৭৫তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের প্র্রকিজ্ঞাশ্রবণে শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা
এ দিকে মহাত্মা বাসুদেব ধনঞ্জয়ের জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞ শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, হে ধনঞ্জয়! তুমি আমার সহিত মন্ত্রণা না করিয়া ভাতৃগণের সম্মতি ক্রমে জয়দ্রথকে বধ করিব বলিয়া যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছ, ইহা অত্যন্ত সাহসের কর্ম্ম হইয়াছে। এই যে বিষভার উপস্থিত হইয়াছে, ইহাতে কি প্রকারে আমরা সকল লোকের উপহাস হইতে পরিত্রাণ পাইব? আমি দুৰ্য্যোধনের শিবিরে চরগণকে প্রেরণ করিয়া ছিলাম; এই তাহারা ত্বরায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া এই বার্তা নিবেদন করিতেছে যে, তুমি জয়দ্রথ বধে প্রতিজ্ঞারূঢ় হইলে অস্মৎপক্ষীয় বাদিত্রনাদসহকৃত সুমহান্ সিংহনাদ কৌরবগণের শ্রবণগোচর হইয়াছিল। সবান্ধব ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ সেই শব্দে নিতান্ত ভীত হইলেন এবং এই সিংহনাদ অকারণ নয়; মহাবীর ধনঞ্জয় অভিমন্যু বধ শ্রবণে কাতর হইয়া রোষবশতঃ রাত্রিতেই যুদ্ধ করিতে বহির্গত হইবেন সন্দেহ নাই, এই বিবেচনা করিয়া যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। কৌরবগণের হস্তী, অশ্ব, পদাতি ও রথ সমূহের ভীষণধ্বনি প্রাদুর্ভূত হইল। হে রাজীবনোচন! সত্যব্রত কৌরবগণ এইরূপে যত্ন পূর্ব্বক যুদ্ধসজ্জা করিতেছে, এমন সময় তোমার জয়দ্রথ বধের সত্যপ্রতিজ্ঞা তাহাদের শ্রবণগোচর হইল। দুৰ্য্যোধনের অমাত্যগণ তোমার দারুণ প্রতিজ্ঞা শ্রবণে সকলেই ক্ষুদ্র মৃগের ন্যায় ভীত ও দুৰ্ম্মনায়মান হইতে লাগিল।
তখন সিন্ধু সৌবীরাধিপতি জয়দ্রথ নিতান্ত দুঃখিত হইয়া অমাত্যগণের সহিত আপনার শিবিরে আগমন পূর্ব্বক সমুদায় কল্যাণকর কাৰ্য্যের মন্ত্রণা করিয়া রাজ- সমাজে দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, হে কুরুনন্দন! ধনঞ্জয় আমাকে তাহার পুত্র হন্তা বলিয়া কালি আক্রমণ করিবে, সে সেনাগণের মধ্যে আমার প্রাণ সংহার করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে। দেব, গন্ধৰ্ব্ব, অসুর, সর্প বা রাক্ষসগণ সব্যসাচীর সেই প্রতিজ্ঞা অন্যথা করিতে সমর্থ নন। অতএব আপনারা সংগ্রামে আমাকে রক্ষা করুন; ধনঞ্জয় যেন আপনাদের মস্তকে পদার্পণ করিয়া লক্ষ্য গ্রহণ করিতে না পারে। যদি আপনারা সংগ্রামে আমাকে রক্ষা না করেন, তাহা হইলে অনুজ্ঞা করুন, আমি স্বস্থানে প্রস্থান করি।
কুরুরাজ দুৰ্য্যোধন জয়দ্রথের বাক্য শ্রবণে তাঁহাকে নিতান্ত ভীত জ্ঞান করিয়া অবাক্শিরাঃ ও বিমনায়মান হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন। রাজা জয়দ্রথ দুৰ্য্যোধনকে কাতর দেখিয়া মৃদুস্বরে আপনার হিতকর বাক্য কহিতে লাগিলেন,
হে রাজন্! মহাযুদ্ধে অস্ত্র দ্বারা অর্জ্জুনের অস্ত্র সকল প্রতিহত করিতে পারে, আমাদের মধ্যে এমন ধনুর্দ্ধর বীর দৃষ্টিগোচর হয় না। অর্জ্জুন বাসুদেবের সাহায্যে গাণ্ডীব ধনু কম্পন করিলে সাক্ষাৎ পুরন্দর হইলেও তাহার সম্মুখে অবস্থান করিতে পারেন না, শুনিয়াছি, ধনঞ্জয় পূর্ব্বে হিমালয় পর্ব্বতে পাদচারে মহাবীর প্রভু মহেশ্বরের সহিত সংগ্রাম এবং দেবরাজের নিদের্শানুসারে এক রথে হিরণ্যপুরবাসী সহস্র দানবের প্রাণ সংহার করিয়াছে। আমার বোধ হয়, ধনঞ্জয় ধীমান্ বাসুদেবের সহিত মিলিত হইলে অমরগণের সহিত ভুবনত্রয়কে বিনষ্ট করিতে পারে। এই জন্য আমি ইচ্ছা করিতেছি যে, হয় আপনারা আমাকে পলায়নে অনুজ্ঞা করুন, না হয়, বীৰ্য্যশালী মহাত্মা দ্রোণ পুত্রের সহিত আমাকে রক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হউন।
হে অর্জ্জুন! রাজা দুর্য্যোধন জয়দ্রথের বাক্যানুসারে তাহার রক্ষার্থে আচার্য্যের নিকট অনেক প্রার্থনা করিয়াছেন। সদুপায় সকল বিহিত এবং অশ্ব ও রথ সকল সজ্জিত হইয়াছে। কর্ণ, ভূরিশ্রবা, অশ্বত্থামা, দুর্জ্জয় বৃষসেন, কৃপ, শল্য, এই ছয় জন সমরে অগ্রসর হইবেন। মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য এক দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনা করিবেন, উহার পূৰ্বার্দ্ধ শকুট ও পশ্চাদর্দ্ধ পদ্মের ন্যায় হইবে। পদ্মের মধ্য স্থলে সূচী নামে গৃঢ় ব্যূহ নির্মিত হইবে এবং জয়দ্রথ অসংখ্য বীরগণে রক্ষিত হইয়া সেই সূচী ব্যূহের পার্শ্বে অবস্থান করিবেন। হে পার্থ! উল্লিখিত ছয় রথী ধনু, অস্ত্র, বল, বীৰ্য্য ও ঔরস প্রভাবে নিতান্ত অসহনীয়। এই ছয়জনকে পরাজয় না করিলে জয় দ্রথকে প্রাপ্ত হওয়া যাইবে না। হে ধনঞ্জয়! ঐ ছয় জনের প্রত্যেকের বীরত্বের বিষয় চিন্তা কর; তাঁহারা মিলিত হইলে শীঘ্র তাহাদিগকে পরাজয় করা সাধ্যায় নয়। অতএব আত্মহিত ও কাৰ্য্য সিদ্ধির নিমিত্ত মন্ত্রণাভিজ্ঞ সচিব ও সুহৃদগণের সহিত পুনরায় নীতি মন্ত্রণা করা আমাদের কর্ত্তব্য।”