৭৫তম অধ্যায়
কৃষ্ণের ব্যঙ্গবাক্যে ভীমের উত্তেজনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! নিত্যক্ৰোধপরায়ণ মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর কৃষ্ণের বাক্যশ্রবণে সুশিক্ষিত অশ্বের ন্যায় ধাবমান হইলেন; অনন্তর কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন, “হে অচ্যুত! আমি যে নিমিত্ত যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হইয়া শান্তিপক্ষ অবলম্বনে কৃতযত্ব হইয়াছি, তুমি তাহা সবিশেষ অবগত না হইয়াই আমাকে তিরস্কার করিতেছ। তুমি আমার সহিত বহুকাল একত্রবাসনিবন্ধন আমার হৃদগত ভাবসকল অবগত হইতে পার অথবা যেমন হ্রদমাত ব্যক্তিরা হ্রদমধ্যস্থ দ্রব্যজাতের বিষয় কিছুই অবগত হইতে পারে না, তদ্রূপ তুমিও আমার আন্তরিক অভিপ্ৰায় জানিতে পার নাই; তন্নিমিত্তই অনুচিত বাক্যদ্বারা আমাকে তিরস্কার করিতেছ। তুমি যেরূপ কটুক্তি করিলে, ভীমসেনের প্রতি এরূপ অপ্রতিরূপ [বিসদৃশ-অসম্ভব] বাক্য প্রয়োগ করা অন্য কাহারও সাধ্য নহে। যাহা হউক, এক্ষণে যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর।
“সকলেই আপনার পৌরুষ ও পরাক্রম পরের অপেক্ষা অধিক জ্ঞান করে। হে জনাৰ্দন! আত্মপ্রশংসা নিতান্ত নিন্দনীয় তথাপি আমি কেবল তোমাকর্ত্তৃক নিন্দিত ও তিরষ্কৃত হইয়া আপনার বলের বিষয় কহিতে প্ৰবৃত্ত হইতেছি। হে বাসুদেবা এই যে স্বৰ্গ ও পৃথিবী দেখিতেছি, ইহা সমুদয় লোকের বাসস্থান, অচল, অনন্ত ও সকলের মাতৃস্বরূপ [মাতৃশক্তি স্বভাবতঃ চাঞ্চল্যহীনা]। যদি ঐ দুই পদার্থ সহসা ক্রুদ্ধ হইয়া শিলাদ্বয়ের ন্যায় ধাবমান হয়, তাহা হইলে আমি স্বীয় বাহুযুগলদ্বারা অনায়াসে উহাদিগকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে পারি। দেখ, আমার বাহুযুগল লৌহময় পরিঘদ্বয়ের ন্যায়; ইহার মধ্যে নিপতিত হইয়া বিমুক্ত হইতে পারে, এমন লোক আমার দৃষ্টিগোচর হয় না। হিমাচল, সমুদ্র, বলনিসূদন ইন্দ্ৰ, ইহারা তিনজনে আমার সহিত সসৈন্য সংগ্রাম করিলেও পরিত্রাণ পাইতে পারেন না। যেসমুদয় যুদ্ধকুশল ক্ষত্ৰিয় পাণ্ডবগণের প্রতি আততায়িতা প্রকাশ করিতেছে, আমি তাহাদের সকলকে এককালে ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া পাদদ্বারা মর্দন করিতে পারি।
“হে মধুসূদন! আমি পূর্ব্বে যেরূপ পরাক্রম প্রকাশ করিয়া ভূপতিগণকে বশীভুত করিয়াছিলাম, তাহা কি তুমি অবগত হও নাই? যদি না হইয়া থাক, তবে এই আগামী তুমুল সংগ্রামসময়ে সমুদিত সূৰ্য্যপ্রভার ন্যায় আমার অসীম পরাক্রম অবগত হইবে। হে জনাৰ্দন! ব্রণের পূয উন্নয়ন করিলে যেরূপ যন্ত্রণা হয়, তোমার পরুষবাক্যে আমার তদ্রূপ কষ্ট হইয়াছে। তন্নিমিত্ত স্বীয় অনুভাবানুসারে আপনার পরাক্রমের বিষয় কহিলাম; কিন্তু ইহা অপেক্ষাও আমার বলবিক্ৰম অধিক জানিবে। তুমুল সংগ্রাম সমারম্ভ হইলে আমি যখন অসংখ্য মাতঙ্গ, রথী, গজারোহী ও যুদ্ধকুশল ক্ষত্রিয়গণকে সংহার এবং সচরাচর ভূমণ্ডল [স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমস্ত জগৎ] আকর্ষণ করিব, তৎকালে তুমি ও অন্যান্য লোকসকল আমার পরাক্রম দৃষ্টিগোচর করিবে।
“হে মধুসূদন! আমার লজ্জা অবসন্ন হয় নাই, আমার মন কম্পিত হইতেছে না, সমুদয় লোক ক্রুদ্ধ হইলেও আমার ভয় জন্মে না। আমি কেবল কৌরবগণের সহিত সৌহার্দনিবন্ধন তাহাদের অবিনাশের নিমিত্ত আমাদের সমুদয় ক্লেশ উপেক্ষা করিয়া শান্তিস্থাপনে যত্ন করিতেছি।”