে হৈল ঘোর অন্ধকার।
অন্যের থাকুক নাহি পবন সঞ্চার।।
অগ্নি অস্ত্র এড়িলেন পার্থ মহাবল।
মুহূর্ত্তেকে শরজালে পূরিল সকল।।
মেঘ হৈতে মুক্ত যেন হইল মিহির।
প্রকাশ পাইল তথা পার্থ মহাবীর।।
মেঘ অস্ত্র পার্থ করিলেন বরিষণ।
বায়ু অস্ত্রে দৈত্যবর করে নিবারণ।।
এড়িল পর্ব্বত অস্ত্র দৈত্যের ঈশ্বর।
অর্দ্ধচন্দ্র বাণে কাটে পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
তবে দৈত্য ধনঞ্জয়ে মারে দশ বাণ।
বাজিল পার্থের বুকে বজ্রের সমান।।
মহাঘাতে পার্থ হৈয়া ব্যথায় ব্যথিত।
মুহূর্ত্তেকে উঠিলেন গর্জ্জি সিংহমত।।
ধনুকে টঙ্কার দিয়া ক্রোধের আবেশে।
সহস্র তোমর এড়ে দৈত্যের উদ্দেশে।।
গর্জ্জিয়া উঠিল বাণ গগণ মণ্ডলে।
প্রাণভয়ে দৈত্যগণ পলায় সকলে।।
সৈন্য ভঙ্গ দেখি ক্রুদ্ধ দৈত্যের ঈশ্বর।
ঐষিক বাণেতে কাটে সহস্র তোমর।।
বাণ ব্যর্থ দেখি পার্থ দুঃখিত অন্তরে।
দিব্য ভল্ল মারিলেন দৈত্যের উপরে।।
বাণাঘাতে মুর্চ্ছাগত হৈল দৈত্যপতি।
রথ চালাইয়া বেগে পলায় সারথি।।
পরে দৈত্যপতি জ্ঞান পায় কতক্ষণে।
কালকেয়গণ আসি বেড়িল অর্জ্জুনে।।
মহাবল মহাশিক্ষা যত বীরবর।
প্রাণপণে করে যুদ্ধ পার্থ একেশ্বর।।
মানুষী রাক্ষসী দৈবী গান্ধর্ব্বী পিশাচী।
দ্রোণ স্থানে যত অস্ত্র পায় সব্যসাচী।।
প্রহর পর্য্যন্ত যুঝি পার্থ মহাবল।
রুধির সহিত অঙ্গে বহে ঘর্ম্মজল।।
দেখিয়া আনন্দমতি দৈত্যের ঈশ্বর।
উপায় না দেখি পার্থ হলেন ফাঁফর।।
মনে ভাবে পরম সঙ্কট আজি হৈল।
মাতলি এতেক দেখি কহিতে লাগিল।।
নিশ্চয় জানিনু পার্থ হৈলে জ্ঞান হত।
প্রাণপণে দেখাইলে নিজ শক্তি যত।।
তথাপি দুরন্ত দৈত্য না হৈল সংহার।
বিনা ব্রক্ষঅস্ত্র ইথে নাহি প্রতিকার।।
পাশুপত অস্ত্র আছে পশুপতি দান।
এড়িলে ভুবন যার পতঙ্গ সমান।।
সে হেন আছয়ে তব মহারত্ননিধি।
এমত সংযোগে তারে নিয়োজিল বিধি।।
এই সে আশ্চর্য্য বড় লাগে মম মনে।
এ সময়ে সেই অস্ত্র নাহি ছাড় কেনে।।
শুনি বীর পাশুপত নিলেন তৎক্ষণে।
মন্ত্র পড়ি যুড়িলেন ধনুকের গুণে।।
কোটি সূর্য্য জিনি অস্ত্র হৈল তেজোময়।
থাকুক অন্যের কার্য্য দেবতা সভয়।।
অস্ত্র অবতারকালে ত্রিবিধ উৎপাত।
নির্ঘাত উল্কা সদা বহে তপ্তবাত।।
প্রলয় জানিয়া সবে স্বর্গের নিবাসী।
রহিল অস্ত্রের মুখে দৃষ্টি অভিলাষী।।
অস্ত্রমুখে যেই হৈল হুতাশন বৃষ্টি।
দহন করিল তাতে অসুরের সৃষ্টি।।
জ্বলন্ত অনলে যেন শিমূলের তূলা।
তাদৃশ হইল ভস্ম দুষ্ট দৈত্যগুলা।।
অস্ত্রজাত অনলের প্রচণ্ড বাতাসে।
জীব জন্তু না রহিল দানবের দেশে।।
হেনকালে শূন্যবাণী শুনি এই রব।
সম্বর সম্বর পার্থ মজিল যে সব।।
ভাল হৈল, দুষ্ট দৈত্য হইল নিধন।
মনুষ্যেরে ত্যাগ ইহা না কর কখন।।
সংহার কারণ সৃষ্টি বিধির সৃজন।
বিনাশ করিতে ইহা ধরে ত্রিলোচন।।
যাবৎ না দহে ক্ষিতি অস্ত্রের আগুনে।
মন্ত্রবলে সম্বরিয়া রাখ নিজ তূণে।।
পুনঃ পুনঃ এইমত হৈল শূন্যবাণী।
আনন্দে বিহ্বল পার্থ ইষ্টসিদ্ধি জানি।।
মন্ত্রবলে অস্ত্র সম্বরেন বীরবর।
আশীর্ব্বাদ করি সবে গেল নিজ ঘর।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।